Home ওপিনিয়ন কুরআন অবমাননা: বিদ্যুৎ বন্ধ, তবু জ্বালাও বাতি

কুরআন অবমাননা: বিদ্যুৎ বন্ধ, তবু জ্বালাও বাতি

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশে চলমান প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে তথাকথিত উদারমনা ভাইরা বলছেন যে, মুসলমানরা কুরআন শরীফের প্রতি ভালবাসা দেখাতে গিয়ে কুরআন পরিপন্থী কাজ করছে, আবার নিজেকে ঈমানদারও ভাবছে। তাদের যুক্তি হলো, ১/২ জন হিন্দুর ভুলের কারণে কেন সারাদেশের হিন্দুদের মাশুল দিতে হবে।

তবে আমার মতে এই কথাগুলো পুরোপুুরি সঠিক নয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও এমন কথাকে সমর্থন করে না। কেবল মিডিয়া আর মন্ত্রী-আমলাদের কথাই এদেশে শেষ বা সত্য কথা নয়, আরও অনেক কথা আছে। সবকিছু জানার পরে আমার মনে হয় না এমন কথাকে কেউ সমর্থ করতে পারে।

এছাড়া কুরআনপ্রেমীদের যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আমরা এখন দেখছি, তার সম্পর্কে কিছু না জেনে না ভেবে হুট করে কিছু বলে দিলেই কী তা সত্য হয়ে গেলো? তাদের এই ক্ষোভ বৃদ্ধির পেছনেও কিছু কারণ আছে। আমার একটি লেখায় বলেছিলাম, মানুষ আইন হাতে তুলে নেওয়ার পেছনে যেসব বিষয় কাজ করে, তার অন্যতম একটি হলো ন্যায্য বিচার না পেলে। আরেকটি হলো সমাজে স্পষ্ট বৈষম্যের মুখে পড়লে। যেমন, আজ পর্যন্ত কুমিল্লার ঘটনার দৃশ্যমান কোন সমাধান প্রশাসন বা সরকার করেনি। এমনকি কেউ গ্রেফতার হয়েছে বলেও তথ্যভিত্তিক সংবাদ পাইনি।

বৈষম্যের বিষয়টা তো সমাজে মহামারির আকার ধারণ করেছে। একটি আমরা দেখি মিডিয়াতে। দেশের কোন মন্দিরে সামান্য হাতাহাতি হলেও সেটা বিবিসির খবরে উঠে আসে। কিন্তু কুরআন নিয়ে এতো বড় ঘটনা (অবশ্যই অবমাননার এই ঘটনাটা অনেক বড় ঘটনা) ঘটলো, কিন্তু দেশের মিডিয়া বিমাতাসূলভ আচরণ করলো। এমনকি বিবিসি বিরুদ্ধাচারণই করলো বলা চলে। পুরো মিডিয়া জগত হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিপক্ষে বলা শুরু করলো। কেউ কেউ তো কোন অনুসন্ধান ছাড়াই এটাও বললো যে, মুসলমানরাই ওখানে কুরআন রেখে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। এর আগেও বহু ঘটনা ঘটেছে যাতে মিডিয়া স্পষ্টভাবে পক্ষপাতিত্ব বা মুসলমানদের বিরোধিতা করেছে, জানি না কোন স্বার্থে।

আজকে অনেকেই বলছে, বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর হামলা করা অসভ্যতার নামান্তর, এটা সাম্প্রদায়িকতা, এটা তাণ্ডব, এই সেই হাজারও কথা। আমি কারও উপরে হামলা চালানোকে সমর্থন করছি না। এর তীব্র নিন্দা জানাই। কিন্তু কথা হলো, আজকে যারা হিন্দুদের উপরে ভাঙচুর চালানোতে মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছে, গতকাল কি তারা অন্তত একটু দুঃখ হলেও প্রকাশ করেছে? পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু মানুষ মারা গিয়েছে, তাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে? একজন মুসলমানের কাছে কুরআন এবং কুরআনপ্রেমী জ্যান্ত একজন মুসলমান মূল্যবান নাকি জানহীন প্রতীমা বেশি মূল্যবান?

আমি বলছি না, তাদের উপর হামলা করা ঠিক হয়েছে। তবে কুরআনের অবমাননা করাও তো অবশ্যই ঠিক হয়নি? কয়েকজন মানুষকে মেরে ফেলাও তো ঠিক হয়নি, সেটা কেন আমরা বলছি না?

আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দিয়ে আমাকে যদি বলে তুমি বাতি জ্বালাচ্ছো না কেন, এটা যেমন হাস্যকর, এই বিষয়টাও তেমনই।

কেউ কেউ একটু উদারতা দেখিয়ে বলতে পারেন যে, সরকার কী করলো বা মিডিয়া কী করলো – সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। ইসলাম এতো ছোটও নয় যে, সরকার বা গুটিকয়েক মিডিয়ার কারণে ইসলামের আদর্শ ছেড়ে হামলা-ভাঙচুরে জড়াতে হবে। ইসলামে আঘাতেও প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাল্টা আঘাত করা বা মন্দির ভাঙা মানে আমরা ফেইল।

এসব কথায় আমার খুব হাসি পায়। আপনি একজনের টুঁটি চেপে ধরবেন, আবার বলবেন যে হাত-পা নাড়াবা না, সেইটা কেমনে হবে? সে তো তার প্রতিক্রিয়া দেখাবেই! হাত-পা ছুঁড়বেই!

সমাজবিজ্ঞানের একটা বড় কথা হলো, সমাজের একটি ক্রিয়া আরও ১০টি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাও মনে রাখতে হবে। আপনি/আমি ঘরে আছি। খুব সহজেই অনেক কথা বলছি। কিন্তু দেশের বাস্তবতা এতো সহজ নয়। এই দেশে মুসলিমদের পান থেকে চুন খসলেই স্বজাতিরাও তাদের পেছনে লাগে। কিন্তু সংখ্যালঘুর অযুহাতে বড় বড় অপকর্ম করেও অন্যরা পার পেয়ে যায়।

এই সংস্কৃতি যতদিন বদলাবে না, দেশের সকল নাগরিক যতদিন তাদের ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার ও ন্যায্য বিচার পাবে না, যতদিন এই সমাজ থেকে বৈষম্যের মূলোৎপাটন হবে না, ততদিন এই অস্থিরতা বেড়েই চলবে। মানুষ আরও দিগুণ আক্রোশ নিয়ে ধেয়ে আসবে।

– কাজী হামদুল্লাহ, সম্পাদক- প্রবচন সাহিত্য পত্রিকা।