Home ফিকহ ও মাসায়েল কথিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কি নবীপ্রেমের নিদর্শন, ইসলাম কি বলে?

কথিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কি নবীপ্রেমের নিদর্শন, ইসলাম কি বলে?

।। মুফতি হুমায়ুন কবির ।।

[শুক্রবার (২২ অক্টোবর) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র কেন্দ্রীয় মসজিদ জামে বায়তুল কারীমে জামিয়ার উস্তাদ মুফতি হুমায়ূন কবির উখিয়াভী (হাফি.) “কথিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কি নবী প্রেমের নিদর্শন, ইসলাম কি বলে?” শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। বয়ানের সারসংক্ষেপ পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো]

“আল্লাহ তাআ’লা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-

قل ان کنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم

“হে নবী! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা (সত্যিই) আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমার (মুহাম্মাদ এর ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাঙ্ক অনুসরণ-অনুকরণ কর। তখন আল্লাহ তাআলা ও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন, এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। এবং আল্লাহ মহাক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (আলে ইমরান, ৩২)।

মক্কার কাফের, মুশরিক, মদিনার ইয়াহুদ- খ্রিষ্টান প্রায় সকলেই আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করত, এবং আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করত। অথচ তারা ইসলাম গ্রহণ করত না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইত্তেবা করত না। তাই আল্লাহ তাআ’লা তাদের এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল আল্লাহ প্রেমের দাবিদারদে! লক্ষ করে বলেন। শুধু শুধু তোমরা আমাকে ভালবাসার দাবি করলে হবেনা, বরং আমারও তোমাদেরকে ভালবাসতে হবে। তখন তোমাদের ভালবাসার দাবি কাজে আসবে। আর আমি তোমাদেরকে ভালোবাসার জন্য মাত্র একটিই শর্ত বা কন্ডিশন রয়েছে। আর তা হচ্ছে-তোমরা আমার হাবীব-মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর পদাঙ্ক অনুসরণ-অনুকরণ করো। তখন আমিও তোমাদেরকে ভালোবাসবো। এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিব। কারণ, দাবি সবাই করতে পারে। প্রমান ব্যতীত তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। বরং তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।

প্রকারান্তরে যদি কেউ আল্লাহকে ভালবাসে অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশ মান্য করবেই। অর্থাৎ রাসুলের ইত্তিবা, অনুসরণ করবেই। আর ইত্তেবা করলেই ভালোবাসার দাবি সত্য প্রমাণিত হবে। অনুসরণ অর্থ ঈমান গ্রহণ করতে হবে, ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর জীবনকে প্রত্যেক ক্ষেত্রে তার সুন্নাহ মতে পরিচালনা করতে হবে। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণে সাথে সাথে তাকেও আল্লাহর পরে সর্বোচ্চ ভালবাসতে হবে। তাই কোরআন সুন্নাহ দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বাত- ভালোবাসা ও তাঁর সুন্নাহর যথার্থ অনুসরণ-অনুকরণ ঈমানের অঙ্গ, এবং সকল মুসলমানের জন্য অপরিহার্য বিষয়। আবার প্রত্যেকটা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভালোবাসা অনুসরণ-অনুকরণ বিহীন অর্থহীন। অনুসরণ-অনুকরণ ভালবাসা বিহীন নিষ্প্রাণ। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকটার বিষয়ই গুরুত্ত আরোপ করেছেন।

قال رسول الله ﷺ لايؤمن احد كم حتى يكون هواه تبعا لما جنت به

“তোমাদের মধ্য কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের চাহিদা আমার আনীত দ্বীন ও শরীয়ত এবং সুন্নাহর অনুসরণ কারী হবে” (তিরমিজি আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) ।

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس اجمعين

তোমাদের মধ্যে থেকে কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তাদের নিকট পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সকল মানুষ অপেক্ষা প্রিয় হব”। (বুখারী, আবু হুরাইরা রা:, ৮৯)।

বলাবাহুল্য, আল্লাহর নবীর সাহাবায়ে কেরাম হল আল্লাহর নবী (স.) এর অনুসরণ অনুকরণ ও তার প্রতি ভালোবাসার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাদের অপেক্ষা কারো নবীপ্রেমের দাবী বানোয়াট ও মিথ্যা।

