Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ভারতে মন্দিরের নিরাপত্তার নামে জোরপূর্বক মুসলিম বসতি উচ্ছেদের চক্রান্ত

ভারতে মন্দিরের নিরাপত্তার নামে জোরপূর্বক মুসলিম বসতি উচ্ছেদের চক্রান্ত

।। মুফতি ইসহাক ওমর ।।

গোরখনাথ মন্দির। উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলার ঐতিহাসিক একটি হিন্দু মন্দির। প্রায় ৫২ এক্টর জায়গা নিয়ে উক্ত মন্দিরের অবস্থান। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে উক্ত মন্দিরের পুরোহিত হিসেব আছেন ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দুনেতা যেগি আদিত্য নাথ। যিনি বিগত তিন মেয়াদে (ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির) স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে ছিলেন এবং বর্তমানে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আছেন।

‘মন্দিরের নিরাপত্তার’ নামে আশেপাশের ১২৫ বছর ধরে বসবাসরত মুসলিম পরিবারগুলোকে ‘জবরদস্তিমূলক’ উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাচ্ছে যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসন। ভুক্তভূগীদের অভিযোগ, ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কাগজে দস্তখত নেওয়া হচ্ছে। যে কাগজে নেই কোনো সরকারী অফিসের নাম, নেই কোনো সরকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর।

ভুক্তভোগী মুহাম্মদ মুদ্দাসসিরের অভিযোগ,গত মে মাসের শেষ দিকে কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা পুলিশের সহযোগিতায় আমাদের কাছে এসে বলল, তোমরা সরকারের সাথে লড়তে পারবে না। তোমাদের সামনে বাঘ আছে। মুকাবেলা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব না। তিনি আরো বলেন, কর্মর্কতাদের চাপে পড়ে আমরা বাধ্য হয়ে কাগজে স্বাক্ষর করেছি। আমাদেরকে এতই ভয় প্রর্দশন করা হয়েছে যে, আমরা সেই কাগজে স্বাক্ষর করেছি। সরকারের সাথে কে লড়াই করতে পারবে? আমরা কোনো কিছুর লোভে পড়ে অথবা স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করিনি। জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদ কার্যক্রমের পরিকল্পনা আমাদের রাতের ঘুম উড়িয়ে নিয়ে গেছে। দিনের বেলায়ও আমরা স্বস্তির সাথে থাকতে পরছি না। আমাদের মস্তিষ্কে এখন একটা কল্পনাই ঘুরছে যে, জানি না এখন আমাদের কী হবে? হশিমপুরায় কী হয়েছে, তা আমরা জানি। আমাদের ভয় হচ্ছে কোথও ট্রাকে করে নিয়ে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে না তো! (ইন্ডিপেন্ডেন্ট উর্দু)।

স্থানীয় আটা ব্যবসায়ী মুশির আহমদ সংবাদমাধ্যমকে জানান, আমরা নিজেদের জায়গা-জমি কোনোভাবেই তাদেরকে দেওয়ার পক্ষে নই। এই মন্দিরে এ পর্যন্ত অনেক পুরোহিত নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বর্তমান পুরোহিত (যোগী আদিত্যনাথ) ছাড়া অন্য কোনো পুরোহিতের কাছে আমাদের এখানে বসবাস করার ব্যাপারে আপত্তি ছিলো না।

জাবেদ আখতার। ভারতীয় রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। মন্দিরের সীমানা থেকে তার ঘর মাত্র ৮ মিটার দূরত্বে অবস্থিত। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আমাদেরকে কোনো সরকারী নোটিশ দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র একটি কাগজে আমাদের দস্তখত নেওয়া হচ্ছে। যার কারণে আমরা খুবই পেরেশান। তিনি আরো বলেন, জীবনের ৭১ বছর পর্যন্ত আমি এখানে অতিবাহিত করেছি। যে ঘরে আমি এবং আমার পরিবার থাকি সেটা আমার দাদার নির্মাণ করা। কোনো পরিবারকে যখন তার ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়, তার জন্য বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করা হয়।

