Home ইসলাম আল্লাহকে ভালবাসলে রাসূলের সুন্নাহ মতে নিজের জীবনকে সাজান: মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী

আল্লাহকে ভালবাসলে রাসূলের সুন্নাহ মতে নিজের জীবনকে সাজান: মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী

অলংকরণ- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে আমাদেরকে সফল হতে হলে অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা-বিশ্বাস ও প্রকৃত মুহাব্বত পোষণ করতে হবে এবং রাসূল (সা.)এর অনুসরণ করে সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে। এতেই একজন মুমিনের দুনিয়াবি যিন্দেগীর পাশাপাশি আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনও সফলকাম হবে।

মহান আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালবাসার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেন, আমরা সবাই মুহাব্বত করি রূহকে। কীভাবে রূহকে মুহাব্বত করি, একটা উদাহরণ দেই। যেমন, আমাদের কোন ব্যক্তি অসুস্থ হলে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে যখন জেলা হাসপাতালে নিতে বলা হয়, সেখানে নেয়া হয়। জেলা হাসপাতাল থেকে যদি রাজধানীর নামকরা হাসপাতালে রেফার করা হয়, তখন বিলম্ব না করে রাজধানীর নামকরা হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর যদি বিদেশে নিতে বলা হয়, তখন দেখা গেল বিদেশে চিকিৎসা করতে ২০ লাখ টাকার দরকার হবে। কিন্তু তার সমূদয় সম্পদ মিলে আছে ১৫ লাখ টাকা। তখন সমূদয় সম্পদ বিক্রি করে আরো ৫ লাখ ধার-কর্জ করে সিঙ্গাপুর চিকিৎসা করতে যান। এই যে সব সম্পদ শেষ করে, এমনকি ধারদেনা করে সিঙ্গাপুর চিকিৎসার জন্য গেল, এটা মূলত: এই রূহ বা জানকে রক্ষা করার কারণেই। কবি বলেন-

از محبت دردها صافی شود + از محبت دردها شافی شود

যার উপর মুহাব্বত তৈরি হবে, তাকে রক্ষার জন্য ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হলেও কখনো চিন্তা-ক্লেশ আসবে না, সারা রাত নির্ঘুম কাটাতে হলেও কোন কষ্ট অনুভূত হবে না।

আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেন, আজকে আমরা রিযিকের জন্য, সুখ-শান্তির জন্য সকলে কত দৌড়ঝাপ করছি। কিন্তু এই দৌড়ঝাপের তো দরকার নেই। রিযিকের মালিক তো আল্লাহ। আল্লাহকে বলার মতো বললেই তো রিযিক চলে আসবে। রিযিকের তশতরি তো আমাদের মাথার উপরে। এদিক ওদিক দৌড়ঝাপ করার তো মুমিনের দরকার নাই। আহা, এসব উপদেশ-নসীহতসমূহ আমাদের বুযূর্গ-আকাবিরগণ আগে আমাদেরকে বলতেন। সকলের দিলে তার প্রভাব পড়তো। কিন্তু বুযূর্গগণ সবাই তো চলে গেছেন। ময়দান এখন খালি। আমাদেরকে উপদেশ দেওয়ার, আমাদের আত্মাকে সংশোধন করার মুরুব্বীগণ তো একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তবে কিছু আল্লাহর ওলি এখনো আছেন। নাম বলব না, আপনারা তাদের সন্ধান চাইলে তালাশ করতে থাকুন, পেয়ে যাবেন। কারণ, তাদের নাম প্রচার করলে তারা আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহর ওলিরা সংগোপনে ও নিবৃত্তে থাকেন। নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না।

তিনি বলেন, শুরুতে বলছিলাম আমরা রূহকে মুহাব্বত করি। রূহকে আমরা এত পরিমানে মুহাব্বত করি যে, হাতে একটা ছোট ফোঁড়া উঠল। ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার বলল, এটা তো ফোঁড়া নয়, ক্যান্সার। বাঁচতে হলে তাড়াতাড়ি হাত কেটে ফেলতে হবে। তখন অনায়াসেই হাত কেটে ফেলতে রাজি হয়ে যান। কি কারণে? এই রূহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং এই রূহের প্রতি মুহাব্বতের ফলেই হাত কাটতে রাজি হয়ে যান। কারণ, এই রূহকে দিয়ে আমরা দুনিয়ার সৌন্দর্য দেখি, সুখ অনুভব করি। স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়দের দেখি। যাবতীয় ভোগ-বিলাসিতা অনুভব করি। কিন্তু এই রূহকে আমরা কেউ কখনো দেখেছি? না, আমরা কেউ দেখিনি। অথচ, এই অদেখা রূহের মুহাব্বতে আমরা কত দৌড়ঝাপ ও ত্যাগ স্বীকার করি।