অথচ কোন সাহাবী, নবী প্রেমের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিবস পালন করেন নাই। না মহানবী সা. কোন নবীর জন্ম দিবস পালন করেছেন, না স্বীয় জন্মদিবস পালন করেছেন, না নির্দেশ দিয়েছেন, না খোলাফাযে রাশেদীন তথা চার খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু হযরত ওসমান গনি রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবী করিম সা. এর জন্ম দিবস পালন করেছেন। না চার ইমাম হযরত ইমামে আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহি, হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহ আলাইহি হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহ আলাইহি,হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এ জন্ম দিবস পালন করেছেন। না তরিকতের চার ইমাম হযরত ইমামে রাব্বানী মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী, হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দী,হযরত শেখ শাহাবুদ্দিন ছুহারওয়ার্দি এ জন্মদিবস পালন করেছেন। না হাদিসের চার ইমাম, ইমাম বোখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজি, ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুমুল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিবস পালন করেছেন। না এ যাবৎকাল পর্যন্ত অন্য কোন ইমাম এ জন্মদিবস পালন করেছেন বা অন্য কারো জন্ম দিবস পালন করেছেন। অতএব এটা নিরেট নতুন আবিষ্কার ও শরীয়তের পরিভাষায় গর্হিত বিদ’আত বৈকি। তা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।

আরও পড়তে পারেন-

হ্যাঁ, এ বিদ’আত আবিষ্কার করেছেন ৬০৪ হিজরী সনে একজন অপব্যয় কারি বাদশা মোজাফফরুদ্দীন কউকরী, সমর্থন দিয়েছেন দুনিয়া লোভী এর নামকা আলেম আবুল খাত্তাব ওমর বিন দেহ্যা, তার সাথে জশনে জুলুস যোগ করেছেন ভারতের ব্রিটিশ আমলে মাওলানা আব্দুল মজিদ ও হাজী এনায়েতুল্লাহ লাহোরী। তার উপর ঈদ ও সকল ঈদের সেরা ঈদ যোগ করেছেন পাকিস্তান থেকে আগমনকারী এক নামধারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম। তাই তার এক সঠিক উত্তরসূরি জশনে জুলুসের ছদারত করেন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন। যার চেহারায় সুন্নত পরিমাণ এক মুষ্টি দাড়ী পর্যন্ত নেই। কেবল দৈহিক জন্মের আনন্দ-উৎসব করলে আশেকে রাসুল হওয়া যায় না, বরং অন্তরের প্রকৃত ভালোবাসা ও অনুসরণ-অনুকরণ এর মাধ্যমে প্রকাশ করলে প্রকৃত সুন্নী বা আশেকে রাসূল হওয়া যায়। তবে অবশ্যই জন্মদিবস বা অন্য কোনো দিন তারিখ নির্ধারণ করা ব্যতীত নবী করিম সাঃ এর জীবনের যেকোনো দিক সঠিকভাবে আলোচনা করা অনেক বড় বরকতময় ও সওয়াবের কাজ, যা বিভিন্নভাবে চৌদ্দশ বছর যাবৎ হয়েছে, এখনো হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও ইনশাল্লাহ হবে।

কারণ, ইসলামে জন্মদিবস, মৃত্যু দিবস পালনের কোন ভিত্তি বা বিধান নেই। প্রকাশ থাকে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নিয়েও বিস্তর মতনৈক্য রয়েছে। মাস নিয়ে যেমন রবিউল আউয়াল, রবিউল আখের, সফর, রজব, তারিখ নিয়ে যথা- ২,৩,৭, ৮,৯,১২ ইত্যাদি একাধিক মতামত রয়েছে। যার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য ও যুক্তিযুক্ত মতামত হল- ৮ বা ৯ এ রবিউল আউয়াল, ১২ রবিউল আউয়াল নয়।

হ্যাঁ, ১২ রবিউল আউয়াল নবী করিম সাঃ এর ওয়াফাত বা মৃত্যু দিবস হওয়াতে কোনো ভিন্নমত নেই। যা ঈদের মাস ও ঈদের দিন নয়, বরং শোকের দিন ও শোকের মাস । অতএব সে মাসে ও সেদিনে জন্মদিনের আনন্দ বা ঈদ উদযাপন করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? মূর্খতা ও শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ নয়তো!

এছাড়া ও যার কোনো ভিত্তিই কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামে নেই তাকে সকল ঈদের সেরা ঈদ দিবস আখ্যা দেওয়া ও পালন করা কত বড় অজ্ঞতা। হ্যাঁ, অবশ্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত বিশ্ব জগতের জন্য রহমত এবং করুণা। যার আনন্দ হবে সবসময়, বহিঃপ্রকাশ হবে তাঁর প্রবর্তিত ইসলাম গ্রহণ ও তার সুন্নাহর যথার্থ অনুকরণ ও অনুসরণের মধ্য দিয়ে। শুধু একদিনের নামকাওয়াস্তে ভালোবাসার স্লোগান ও হালুয়া রুটি দিয়ে নয়।

তাই এই নতুন বিদআতী নিয়ম সকল মুসলমানের জন্য পরিত্যাগ করা জরুরী। দয়াময় আল্লাহ তা’আলা সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

– মুফতি হুমায়ুন কবীর, উস্তাদ- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।