Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ টাইটানিক থেকে শাহ আমানত

টাইটানিক থেকে শাহ আমানত

।। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ।।

শুনে শুনে বড় হয়েছি, “সাগরে শোলা ডুববে কিন্তু টাইটানিক ডুববে না,” এরকম একটি কথা নাকি টাইটানিকের প্রস্তুতকারক বলেছিলেন।

আসলেই বলেছিলেন কি না তার কোনো তথ্য কোথাও পাইনি, এবং যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এটি বানানো কথা হওয়ার।

কিন্তু বাস্তবে বলুন আর না বলুন, টাইটানিক ডুবেছিল, আর প্রাণ হারিয়েছিল হাজার দেড়েক লোক। আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে ডুবে যায় সে যুগের সবচেয়ে বড় জাহাজ।

অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে যে টাইটানিক সবচেয়ে বড় জাহাজ। সত্যতা হল, আশির দশকে টাইটানিক থেকে ৬-৭ গুণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অনেকগুলো জাহাজ তৈরি হয়েছে। এখনও যেসব সুপার ট্যাংকার মহাসাগর দাপিয়ে বেড়ায়, তারা টাইটানিক থেকে প্রায় চারগুণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন।

তবে এত বড় এসব জাহাজও ডুবেছে, কিংবা সাগরে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে।

সাগরে জাহাজ কীভাবে ডোবে, সেটাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

আমাদের প্রচলিত একটি ধারণা যে জাহাজ বড় হলেই মনে হয় সাগরে বেশি নিরাপদ। আসলে ঘটনাটি তার উল্টো। যেমন একটি বিল্ডিং যত উঁচু হয়, তত দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তেমনি একটি জাহাজ যত বড় হতে থাকে, তার দুর্বলতাও বাড়তে থাকে। যেমন একটি ড্রাম যদি সাগরে ভাসানো হয়, যতই ঝড় কিংবা ঢেউ উঠুক, তার কিছুই হবে না।

কিন্তু ড্রামটি যদি ত্রিশ ফুট লম্বা হয়?

সন্দেহ নেই বড় ঢেউতে আছাড় খেয়ে সে ভেঙে যেতে পারে।

তেমনি ১০০০ ফুট লম্বা বড় জাহাজ অনেক সময় বড় ঢেউ এর মধ্যে পরে একদম দু টুকরো হয়ে গেছে এমন ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এমন ঢেউয়ে মাত্র ৪০-৫০ ফুট লম্বা টাগ বোট কিংবা ফিশিং বোট আরামে টিকে থাকবে, অনেক দুলবে, কিন্তু ভাঙবে না।

আবার টাইফুন কিংবা সাইক্লোনের মুখোমুখি বড় জাহাজগুলো ছোট জাহাজ থেকে বেশি নিরাপদ, কারণ প্রচণ্ড বাতাস একটি ছোট জাহাজকে উল্টে ফেলতে পারে, যেটা বড় জাহাজের ক্ষেত্রে সহজে ঘটবে না।

কিন্তু আইসবার্গের কিংবা ডুবন্ত কোনো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে তলা ফুটো হয়ে কি একটি জাহাজ ডুবে যেতে পারে?টাইটানিক এভাবেই ডুবেছে। কিন্তু এ যুগে এর সম্ভাবনা খুবই কম।

এ যুগে কেন এরকম ঘটবে না তা বঝতে হলে টাইটানিক ডুবির ঘটনাটি বুঝতে হবে।

১৯১২ সালে টাইটানিক যখন তৈরী হয়, তখনও জাহাজ তৈরীর নিরাপত্তা বিষয়ক আইনকানুন তেমনভাবে প্রয়োগ হতো না। তারপরেও টাইটানিক ডুবিতে এত মৃত্যুর প্রথম কারণ হলো জাহাজে পর্যাপ্ত লাইফবোট ছিল না। টাইটানিকে নাবিক ও যাত্রী মিলিয়ে প্রায় ৩৩০০ জন মানুষ ছিল, কিন্তু মাত্র ১১৭৮ জনের জন্য পর্যাপ্ত লাইফবোট ছিল। যদি সব যাত্রীর জন্য লাইফবোট থাকত, তাহলে অনেক মৃত্যু ঠেকানো যেত।

এখন কার্গো জাহাজ গুলিতে যদি ৩০ জন নাবিক থাকে, লাইফবোট থাকে ৬০ জনের জন্য।

টাইটানিক ডুবতে সময় নিয়েছিল মাত্র ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট। ডোবার কারণ হলো তলা ফুটো হয়ে পানি ঢোকা।