আরও পড়তে পারেন-

আমাদের জন্য বিকল্প কোনো জায়গার ব্যবস্থাও করা হয়নি। আমরা সরকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলাম যে, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। আমাদের সাথে হিন্দু ভাইদের কোনো সময় কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি হয়নি। আজ এমন কী সমস্যা হল যে, আমাদেরকে এখান থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে? তখন তারা (সরকারী কর্মকর্তা) উত্তর দেয়, এটা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। জাবেদ আখতার আরো বলেন, আমাদেরকে বলা হচ্ছে মন্দিররে সিকিউরিটির জন্য ঘর ভাঙ্গা হবে। কিন্তু সিকিউরিটির অন্তরালে তাদের কি পরিকল্পনা তা আমরা বুঝতে পারছি না। অথচ মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য অনেক জায়গা রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে এবং বাইরে দুটি পুলিশ চৌকি আছে। মন্দিরের পাশেই আছে পুলিশ স্টেশন।

ব্যবসায়ী নুর আহমদ জানান, এই সমস্যা শুধু আমাদের বাসস্থানকে কেন্দ্র করে নয়; বরং এটা আমাদের রুজি-রুটিরও সমস্যা। আমরা এখান থেকে যেতে চাচ্ছি না। কেননা এই এলাকার সাথে আমাদের রুটি-রুজিও জড়িত।

মন্দিরের আশেপাশে অবস্থিত যে ১১ টি মুসলিম পরিবারকে মন্দিরে নিরাপত্তার অজুহাতে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, তার মধ্যে ৯ টি পরিবার উক্ত কাগজে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করেছে। বাকি যারা এখনো স্বাক্ষর করেনি তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। যদিও কর্তপক্ষ দাবী করছে, মুসলমানগণ মন্দিরের নিরাপত্তা এবং পুলিশি চৌকি স্থাপনার জন্য স্বেচ্ছায় তাদের ঘর-বাড়ী দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা এর উল্টো। এমনি এ বিষয়ে বাস্তবতা যাচাই করার জন্য দিল্লির একজন মুসলিম সাংবাদিক গোরখপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, উক্ত সাংবাদিককে ন্যাশনাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার এবং এ বিষয়ে কোনো নিউজ করলে জেলে দেওয়ার হুমকিও দেন।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, যে মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের বসতি উচ্ছেদ করা হচ্ছে উক্ত মন্দিরের জায়গাটি ততকালীন উওদ (লক্ষ্ণৌ) এর নবাব আসিফুদদাওলাহ কর্তৃক মন্দিরের জন্য ওয়াকফকৃত। যার আশেপাশে অধিকাংশই মুসলিম বসতি। যারা শতাব্দিকাল ধরে সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছেন।

১২৫ বছর ধরে বসবাসরত মুসলিম পরিবারগুলো এতদিন পর্যন্ত মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচিত হয়নি, হঠাৎ এতদিন পর আজ কেন তারা মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠল? এটাকি বাস্তবেই মন্দিরের নিরাপত্তার বিবেচনা নাকি ভারতের উগ্র হিন্দুদের মুসলিম এবং ইসলাম বিদ্বেষের বিষাক্ত থাবা?

হাজার বছর ধরে ভারতের যেসব হিন্দুরা অচ্ছুৎ, দলিত ইত্যাদি নামে কুকুরে চেয়ে নিখৃষ্ট জীবন যাপন করেছিল, হিন্দু রাজাদের নির্যাতনের মুখে যারা নিজেদের মানুষ্য পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারতো না, মুসলমানগণ ৮০০ বছর পর্যন্ত ভারত শাসন করে তাদেরকে মানুষত্বের পরিচয় দিয়েছিল, তাদেরকে শিখিয়েছিল সভ্যতা এবং মানবতা। মুসলমানদের উচ্ছিষ্ট ভোগী উগ্রপন্থী হিন্দুরাই মুসলমানদেরকে নিজ আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে!?

উল্লেখ্য, যোগী আদিত্যনাথ ১৯৯৮ সাল থেকে গোরখপুরের পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার পর থেকেই সেখানকার মুসলমানদের উপর এক ভয় এবং আতঙ্কের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উত্তর প্রদেশের অনেক মুসলিম স্মৃতিবিজাড়িত স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। এমনকি কিছুদিন পূর্বে উত্তর প্রদশের বারাহবাঙ্কি জেলায় ১১২ বছরের পুরাতন একটি মসজিদকে রাতের অন্ধকারে ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি উক্ত মসজিদের কোনো চিন্হও অবশিষ্ট রাখেনি।

[তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিপেন্ডেন্ট উর্দু, রোযনামা খবরীঁ, জিউ নিউজ উর্দু, আল-জাজিরা]

– মুফতি ইসহাক ওমর, শিক্ষক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।