এ পর্যায়ে আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেন, কোন কিছুর প্রতি মুহাব্বত তৈরি হয় ইহসান তথা কোন না কোনভাবে উপকৃত হওয়ার কারণে। যেমন এই ইহসানের কারণে আমাদের গৃহপালিত কুকুরকে পিটুনি দিলেও চলে যায় না। গরুর বাছুর গাভীর দুধ খায় বেঁচে থাকার জন্য। যতদিন গাভীর দুধ খায়, ততদিন বাছুর গাভীর আশপাশেই ঘুরঘুর করে। কেউ বাছুরকে খোঁচা দিলেও বাছুর চিৎকার করে ডাক দিয়ে মা গাভির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে রক্ষার জন্য। মুরগির বাচ্চা হয়, জন্মের সাথে সাথে সেই বাচ্চা টুক টুক করে খাদ্য তালাশ করে। কিন্তু কোন মানব শিশু জন্মের পর খাবার-দাবার কোন কিছুর খবর নাই। মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি কাউকে চিনে না। সকলে তাকে আগলে রেখে যত্ন-আত্তি করে লালন পালন করেন। সন্তানের বয়স যখন দুই বছর হল, তারপর একদিন নানা বাড়ি গেল। সবাইকে একটু একটু চিনতেছে। মা তার জন্য কি করতেছে, তাও বুঝতে শুরু করেছে। মা কাছে নাই, ক্ষুধায় সেই শিশু কেঁদে ওঠল তখন মা মা বলে। বাচ্চার কান্না মায়ের কানে যেতেই মা দৌড়ে আসল। তাহলে বাচ্চা ক্ষুধায় কান্না করে মা মা ডাকল কি জন্য? মায়ের কাছ থেকে দুধ পেয়েছে, ইহসান পেয়েছে, এটা বুঝার পর মায়ের জন্য কাঁদতেছে মায়ের ইহসান পেয়ে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম বলেন, এই যে বাচ্চাকে মা দুধ খাওয়াল সে দুধ বাচ্চার মা তৈরি করে নাই। সেই দুধ তৈরি করেছে আল্লাহ। মা বাচ্চার হাত, পা, মাথা, চোখ, কান, নাক, মুখ, দেহ, শরীর, রূহ; কিছুই তৈরি করতে পারে নাই। এমনকি সে বাচ্চা যে জমিনে থাকে, সে জমিনও মা তৈরি করতে পারে নাই; সব কিছুই তৈরি করেছে আল্লাহ। তাহলে মা শুধু কি করলো? তার বুকে আল্লাহর দেয়া দুধটুকু সন্তানের মুখে তুলে দেয়ার ইহসান করেছে। এই ছোট্ট ইহসানেই বাচ্চা মা মা বলে ডাকছে। কবি বলেন-

باد ما و بود ما از داد توست + هستی ما جمله از ایجاد توست

দুনিয়াতে আমরা এসেছি, থাকছি সবই কার পক্ষ থেকে? আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহর কাছে কোন দরখাস্ত ও আবেদন ছাড়াই তিনি আমাদেরকে সব দিয়েছেন। সন্তানের যতদিন বুঝ হয়নি মা-বাবাকে চিনে না, তখন মা ও বাবার মনে সন্তানের মুহাব্বত তৈরি করে দিলেন আল্লাহ। যখন সন্তানের একটু বুঝ হওয়া শুরু হয়েছে, তখন সন্তানের মনে মা-বাবার প্রতি মুহাব্বত তৈরি করে দিলেন আল্লাহ।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেন, এভাবে আমরা এক সময় বুঝতে পারলাম, এই যে এত ইহসান সবকিছু আসে আল্লাহর কাছ থেকে। আমরা না দেখেই বুঝলাম, আল্লাহ একজন আছেন। সন্তান যেমন বুঝ হতে শুরু হওয়ার পর মা মা করে ডাকে, আমরাও বুঝ শুরু হওয়ার পর আল্লাহ আল্লাহ ডাকা আরম্ভ করলাম। আল্লাহকে তালাশ করতে শুরু করলাম, মক্তবে, ঘরের কোনায়, পাঞ্জেগানায়, জামে মসজিদে। এরপর তালাশ করতে করতে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত গেলাম। বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে তালাশ করতে লাগলাম, সেখানেও আল্লাহর দেখা পেলাম না। অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা তাঁকে পাওয়ার রাস্তা পবিত্র কুরআনের আয়াতে বলে দিয়েছেন-

