Home ওপিনিয়ন গণহত্যার শিকার জাতি যখন গণহত্যাকারী রূপে ফিরে আসে

গণহত্যার শিকার জাতি যখন গণহত্যাকারী রূপে ফিরে আসে

প্রতিকী ছবি।

।। জান্নাতুল তাজরী তৃষা ।।

অবশেষে দীর্ঘ ১১ দিন পর ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব থামলো। মিশরের মধ্যস্থতায় ইসারায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং গাজায় হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন; যা শুক্রবার হতে কার্যকর হয়েছে। তবে এই যুদ্ধবিরতি পেতে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৬০ জন মানুষকে, যাদের মধ্যে ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি এবং ১২ জন ইসরায়েলি। আহত হতে হয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষকে এবং গৃহহীন হতে হয়েছে এক লক্ষ বিশ হাজার মানুষকে। এছাড়া ফিলিস্তিনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল, সরকারি ভবনসহ যা কিছু ধ্বংস হয়েছে এই ১১ দিনে তার পুন:নির্মাণ খরচ হবে কমপক্ষে দশ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি পেতে এক বড়সড় মূল্য চুকাতে হলো ফিলিস্তিনিদের। তবে এই যুদ্ধবিরতি ঠিক কতদিনের জন্য সে এক সংশয়ের ব্যাপার। কারণ, বিগত ৭৩ বছর ধরে যেই সমস্যার কারণে ক্ষণে ক্ষণে এমন যুদ্ধ, সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ সেই সমস্যার সমাধান হয়নি এখন পর্যন্ত। বলা বাহুল্য সেই সমস্যার সমাধান না হলে এই যুদ্ধবিরতি কোনো স্থায়ী সমাধান এনে দিবে না, বরং কিছুদিন পর হয়ত আরো শত শত বা হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিয়ে আরো এক যুদ্ধবিরতি আনতে হবে।

১৯৪৮ সালে পৃথিবীর ক্যান্সার খ্যাত ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয় ফিলিস্তিন ভূমিতে। মিশর, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক বাধা দিলেও পশ্চিমাদের সমর্থনে জয়ী হয়েছিলো ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধেও ইসরায়েলের বড় ধরণের জয় হয়েছিলো। এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রায় আশি ভাগ হজম করে নেয় ইসরায়েল। প্রায় ৫০০০ হাজার শুধু সামরিক সদস্যই মারা গিয়েছিলো এই সময়ের মধ্যে। আর ৬ দিনের এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিলো অগণিত বেসামরিক মানুষ, যার সঠিক হিসাব এখনো পর্যন্ত কেউ জানেনা। সেই সাথে ইসরায়েলের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছে কমপক্ষে এক কোটি ফিলিস্তিনি।

কিন্তু সাত দশক ধরে সংখ্যালঘু জায়োনিস্ট জাতি এত বড় তাণ্ডব চালানোর শক্তি কোথা থেকে পায়? উত্তর সহজ, ইসরায়েলের পশ্চিমা বন্ধু তথা যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক প্রতিমূর্তি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের কর্মকান্ডকে জাস্টিফাই করার সবচেয়ে বড় সহযোগি। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি একই রকম নমনীয় বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি বজায় রেখে চলছে। ক্ষমতায় ডেমোক্র্যাট আসুক বা রিপাবলিকান, ইসরায়েল নীতিতে তাদের তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। বিশ্ব দরবারে সবচেয়ে বড় মানবিক সংগঠন জাতিসংঘের পর্যন্ত এই জোটের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। কেনোনা এই সংগঠনও অনেকটা পশ্চিমাদেরর হাতের পুতুল। জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউটর হলো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলো। তাই জাতিসংঘের অবস্থা অনেকটা এরকম যে, “নুন খেয়েছি যার, গুণ গেয়েছি তার”।

অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘন উছিলায়, গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উছিলায় বিশ্বের কত কত দেশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বিশ্ব শক্তিগুলো বানিয়েছে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাঠ। নিজেদের ভূখণ্ডকে সুরক্ষিত রেখে জড়িয়েছে প্রক্সি যুদ্ধে। আগানিস্তান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এইসব যুদ্ধের কথা বিশ্ববাসী হয়ত ভুলে যায়নি।

কিন্তু এক কোটি ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করাকে হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে হয়না। প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুসহ অগণিত ফিলিস্তিনিদের হত্যাও হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা গণহত্যা মনে হয়না। তাই তো গত ১৭ ই মে, যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়ই বাইডেন প্রশাসন ইরায়েলকে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। সহিংসতার মধ্যেই এমন ঘোষণা নিশ্চয়ই ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভাঙতে কিংবা ভয় দেখাতেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতদিনে বিশ্বশক্তিদের বোঝা উচিত ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভাঙা অতটা সহজ হবে না। তারা যে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করছে তা বিশ্ব মিডিয়া ইতোমধ্যে প্রচারও করেছে।

ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের পুনরায় তাদের নিজ ভূমিতে ফিরতে না দেয়ার জন্য ইসরায়েলকে সবকিছু করতে হবে, এমন ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, “বৃদ্ধরা এক সময় মারা যাবে এবং অল্পবয়সীরা ধীরে ধীরে ভুলে যাবে”।

একথা থেকেই বোঝা যায়, কালের বিবর্তনে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে দখলদার ইসরায়েলিরা শতভাগ ফিলিস্তিন ভূমি হজম করার এক মাস্টার প্ল্যান নিয়েই হাজির হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা এর পূর্বে ইহুদিরা যেভাবে সিস্টেমটিক কিলিং বা গণহত্যার শিকার হয়েছিলো তারাও এখন অনেকটা সেই পথেই হাঁটছে হয়ত। এখানে অনেক বিশ্লেষকগণই দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিভাবে গণহত্যার স্বীকার সে ব্যাপারে সামান্য ব্যাখ্যা দেই।

