Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ মুসলিমবিদ্বেষী অপতৎপরতার বলি হলেন নওমুসলিম শহীদ ওমর ফারুক (রহ.)

মুসলিমবিদ্বেষী অপতৎপরতার বলি হলেন নওমুসলিম শহীদ ওমর ফারুক (রহ.)

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ।।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে মসজিদের ইমাম নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গত ১৮ জুন শুক্রবার রাতে ইশার নামায পড়ে ঘরে ফিরে আসার পর উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা পরিবারের সদস্যদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে। এসময় তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা তার বুকে লাথি মারে ফেলে দেয়। এই নির্মম হত্যাকা-ের দুই সপ্তাহ পার হলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এখনো পর্যন্ত খুনিদের চিহ্নিত করা বা ধরতে না পারায় পার্বত্য অঞ্চলের মুসলিম কমিউনিটিতে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অনেক নওমুসিলম পরিবার জঙ্গলে আত্মগোপন করে আছেন, এমন খবরও আসছে বিভিন্ন মিডিয়ায়।

শহীদ ওমর ফারুক (রহ.) রোয়াংছড়ির মতো দূর্গম পার্বত্য এলাকায় একে একে কমপক্ষে ত্রিশটি পরিবারকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করেছিলেন। এ জন্যই তাকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে বলে তার পরিবার দাবি করেছে।

ওমর ফারুক ২০১৪ সালে থানচি থানার আলী কদমে তার একজন উপজাতীয় মুসলিম বন্ধুর দাওয়াতে উদ্বুব্ধ হয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। পরে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও ইসলাম গ্রহণ করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। ইসলামধর্ম গ্রহণের পর তিনি তাবলীগ জামাতে সময় লাগান এবং তার সন্তানদেরকেও মাদরাসায় ভর্তি করান। মূলত তাবলীগের মাধ্যমেই ওমর ফারুকের মধ্যে দাওয়ার চেতনা অঙ্কুরিত হয় এবং তিনি তার আশেপাশের অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এতে একের পর এক পরিবারকে ইসলামের আলোয় দিক্ষিত করতে থাকেন।

বেশ কিছু পরিবার ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে আসলে ওমর ফারুক আলী কদম থেকে পরিবার নিয়ে রোয়াংছড়িতে নিজের পৈত্রিক নিবাসে ফিরে আসেন এবং নিজের এক একর জায়গার উপর একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে নিজেই সেখানে পাঞ্জেগানা নামাযের ইমামতি শুরু করেন। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালে এই মসজিদে তিনি মাইক লাগিয়ে আযান দেয়া শুরু করেন। জানা যায়, মসজিদে মাইক লাগানোর পর থেকে তার উপর প্রাণনাশের হুমকি শুরু হয়। তিনি প্রায়ই তার পরিবার, স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে এই হুমকির কথা বলতেন এবং কোন হুমকিই তাঁকে ঈমান ও ইসলামের মহান খেদমতের কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। শহীদ ওমর ফারুক শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর ঈমানী দৃঢ়তা অক্ষুন্ন রেখেছেন।

আরও পড়তে পারেন-

আমরা অনেকেই জানি, বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ে খ্রীষ্টান মিশনারিরা অবাধে তৎপরতা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক বান্দরবানে বহু সংস্থা খ্রিষ্টান মিশনারি তৎপরতার মাধ্যমে ধর্মান্তর করণের কাজ প্রকাশ্যে চালাচ্ছে। তাদের প্রলোভনে পড়ে হাজার হাজার দরিদ্র উপজাতি পরিবার খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র ও অনগ্রসর ক্ষুদ্র উপজাতীয়দের কয়েকটি সম্প্রদায়ের পুরো জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়। কিন্তু খ্রিস্টান মিশনারীদের এমন প্রকাশ্য তৎপরতায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের কোনরূপ মাথাব্যথা নেই। অথচ কোনো প্রলোভন বা মিশনারী তৎপরতা ছাড়াই নিজস্ব বিচারবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ ও দ্বীনি জীবন-যাপন করায় নওমুসলিম ওমর ফারুককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হল। আর কোনো উপজাতি পরিবার যাতে ইসলাম গ্রহণ করার সাহস না করে, সে মেসেজ দেয়াই এ হত্যাকান্ডের মূল লক্ষ্য হতে পারে বলে স্থানীয় মুসলমানরা মনে করছেন।

রোয়াংছড়িতে নওমুসলিম ওমরফারুক হত্যাকা-ের পেছনে কারণ যাই থাকুক, খুনি-সন্ত্রাসীদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন খুনীদের ধরতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে এটা খুব কঠিন কিছু নয়। কারণ, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সে দক্ষতা ও পারঙ্গমতা আছে।

পাহাড়ে বিবদমান কোনো গ্রুপের সাথে ওমর ফারুক জড়িত ছিলেন না। তিনি নিতান্তই সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তিনি ইসলামের মর্মবাণী অনুধাবন করে নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে দাওয়াতি কাজ করছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষ ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডে ক্রুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার স্বার্থে ওমর ফারুকের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরী। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে কারা অস্ত্র ও অর্থ তুলে দিচ্ছে তা বিবেচনায় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে তাদের নির্মূল করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। পাহাড়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করে টহল জোরদার করতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন মিশনারী ও এনজিও তৎপরতায় গভীর নজরদারি রাখা শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, বরং দেশের অখ-তা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকিমুক্ত রাখতেও এটা জরুরী।

নও মুসলিম ইমাম ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্যভাবেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই ঘটনায় এখন পার্বত্য অঞ্চলে যারা ইসলামে আসতে চাইবেন, তারা ভয় পাবেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শংকিত থাকবেন। দাওয়াতী কার্যক্রমে এই ঘটনায় গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সমূহ আশংকা তৈরি হয়েছে। এটিকে এত হালকা করে দেখবার সুযোগ নেই। মুসলমানদের জন্য এই ঘটনা অনেক বড় উদ্বেগের। এতে দায়ীদের সামনে অনেক বড় একটি বাধা এলো। এই ভয় কাটিয়ে দেয়া সহজ নয়৷

শহীদ ওমর ফারুকের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। শহীদ ওমর ফারুক পার্বত্য চট্টগ্রামে দাওয়াহ কার্যক্রমে এক মহান বিপ্লবের সূচনা করে গেছেন। তিনি কোনরূপ কলহ ও ভেদাভেদে না জড়িয়ে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজ চালিয়ে গেছেন। সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ওমর ফারুক শুধু এক ইসলামের প্রতি, আল্লাহ আর তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস এনেই এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় জীবন দিয়ে গেলেন। আল্লাহ তাঁকে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে বাছাই করেছেন। ওমর ফারুক জীবনদান করে অনেক শিক্ষার খোরাক রেখে গেছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, পার্বত্য এলাকায় শহীদ ওমর ফারুক (রাহ.) দাওয়াতী কাজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন, সেটাকে আরো বেগবান করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে। তাঁর নির্মিত মসজিদটিকে বৃহৎ আকারে একটি ইসলামী কমপ্লেক্সে রূপ দিয়ে সেটাকে পাহাড়ি এলাকায় ইসলাম ও শান্তির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করার মধ্য দিয়েও তাঁর ঈমানী মিশনকে স্থায়ী রূপ দেওয়া যায়।

দয়াময় আল্লাহর দরবরে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন দয়া পরবশ হয়ে শহীদ ওমর ফারুক (রহ.)কে মাগফিরাত ও জান্নাতের আ’লা মাক্বাম দান করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ গোটা বাংলাদেশকে ইসলামবিদ্বেষী চক্রের সকল ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

লেখক: শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।