قُلْ اِنْ کُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْکُمُ اللّٰہُ وَیَغْفِرْلَکُمْ ذُنُوْبَکُمْ وَاللّٰہُ غَفُوْرٌ رَحِیْمٌ۔

আয়াতে আল্লাহ রাসূল (সা.)কে বলেন, আপনি সকলকে জানিয়ে দিন ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সত্যিকারের ভালবাস তবে আমাকে অর্থাৎ- আমি রাসূলকে অনুসরণ কর, আমার তরীক্বা মতো চল, আমার সুন্নাতের অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। তাহলে বুঝা গেল, আল্লাহকে ভালবাসলে এবং আল্লাহকে পেতে চাইলে রাসূল যেভাবে চলেছেন, সেভাবেই চলতে হবে। চেয়ারে বসে বসে নামায পড়লে আল্লাহকে পাওয়া যাবে? ডাক্তার সাহেব বলছেন, তাই চেয়ারে নামায পড়ি। এভাবে অজুহাত খুঁজে খুঁজে ইবাদতে কমি করতে থাকলে আল্লাহকে পাওয়া যাবে?

এ পর্যায়ে আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী একটি কবিতার পক্তি পড়েন-

ملّت عشق از ہمہ ملت جُدا است+  عاشقاں را مذہب و مِلت جُدا است

আশেক-মাশুকের নিয়ম-নীতি আলাদা। দুনিয়াবী নিয়ম-রীতির সাথে সবসময় তাদের নিয়ম-রীতি মিলবে না। ফক্বিহগণ বলবেন, আপনি যখন দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পারতেছেন না, তাহলে কি আর করা, বসে হলেও নামায পড়বেন। এটা জায়েয আছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কদম মুবারক ফুলে গেছে নফল পড়তে পড়তে। আম্মাজান আয়েশা (রাযি.) জিজ্ঞেস করলেন,  আল্লাহ তাআলা তো ইরশাদ করেছেন-

قد غفر الله ما تقدم من ذنبك وما تأخر

আপনার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। তারপরও আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? হযরত (সা.) বললেন, أفلا أكُونُ عَبْدًا شَكُورًا আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাকে ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু আমি কি আল্লাহর শোকরগুজার তথা কৃতজ্ঞভাজন বান্দা হবো না? রাসূলুল্লাহ (সা.)এর তরিক্বা অনুযায়ী চললে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি মুহাব্বত পোষণ করলে, তাহলে দাঁড়িয়ে পড়তে কষ্ট হলেও আপনি চেয়ারে বসে কখনো নামায পড়বেন না। আর এভাবে যখন অন্তরে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ভালবাসা জন্মাবে, সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগী করতে থাকবে, তখন তার কাছ থেকে আর গুনাহর কাজ হবে না।

তিনি বলেন, আল্লাহ এমন বান্দাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, وَیَغْفِرْلَکُمْ ذُنُوْبَکُمْ وَاللّٰہُ غَفُوْرٌ رَحِیْمٌ۔ আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। কারণ, আল্লাহ্‌ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। সহজে বুঝুন, প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হয়ে যেতে পারলে দোষ করলেও কি আর দোষ থাকে? আল্লাহর প্রিয় হয়ে যেতে পারলে গুনাহ করলেও কি আর গুনাহ থাকবে? তিনি সব ক্ষমা করে দিবেন।

আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী বলেন, মনে রাখবেন, ভালবাসা একটি গোপন বিষয়। কারো প্রতি কারো ভালবাসা আছে কি না, অল্প আছে কি বেশী আছে, তা জানার একমাত্র মাপকাঠি হল, অবস্থা ও পারস্পরিক ব্যবহার দেখে অনুমান করা অথবা ভালবাসার চিহ্ন ও লক্ষণাদি দেখে জেনে নেয়া। যারা আল্লাহকে ভালবাসার দাবীদার এবং আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্খী, কুরআনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতি ভালোবাসার মাপকাঠি বলে দিয়েছেন। অর্থাৎ জগতে যদি কেউ আল্লাহর ভালবাসার দাবী করে, তবে মুহাম্মাদ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অনুসরণের কষ্টিপাথরে তা যাচাই করে দেখা অত্যাবশ্যকীয়। এতে আসল ও মেকী ধরা পড়ে যাবে। যার দাবী যতটুকু সত্য হবে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে ততটুকু যত্নবান হবে এবং তার শিক্ষার আলোকে পথের মশালরূপে গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে যার দাবী দুর্বল হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে তার দুর্বলতা সেই পরিমানে পরিলক্ষিত হবে। ভালবাসা অনুসারে মানুষের হাশরও হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা.)এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভালবাসা পোষণ করে চলার ও ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।