Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ভূমিকম্প কেন হয়

ভূমিকম্প কেন হয়

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে গেছে। ঘন ঘন ভূমিকম্পন হচ্ছে। একটার পর একটা ভূ-কম্পন জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের অনেক প্রশ্ন। ভূমিকম্প কী? ভূমিকম্প কেন হয়? ভূমিকম্প থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পেতে পারি ইত্যাদি।

ভূমিকম্প কী

বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার মতে ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ভূমিকম্প কেন হয়

পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে, জলে-স্থলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তা মানুষেরই কৃতকর্মের ফল। আল্লাহপাক মানুষের অবাধ্যতার অনেক কিছুই মাফ করে দেন। তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বেকার অবাধ্য জাতিসমূহকে আল্লøাহপাক গজব দিয়ে ধ্বংস করেছেন। সে সবের অধিকাংশ গজবই ছিল ভূমিকম্প। ভূমিকম্প এমনই একটা দুর্যোগ, যা নিবারণ করার মতো কোন প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। এর পূর্বাভাস পাওয়ার মতো কোন প্রযুক্তিও মানুষ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি। হাদীস শরীফে একাধিকবার বলা হয়েছে, মানুষের দুষ্কর্মের জন্যই ভূমিকম্পের মতো মহাদুর্যোগ নেমে আসে। কুরআন এবং হাদীসে আদ, সামুদ, ক্বওমে লুত এবং আইকার অধিবাসীদের ভূমিকম্পের দ্বারা ধ্বংস করার কাহিনী বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে, কিন্তু তার খিয়ানত করা হবে (অর্থাৎ- যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না), যাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত বিদ্যা অর্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে, কিন্তু তার মায়ের সাথে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদে উচ্চঃস্বরে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি জনগণের নেতা হবে, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হয়ে যাবে, মদ পান করা হবে (বিভিন্ন নামে মদ ছড়িয়ে পড়বে), শেষ বংশের লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দিবে, এমন সময় আসবে, যখন তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে, তখন একটি ভূমিকম্প সেই ভূমিকে তলিয়ে দেবে (ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে বা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে)। (তিরমিযী, হাদীস নং- ১৪৪৭)।

এই হাদীসের মাঝে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জমিনে কখন ভূমিকম্পের আযাব প্রদান করা হয় এবং কেন প্রদান করা হয়।

ভূমিকম্প কিয়ামতের একটি আলামত

হযরত আবুল ইয়ামান (রাহ.) আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ক্বিয়ামত কায়েম হবে না, যে পর্যন্ত না ইল্ম উঠিয়ে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে (হারজ অর্থ খুন-খারাবী) এবং তোমাদের সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, উপচে পড়বে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নাম্বার- ৯৭৯)।

ভূমিকম্প একটি আজাব

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বল, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সর্ম্পূণরূপে সক্ষম। (সূরা আল-আনআম- ৬৫ আয়াত)।

হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) নাযিল হলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, অথবা যখন তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব নাযিল হলো, তখন তিনি (সা.) ইরশাদ করলেন, আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সহীহ বুখারী)।

আরও পড়তে পারেন-

আবুল-শায়খ আল-ইস্পাহানি বলেন, ‘বল, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)’এর ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; এবং ‘তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’-এর ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া।)

ভূমিকম্প বিষয়ে কুরআনুল কারীমের বক্তব্য

ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কুরআনুল কারীমে ‘যিলযাল’ নামে একটি সূরাই নাযিল করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যখন প্রচন্ড কম্পনে যমীন প্রকম্পিত হবে, আর যমীন তার বোঝা বের করে দেবে, আর মানুষ বলবে, ‘এর কী হল?’ সেদিন যমীন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে, যেহেতু তোমার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়ে আসবে, যাতে দেখানো যায় তাদের নিজেদের কৃতকর্ম। অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালোকাজ করলে তা সে দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে। (সূরা আয-যিলযাল, ১-৮)।

ভূমিকম্প বিষয়ে কুরআনুল কারীমে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হল ‘যিলযাল’, যার অর্থ হল একটি বস্তুর নড়াচড়ায় অন্য আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। দ্বিতীয় শব্দটি হল ‘দাক্কা’, এর অর্থ হল, প্রচন্ড কোন শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোন কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া। পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাতত্ত্বকে চ্যুতি বা স্থানান্তরের কারণে। ক্বিয়ামতের দিন আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধূলিকণায় পরিণত হবে এবং তা হবে ফেরেশেতা হযরত ইসরাফিল আলাইহিস সালামের সিঙ্গায় ফুঁৎকারের কারণে, যাকে বলা হয় ‘দাক্কা’ যা হবে এক প্রচন্ড আওয়াজ।

কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতে ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ আছে। যেমন-কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলল; অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল এবং নিজেদের গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল (সূরা আল আনকাবুত- ৩৭)।

“অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছাল, তখন আমি উক্ত জনপদের উপরকে নিচে করে দিলাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে কাঁকর পাথর বর্ষণ করলাম”। (সূরা হুদ- ৮২)।

“অতঃপর আমি জনপদটিকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর কঙ্করের প্রস্থর বর্ষণ করলাম”। (সূরা আল-হিজর, ৭৪)।

“যখন প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে পৃথিবী এবং পর্বতমালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। অতঃপর তা হয়ে যাবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণা”। [সূরা আল-ওয়াক্বিয়া, ৪-৬)।

কুরআনুল কারীমের আরো অসংখ্য আয়াতে ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ রয়েছে।

ভূমিকম্প সৃষ্টিকর্তার আদেশে সংঘটিত হয়

পৃথিবীর শুরু থেকেই আল্লাহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁদের মাধ্যমে তাঁদের সম্প্রদায়কে আদেশ-উপদেশ দিতেন। যারা নবী-রাসূলের বিরুদ্ধে গেছে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে, আল্লøাহ তাদের বিভিন্নভাবে শাস্তি প্রদান করেছেন। বজ্রপাত, প্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, প্রস্তরসহ বায়ু, জীবাণুযুক্ত বায়ু, ভূমিকম্প, মহামারি রোগ, দূর্ভিক্ষসহ অসংখ্য শাস্তির কথা পবিত্র কুরআনে রয়েছে। এছাড়া কাউকে আবার পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। যেমন, বর্তমানে মিশরের জাদুঘরে রক্ষিত ফেরাউন তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

আল্লাহ ফেরাউন ও তার বাহিনীকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এ ব্যাপারে সূরা ইউনূস, সূরা আল আ’রাফ, সূরা ত্বোহাসহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এবং হাদীসে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসব শাস্তি যেমন অপরাধের জন্য সাজা, তেমনি পরবর্তী সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, যাতে তারা সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারে। কুরআন আর হাদীসের ব্যাখ্যামতে পাপাচারের কারণে আল্লাহ কোন জনবসতিতে এ ধরনের শাস্তি প্রদান করে থাকেন। মৃত্যুর পর মানুষের কি শাস্তি হবে বা কিয়ামতের দিন কী ঘটবে, তার সামান্যতম নমুনা আল্লাহ পৃথিবীতে দেখান, যাতে মানুষ ঐ দিন সম্পর্কে অনুমান করতে পারে এবং সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করে। ভূমিকম্প তেমনই একটি ঘটনা। এ ব্যাপারে কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের/জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। [সূরা আলহিজর- ৭৫]

ভূমিকম্প হলে করণীয় কী

যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয়, অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দু’আ করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যগ্রহণ দেখলে বলতেন, যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” (সহীহ বুখারী- ২/৩০ এবং সহীহ মুসলিম- ২/৬২৮)।

ভূমিকম্প থেকে বেঁচে থাকার উপায়

ভূমিকম্প, বজ্রপাত, প্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, প্রস্তরসহ বায়ু, জীবাণুযুক্ত বায়ু, মহামারি রোগ, দুর্ভিক্ষসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে চাইলে প্রথমতঃ সকল প্রকার গোনাহের কাজ থেকে সকল মানুষকে বিরত থাকতে হবে। গণীমতের মালকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করা যাবে না, আমানতের খিয়ানত করা যাবে না, যাকাত আদায়কে আল্লাহর হুকুম মনে করতে হবে, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া যাবে না, মাসজিদকে ইবাদতের স্থান বানাতে হবে, মদ্যপান ও ব্যভিচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সৎ কাজের আদেশ করতে হবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে হবে। আল্লাহর কাছে সর্বদা কৃত গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে আল্লাহর পথে। তবেই হয়তো আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ভূমিকম্পসহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবেন।

লেখক: মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ, টংগী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জামিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।