আমাদের নদীতে যেসব মাঝারি আকারের লঞ্চ কিংবা নৌকা চলাচল করে, এদের তলাতে ফুটো হলেও পানি ঢুকে দ্রুত সেটা ডুবে যাবে। অনেক সময় দেখা যায় অনেকগুলো ড্রাম, কিংবা প্লাস্টিকের জেরি-ক্যান একটার পর একটা সাজিয়ে উপরে কাঠের পাটাতন দিয়ে ভেলার মত বানানো হয়।

এমন একটি ভেলা যদি কোনো কারণে ফুটো হয়ে যায়, তাহলে কি সেটা ডুববে? ডুববে না, কারণ কোনো কিছুর খোঁচায় হয়তো বিশটি ড্রামের একটি বা দুটি ড্রাম ফুটো হবে, বাকি সব অক্ষত থাকবে, এবং সেগুলো অনায়াসে ভেলাটিকে ভাসিয়ে রাখবে।

আধুনিক জাহাজগুলো এমনি একটি খোলের থাকে না। খোলগুলোতে অনেক পার্টিশন করে খোঁপ তৈরি করা হয়। কোনো একটি-দুটি ফুটো হলেও অন্য খোপে পানি যেতে পারে না।

একটি সুপার ট্যাংকারে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০-৩২টি আলাদা খোপ বা ট্যাংক থাকে। ফলে এরকম ৫-৬টি ফুটো হলেও জাহাজ ভেসে থাকবে।

টাইটানিক ১৬টি খাড়া দেয়াল বা জাহাজের ভাষায় বাল্কহেড দিয়ে বিভক্ত ছিল। এর ডিজাইন এভাবে করা হয়েছিল যাতে চারটি খোপে পানি ঢুকলেও সে ডুববে না।

টাইটানিক এ যুগের মত ওয়েল্ডিং করে বানানো হয়নি, কারন তখনও ওয়েলডিং প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়নি। বানানো হয়েছিল রিভেটিং করে, অনেকটা কাঠের বদলে লোহার তক্তা একটার পর একটা সাজিয়ে পেরেক দিয়ে জোড়া দেবার মত। এজন্য এর শক্তিও ছিল খুব কম, তাই সহজে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, এবং সংঘর্ষে ৬টি খোপে পানি ঢুকে যায়। তারপরেও জাহাজ ভেসে থাকতে পারত কিন্তু টাইটানিকে শুধু ওয়াটারটাইট দেয়াল বা বাল্কহেড ছিল, সম্পূর্ণ ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট বা ট্যাংক ছিল না। ফলে পানি এক প্রকোষ্ঠে ভরতে ভরতে দেয়ালের উচ্চতা অতিক্রম করে পাশের প্রকোষ্ঠে চলে গেছে। ফলে দু ঘন্টা চল্লিশ মিনিটে পুরো জাহাজটিই ডুবে যায়।

১৯১২ সালে টাইটানিক ডুবার পর সবার টনক নড়ে। ১৯১৪ সালে সাগরে জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক নতুন নীতিমালা তৈরী হয় যা SOLAS (Safety of life at sea) নামে পরিচিত। এরপর প্রত্যেক যাত্রীর জন্য লাইফবোট সিটসহ শিপ কনস্ট্রাকশনের অনেক নতুন বাধ্যতামূলক নীতিমালা তৈরী হতে থাকে যা এখনও প্রতিনিয়ত পরিশুদ্ধ হচ্ছে।

টাইটানিকের গল্প টানার কারণ হলো বর্তমানে সাগরে চলার জন্য একটি জাহাজকে কীভাবে নিরাপদ করা হয় তা বোঝানোর জন্য। বর্তমানে পৃথিবীতে ছোট বড় মিলিয়ে কয়েক লাখ সমূদ্রগামী জাহাজ ও ফিশিং ট্রলার রয়েছে।

পৃথিবীতে সারা বছর জাহাজডুবিতে সাগরে যতজন নাবিকের মৃত্যু হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি ৩০ মিনিটে তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।

হ্যা, মাত্র আধঘণ্টায় সাগরের এক বছরের চেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়।

তারপর সাগরে একটি জাহাজকে মুখোমুখি হতে হয় তিন চার তলা বিল্ডিং এর মত উঁচু ঢেউ, শত কিলোমিটার গতির ঝড়, ডুবো পাথর, আরেক জাহাজের সাথে সংঘর্ষের মত অনেক প্রতিকুলতার।

কিন্তু নদীতে কিংবা নোঙরে, শান্ত সমুদ্রে কি একটি জাহাজ ডুবে যেতে পারে? প্রায় অসম্ভব একটি ব্যপার, ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে নদীর মধ্য, কোন কিছুর সাথে সংঘর্ষ না ঘটিয়ে আমাদের শাহ আমানত কিভাবে ডুবে গেল?