আরও পড়তে পারেন-

জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বোজন স্বীকৃত গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এই চারটি উপাদানের ভিত্তিতে কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা হয়, মানসিক বা শারীরিকভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, জন্ম নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করা হয়, এক গোত্রের সন্তানদের যদি জোরপূর্বক অন্য গোত্রে প্রেরণ করা হয় তাহলেই সেটি হয়ে যাবে গণহত্যা। অর্থাৎ, উপরের চারটি উপাদানের যেকোনো একটির ভিত্তিতে যদি উপরের যেকোনো একটি কর্মকাণ্ডও ঘটানো হয় সেটিই গণ্যহত্যার পর্যায়ে পড়বে। গণ্যহত্যা বলতে সেখানে মানুষ মরতেই হবে বিষয়টা এমন নয়।

এখন ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে তাদেরকে প্রায়ই টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। তারা নিরস্ত্র এটা জেনেও ইসরায়েল তাদেরকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করছে; সহজাত মানবাধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করছে। তাহলে হলো তো ফিলিস্তিনে গণহত্যা? অথচ গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণকারী পশ্চিমারাই ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে স্বীকার করে না।

তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড গুরিওনের কথা অনুযায়ী বৃদ্ধরা মারা যেতে থাকলেও যুবকেরা ভুলে যায়নি তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটির স্মৃতি। আর এই কারণেই ৭৩ বছর ধরে চলছে এই সহিংসতা। যদি গুরিওনের কথা সত্যি হত তাহলে হয়ত আজকের দিনে এই সহিংসতা হত না; সেই সাথে মুছে যেত ফিলিস্তিনের নামও। কিন্তু তা হতে দেয়নি মরণাস্ত্রের সামনে ইট-পাথরের ঢিল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাহসী ফিলিস্তিনিরা। আর এভাবেই চলছে বছরের বছর ধরে যুদ্ধ ও যুদ্ধবিরতি চুক্তির খেলা। এই খেলায় প্রতিবারই বাসস্থান হারাচ্ছে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। সেই সাথে আরও শক্তিশালী হচ্ছে ইসরায়েলের খুঁটি।

হিটলারের প্রোপাগ্যান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস-এর এক বিখ্যাত উক্তি ছিলো যে, যদি একটি মিথ্যা বারবার বলা হয়, তাহলে এক সময় মানুষ সেটা সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে।

ইসরায়েলের ইহুদিরা হিটলার-গোয়েবলসের অত্যাচারের সরাসরি ভুক্তভুগী হয়েও তাদের চেয়ে মানসিকতায় উন্নত হতে পারেনি। ফিলিস্তিনের ভূমি দখলের ব্যাখ্যা হিসেবে গোয়েবলসের “বিগ লাই” (Big Lie) তত্ত্বেরই অনুসরণ করছে তারা। অনেকটা একই ঘটনা তারা এখন অন্য এক জাতিগোষ্ঠীকে ফেরত দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। বাস্তববাদী দিক দিয়ে যে স্বার্থপরতা আর প্রতিশোধপরায়ণতাই মানব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বর্তমান বিশ্বে ইসরায়েলের জায়োনিস্টরা। 

তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য খানিকটা স্বস্তির কথা হলো এবারে হামাসের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি কিছু রকেট ইসরায়েলের ৪ বিলিয়ন ডলারের আয়রন ডোমকে ভেদ করে ইসরায়েল ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। ইসরায়েলকে আয়রন ডোম বিক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছে এরচেয়েও শক্তিশালী ডিফেন্স তারা ইসরায়েলকে দিবে যেনো পরবর্তীতে হামাসের হামলা সম্পূর্ণভাবে ঠেকাতে সক্ষম হয় ইহুদিরা। এই আঘাত হানাকে হামাস নিজের পক্ষে জয় বলে মনে করছে। অন্যদিকে আবার, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এটা ইসরায়েলের জয় বলেই ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যার দিক দিয়ে ইসরায়েলেরই জয় হয়েছে, কিন্তু এইবারের যুদ্ধে এমন কিছু বিষয় দেখা দিয়েছে যা পূর্বের যুদ্ধে বা কোনো সহিংসতায় দেখা যায়নি। ১১ দিনের যুদ্ধ চলাকালীন ইসরায়েল ভূখন্ডের ভিতরে আরব-ইহুদিদের চরম দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছে দেশটি, যা ইসরায়েলের জন্য ছিলো এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রেসিডেন্ট রেউভিন রিভলিন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে দাঙ্গা থামানোর নির্দেশও দিয়েছিলেন। অনেক ইহুদি ধর্মাবলম্বীদেরও ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নিতে দেখা গেছে। ইসিরায়েলি অনেক সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও নিজেরদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। হয়ত এক সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের দুঃখ বুঝবে। ফিলিস্তিনিদের জন্য তথা মানবিকতার দায়ে হয়ত একদিন তারাও রাস্তায় নেমে ফিলিস্তিনিদের কাঁধে সহায়তার হাত রাখবে। কিন্তু সেইদিন আসতে আসতে হয়ত আরও এমন সাত দশক বা তার কম বেশি সময় পার হয়ে যাবে। তত দিনে হয়ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির চিত্রপটও অনেকটা পাল্টে যাবে।


লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: trisha.jannat1112@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।