Home ইতিহাস ও জীবনী প্রখ্যাত আলেম বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া (রাহ.)এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রখ্যাত আলেম বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া (রাহ.)এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

।। মাওলানা নূর হোসাইন (সবুজ) ।।

মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া (রাহ.)ছিলেন এদেশের ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ’র ধর্মীয় নেতা। জমিয়তের তরে নিবেদিতপ্রাণ। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল জমিয়তের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে রেখেছেন গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যখনই ষড়যন্ত্র হয়েছে তখনই মাঠে নেমেছেন। কখনো বাতিল শক্তির সাথে আপোষ করেননি। (১৬ জানুয়ারী) ২০২২ মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই মনীষীর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরছেন ‘ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় [প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নূর হোসাইন সবুজ]’

নাম ও জন্মঃ
নাম- মাওলানা জহিরুল হক, তিনি ভূঁইয়া সাহেব নামে বেশ পরিচিত ছিলেন। পিতা- আব্দুল গালিম ভূঁইয়া, মাতা- মোসাঃ সোনাবানু। তিনি ছিলেন পরিবারের চার ভাই ও তিন বোনের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার শিকারপুর গ্রামের এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গ্রামের সাধারণ কৃষি ও ব্যবসা ছিলো পরিবারের আয়ের উৎস।

শিক্ষাজীবনঃ
গ্রামের প্রাইমারিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চারগাছা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। একদিন ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেন তিনি মাদরাসায় পড়াশোনা করছেন। সেই স্বপ্ন তৎকালীন বুজুর্গ মাওলানা নুরুল হক (রাহ.)এর কাছে ব্যক্ত করলে তিনি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পরামর্শ দেন। সেখান থেকেই মাদরাসায় লেখাপড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ হন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম সায়দাবাদেই মাদরাসা শিক্ষার সূচনা। সেখানে নাহবেমীর পর্যন্ত লেখাপড়া করে পার্শ্ববর্তী জেলা কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম বরুড়া মাদ্রাসায় জালালাইন পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে উম্মুল মাদারিস আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুলউলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় মেশকাত সম্পন্ন করে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। এরপর মুফতী ফয়জুল্লাহ (রাহ.)এর পরামর্শে ১৯৬৬ সালে জামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাক্ষণবাড়ীয়ায় চলে যান। সেখানে ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রাহ.)থেকে বোখারী শরীফের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবনঃ
শিক্ষাসমাপনীর পর আখাউড়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর গ্রামের হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন, নবীনগর থানার কুড়িঘর মসজিদে ইমামতি ও টঙ্গি দারুল উলুমে শিক্ষকতা করেন। অতঃপর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রায় দেড় যুগেরও বেশী সময় শিক্ষকতার দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।

সাভার আল আমীন মাদরাসা ও উত্তরা জামিয়া সোবহানিয়ায় কয়েকবছর শিক্ষকতা করে চলে আসেন সাভারের জামিয়া এমদাদুল উলুম ভাগ্নীবাড়ি মাদ্রাসায়। সেখানে প্রায় বিশ বছরেরও বেশি সময় প্রধান পরিচালক ও শাইখুল হাদীসের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। জীবনের শেষলগ্নে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভাগ্নীবাড়ি মাদরাসার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সাভার দারুল উলুম মাদরাসায় প্রধান মুরুব্বি হিসেবে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন।

এছাড়াও নিয়মিত সম্পাদনা ও লেখালেখির কাজে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন মাসিক ও জাতীয় দৈনিক পত্র- পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতো নিয়মিত। তাঁর লিখিত গ্রন্থের মাঝে ‘নামাজঃ;গুরুত্ব দর্শন ও মাসায়েল’ উল্লেখযোগ্য ।

রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমঃ
স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই তিনি শতবর্ষী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে তিনি গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলের সহ সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

মিরপুর শাহ আলী মাজার কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারী থাকাঅবস্থায় ঐ এলাকায় প্রচলিত বহু অসামাজিক কর্মকাণ্ড রোধে জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাজারের আশপাশের মার্কেট, মসজিদ, জাহানাবাদ, জহুরাবাদ এলাকার উন্নয়ন ও নিজ মাতৃভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

এছাড়াও খতমে নবুওত আন্দোলন, তাহাফফুজে খতমে নবুওত’সহ জাতীয় বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, মাজার পুজা বিরোধী আন্দোলন ও দেশের ঈমান-ইসলাম সংরক্ষণে ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা।

রাজনীতির ময়দানেও ছিলেন বেশ প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের সাথে ছিলো তার হৃদ্যতার সম্পর্ক।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণঃ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্ব-শরীরে অংশগ্রহণ করেন তিনি। পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী নির্মূলে রাখেন অগ্রণী ভুমিকা। (বিস্তারিত জানুন- “আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃষ্ঠা -৪৬৭ )

আধ্যাত্মিকত জীবনঃ
দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে ছিলো তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক। আল্লামা আসআদ মাদানী (রাহ.)এর বাংলাদেশের সার্বক্ষনিক সফরসঙ্গী ছিলেন। কয়েকবছর রমজানে দারুল উলূম দেওবন্দে সুন্নত ইতিকাফ করেছেন এবং আল্লামা আসআদ মাদানী (রাহ.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। দুইবার বায়তুল্লাহ জিয়ারত করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

তিনি ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রাহ.) এর খুবই স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন। আল্লামা আহমদ শফি (রাহ.), আল্লামা আবুল হাসান (রাহ.), আল্লামা সিরাজুল ইসলাম (রাহ.) সহ বহু দেশবরেণ্য আলেমের সান্নিধ্যে গ্রহণ করেন।

আরও পড়তে পারেন-

এছাড়াও মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রাহ.), মাওলানা মহিউদ্দিন খান (রাহ.), শায়খে কাতিয়া (রাহ.), মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী (রাহ.), মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.), মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস (রাহ.) সহ সিলেট ও ঢাকার প্রবীণ উলামায়ে কেরামের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিলো।

ইন্তেকালঃ
জমিয়তের প্রবীণ এই নেতা ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী নিজ বাসভবন সাভার বিরুলিয়া ইউনিয়নের সামাইরে রাত ২:২০ মিনিটে ইহকাল ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় স্ত্রী, এক ছেলে, তিন মেয়ে ও নাতি-নাতনি’সহ অসংখ্য আত্নীয় স্বজন রেখে যান। পরবর্তী দিন ১৭ জানুয়ারী বাদ যোহর সাভার ভাগ্নিবাড়ী মাদরাসায় তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার ইমামতি করেন ভাগ্নিবাড়ী মাদরাসার শায়খুল হাদীস মাওলানা আহমদুল্লাহ কাসেমী।

জানাযায় অংশগ্রহণ করেন- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, সহ সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান, অর্থ সম্পাদক মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা জয়নুল আবেদীন, জামিয়া ছোবহানিয়ার প্রিন্সিপাল মুফতী মহিউদ্দিন মাসুম, বারিধারা মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামীম মাওলানা মাসউদ আহমদ, মুহাদ্দিস মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ, মুফতী জাবের কাসেমী, গুলশান সোসাইটি জামে মসজিদের খতীব মাওলানা মুর্তজা হাসান ফয়েজী মাসুম, সাভারের শীর্ষ আলেম মাওলানা আলী আকবর, মাওলানা আব্দুল্লাহ, মাওলানা আমিনুল ইসলাম কাসেমী, মাওলানা নাজমুল হাসান বিন নুরী প্রমুখ।

তথ্যসূত্র- আহমদ আল আবীর
দৌহিত্র- মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া (রাহ.)।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।