Home সম্পাদকীয় নারী পাচারের নতুন চক্রের সন্ধান: মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো জরুরী

নারী পাচারের নতুন চক্রের সন্ধান: মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো জরুরী

ভারতের বেঙ্গুলুরুতে বাংলাদেশী এক তরুণীর নির্যাতনের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মানবপাচারের নতুন চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। উঠে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে বিখ্যাত হওয়া এবং বিদেশে কাজ পাইয়ে দেয়ার ফাঁদে ফেলে মানবপাচারকারি চক্র তরুণীদের পাচার করছে। রাজধানী ও আশপাশের জেলায় নাচের স্কুল খুলে চক্রটি তরুণীদের জোগাড় করে। এর সাথে কিছু ট্রাভেল এজেন্সিও জড়িত।

পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, টিকটকের ফাঁদে ফেলে এবং বিদেশের বিভিন্ন নামকরা হোটেলে নৃত্যশিল্পী হওয়ার লোভ দেখিয়ে এ পর্যন্ত হাজারের উপর তরুণীকে পাচার করা হয়েছে। এসব তরুণীকে প্রথমে ভারতে পরবর্তীতে সেখান থেকে অন্যান্য দেশে পাচার করা হয়। হোটেলের ড্যান্সার হিসেবে পাচার হওয়ার পর তাদের দিয়ে দেহব্যবসা করানো হয়। সরকারি একটি সংস্থার অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটকের মাধ্যমে তরুণীদের স্টার বানানো ও বিদেশে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করার সাথে প্রায় ৫০ জন জড়িত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়তই নিত্য-নতুন কৌশলের ভিডিও এবং বিভিন্ন লোভনীয় অফার উপস্থাপিত হয়। একেক সময় একেক ট্রেন্ড দেখা যায়। এর মধ্যে টিকটক বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিখ্যাত তারকারাও টিকটক ভিডিও করে আপলোড করেন। আকর্ষণীয় এই ভিডিওর প্রতি সাধারণ তরুণ-তরুণীরাও আগ্রহী হচ্ছে।

এ সুযোগে টিকটকে পারদর্শীরা যেমন যুক্ত হয়, তেমনি এ মাধ্যমে নারী পাচারকারীরা যুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের আকৃষ্ট করে। রাতারাতি টিকটক তারকা বানিয়ে দেয়ার কথা বলে তাদের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। একশ্রেণীর তরুণী বুঝে না বুঝে টিকটকারদের সাথে পরিচিত হয় এবং যোগাযোগ করা শুরু করে। খ্যাতির লোভে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাদের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে এবং সর্বনাশের পথে পা বাড়ায়। যখন বুঝতে পারে তখন আর তাদের ফেরার পথ থাকে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটক মানবপাচারকারিদের একটি নতুন কৌশল। নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করা তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। এর আগে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে বিদেশে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানবপাচার করেছে এখনো করছে।

ভালো চাকরির আশায় অনেকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশ গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিদেশের হোটেলে ড্যান্সার হিসেবে তরুণীদের ফাঁদে ফেলার এ খবর নতুন নয়। গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হোটেলে ড্যান্সার হিসেবে নারী পাচার করার এক বড় চক্রের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মূল হোতাকেও দেশে গ্রেফতার করা হয়। দেখা যাচ্ছে, মানবপাচারকারিরা একেক সময় একেক কৌশল অবলম্বন করছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, কোনো মর্যাদাশীল ও মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবারের সন্তানরা টিকটকের মতো ভিডিওতে জড়ায় না। তারা এর কুফল সম্পর্কে সচেতন থাকে। একশ্রেণীর তরুণীর মধ্যে এ নিয়ে উচ্ছ্বাস ও বেপরোয়া মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। তারাই বিপদগামী হয়ে উঠে। টিকটকের মাধ্যমে যারাই পাচারের শিকার হয়েছে তাদের অতি উৎসাহ, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং উচ্চাভিলাষই এ পরিণতি ডেকে এনেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাল-মন্দ দিক সম্পর্কে তারা এবং তাদের পরিবারের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী। পারিবারিক শাসন-বারণ, নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন কেউ এ ধরনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারে না। শুধু টিকটকই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক তরুণীর প্রতারিত হওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে। এক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা না থাকাই মূলত দায়ী। আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব, বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস তার সন্তানদের ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত মোবাইল ফোনসহ প্রযুক্তির অন্য কোনো গেজেট হাতে তুলে দেননি। এমনকি তার ছেলেকে প্রতিদিন স্কুলের টিফিনের খরচ বাবদ ৫ ডলারের বেশি দেননি। এতে তার ছেলে অসন্তুষ্ট হলেও তাকে বলেছিলেন, তার বাবা-মা এই পাঁচ ডলারও দিতে পারতেন না।

আরও পড়তে পারেন-

তিনি ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি নিজে বড় হয়ে আয় করে খরচ করো। অথচ বিল গেটস ইচ্ছা করলে তার সন্তানদের প্রতিদিন হাজার হাজার ডলার হাত খরচ দিতে পারতেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি সন্তানদের নীতি-নৈতিকতার মধ্য দিয়ে বড় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সন্তানদের দিকে তাকালেও দেখা যায়, তারা বিভিন্ন দোকান ও প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জীবন চালাচ্ছে। আমাদের দেশে একশ্রেণীর অভিভাবক পারিবারিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার প্রতি উদাসীন থাকায় তাদের সন্তানরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। তারা মোবাইল ও প্রযুক্তি নিয়ে সন্তানের ঘাটাঘাটি ও বিভিন্ন বিষয়ে জড়িয়ে পড়াকে ক্রেডিট হিসেবে গণ্য করেন। সন্তান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি করছে, কাদের সাথে যোগাযোগ করছে তার আচরণে কি পরিবর্তন হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো ধরনের খোঁজখবর রাখেন না। ফলে অনেক ছেলে-মেয়ে কুসঙ্গে ও কুকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

আধুনিক প্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যমকে যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি এর কুফলও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানবপাচারকারিদের সক্রিয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আগেও তাদের যেমন বিভিন্ন কৌশল ছিল, সময়ের সাথে সাথে তা পরিবর্তন করবে, এটাই স্বাভাবিক। এক সিন্ডিকেট ধরা পড়লে নতুন সিন্ডিকেট ফাঁদ পাতবে, এ ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে।

এ থেকে মুক্ত থাকতে হলে প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের বিশেষ করে তরুণীদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন হওয়া বাঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। সমাজে যেসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে তা পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে যে ঘটছে, তা মানতে হবে। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সন্তানদের মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানদের পারিবারিক শাসন-বারণ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার মধ্য দিয়ে বড় করে তুলতে হবে। এটা যেমন তাদের রক্ষাকবচ তেমনি পরিবার ও সমাজেরও রক্ষাকবচ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।