আরও পড়তে পারেন-

কেন ঘটেছে মিডিয়াতে তার কোনো বিস্তারিত কিংবা প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট চোখে পড়েনি। টিভির টক-শোতে বেশ কয়েকজন দায়িত্ববান ব্যক্তির বিজ্ঞ আলোচনা শুনলাম। কার দায়িত্ব, কে দায়ী এসব নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি ছিল, কিন্তু ডোবার নিদৃষ্ট কারণ নিয়ে কেউ কিছু বলল না, কারণ সেরকম কোন পেশাদার সেখানে ছিল না।

ব্যাপারটি অনেকটা এরকম যে একজন লোক হাসপাতালে মারা গেলেন। কীভাবে মারা গেলেন সে আলোচনায় সবাই ছিল, শুধু কোনো ডাক্তার ছিল না।

মিডিয়া রিপোর্ট এবং টক-শো ঘেঁটে টুকরো টুকরো যেসব তথ্য পেলাম, তা হলো ফেরিটি ৪২ বছর পুরনো এবং ফেরিটির নিয়ম মাফিক সার্ভে হয়নি।

সাধারণ একটি জাহাজ ৩০-৪০ বছর টিকতে পারে, কিন্তু তার চিকিৎসা করতে হয়। একজন যুবক হয়তো বছরে একবারও চেক-আপের জন্য যায় না। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে চেক-আপও ঘন ঘন করতে হয়। সেরকম জাহাজও নতুন অবস্থায় পাঁচ বছর পর একবার ডকে ওঠালেও চলে। কিন্তু ১০ বছর পর প্রতি পাঁচ বছরে দুবার পুরো ড্রাই ডকে উঠিয়ে আগাপাশতলা পরীক্ষা করতে হয়। ১৫-২০ বছর পর ড্রাই ডকে উঠিয়ে পরীক্ষা আরও সূক্ষ্মভাবে করা হয়। আল্ট্রাসনিক মেশিনের মাধ্যমে লোহার প্লেট গুলি পরীক্ষা করতে হয় তার পুরুত্ব নিশ্চিত করার জন্য। অনেক স্টিল প্লেট পাল্টে ফেলতে হয়।

এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, যদি নতুন কোনো রেগুলেশন আসে, তাহলে জাহাজটিকে নতুন নীতি মান অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০ সালের নীতিমালায় হয়তো ছিল জাহাজের হালে (মানে খোল বা ডেকের নিচের অংশ) হয়তো ৪টি ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট থাকলেই চলত। কিন্তু ২০০০ সালে নতুন নিয়ম এলো যে কম্পার্টমেন্ট ৮টি থাকতে হবে। তখন জাহাজটিকে চালাতে হলে ডকে উঠিয়ে সে অনুযায়ী নুতন কম্পার্টমেন্ট বানাতে হবে।

শাহ আমানতের ব্যাপারে কী হয়েছিল বা নতুন কোনো নীতিমালা প্রযোজ্য ছিল কি না জানার উপায় নেই, কারণ ফেরিটির নিয়মিত সার্ভে হয়নি।

খোলে প্রকোষ্ঠ থাকলে একটি ফেরি এভাবে কখনোই ডুবতে পারে না। যদি একটি দুটি কম্পার্টমেন্ট ফুটো হয়ে যেত, তার পরেও সে ভেসে থাকত, হয়তো সামান্য কাত হতো।

যেভাবে দ্রুত ফেরিটি উল্টে গেল, তাতে মনে হয় হালের ভেতরের বিরাট অংশে পানি ঢুকে গিয়েছিল, মানে যেসব পার্টিশন ওয়াল ছিল, সেগুলো পানিরোধক ছিল না।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উন্মাদনায় ফেরি ডুবির ঘটনাটি মিডিয়া এটেনশন পায়নি। ১৭টি ট্রাকের বদলে যদি ১৭টি বাস থাকতো, তাহলে পরিস্থিতি কী হতো তা একবার ভেবে দেখা উচিত।

ফেরিতে বাসযাত্রীদের অনেকেই বাসে বসে ঘুমায়, অনেক নারী ও শিশু থাকে। এমন একটি ফেরি ডুবে গেলে ১০০-২০০ লোকের প্রাণহানিও কোনো অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।

যেসব পুরনো নৌযান চলছে, সবগুলোই ভালোভাবে পরীক্ষা করে চলাচল উপযোগী করা উচিত।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।