Home ওপিনিয়ন ভারতীয় তরুণরা যেভাবে অনলাইনে ইসলাম ও নারীবিদ্বেষী ঘৃণা ছড়াচ্ছে

ভারতীয় তরুণরা যেভাবে অনলাইনে ইসলাম ও নারীবিদ্বেষী ঘৃণা ছড়াচ্ছে

গত বছর ইদ-উল-ফিতরের উদযাপন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান কতিপয় পাকিস্তানি তরুণী। উৎসবের দিনে সবার মতো তারাও সেজেগুজে ছবি পোস্ট করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু তারা খেয়াল করেন, তাদের অনুমতি ছাড়াই সেসব ছবির স্ক্রিনশট নিয়ে লাইভ স্ট্রিম করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। 

ইউটিউবে এই লাইভস্ট্রিম করেন রিতেশ ঝা ও কেশু নামের দুই ব্যক্তি। হাজার হাজার লোক দেখেন সেই স্ট্রিম। আর এর কমেন্ট বক্স ছেয়ে যায় নারীবিদ্বেষী, ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যে। 

ইউটিউব অবশ্য পরবর্তীতে ভিডিওটি সরিয়ে নেয়। এই ঘৃণার ক্যাম্পেইনের শিকার নারীরা পরবর্তীতে বলেছেন, এই ঘটনায় তারা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের ইদই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। 

এর আট মাস পর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঝা বলেন, অনলাইনে হিন্দু নারীদের ফটোশপ করা কিছু ছবি দেখেই প্রতিশোধ হিসেবে এই কাজ করেছিলেন তিনি। তিনি জানান, সেসব ছবি দেখে ঘৃণায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। 

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপির সমালোচনা করা নারীদের অনলাইনে নির্বিকারভাবে ট্রল করা গত কয়েক বছরে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। শুধু বিজেপি-বিরোধীরা না, আরও অনেক নারীই লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন একটি অনলাইন গোষ্ঠীর ঘৃণা ক্যাম্পেইনের। 

ভারতের সব রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের সমর্থকদের বিরুদ্ধেই অনলাইনে নারীদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তির বিস্তার উগ্র ডানপন্থী তরুণ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অনেক বেশি উৎসাহিত করেছে।

সেই ইউটিউব লাইভস্ট্রিমের মতো নারীদের হেনস্থা করার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। একটি অ্যাপে মুসলিম নারীদের নিলামে তোলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই না, মোদিবিরোধী হিন্দু নারীদের নিয়েও এরকম নিলামের আয়োজন করেছে একটি অ্যাপ। 

আরও পড়তে পারেন-

তীব্র জনরোষের মধ্যে পুলিশ এই দুই অ্যাপের সঙ্গে জড়িত নয়জনকে গ্রেপ্তার করে, যাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৬-এর মধ্যে। তাদের বেশিরভাগই মুসলিমবিরোধী পোস্ট করা হয় এমন ফেসবুক গ্রুপগুলোতে সক্রিয় ছিলেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাংবাদিক এবং লেখক স্নিগ্ধা পুনম বলেন, “আমি বলব, এর পিছনে দায়ী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে মৌলবাদের বিস্তার । এসব গোঁড়ামি হিন্দু সমাজের গভীর থেকে আসছে।”

উগ্র ডানপন্থীদের ইকোসিস্টেম 

ডিলিট করে দেওয়ার আগে রিতেশের ইউটিউব চ্যানেলে হাজার হাজার ফলোয়ার ছিল। 

সেখানে ইসলামি রীতিনীতি নিয়ে বলা আপত্তিকর কথাবার্তাকে তিনি “ডার্ক হিউমার” বলে চালিয়ে দিতেন। নারীদের ছবি দিয়ে করা লাইভস্ট্রিমিংকে বলতেন “স্বাভাবিক টিকটক বা ইন্সটা ভিডিও”। 

ঝা প্রথম স্মার্টফোন পেয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সে। তিনি জানান, এই স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ডানপন্থী জগতের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। 

তিনি বলেন, “আমি সেখানে মিম দেখতাম, রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা শুনতাম। তারা প্রতি মুহূর্তে বলতেন, হিন্দুরা বিপদে আছে।”

মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা এসব উগ্রবাদী রাজনৈতিক বক্তব্য শুনে ধীরে ধীরে নিজেও একজন উগ্রপন্থী হয়ে উঠেন ঝা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন অনেক তরুণই এভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। 

একাধিক গবেষণা বলছে, এই মহামারীর সময়ে মৌলবাদের বিস্তার প্রকট রূপ ধারণ করেছে। কারণ এ সময়ে মানুষ অনলাইনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছে।  

ভারতের ডানপন্থীরাও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডানপন্থী গোষ্ঠী এখন “ট্র্যাড” এবং “রাইতা” নামের দুটি দলে ভাগ হয়ে গেছে। ট্র্যাড, বা ঐতিহ্যবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ উগ্র। তারা বিশ্বাস করে, বিজেপিও যথেষ্ট ডানপন্থী নয়। 

তারা তাদের ডানপন্থী সমালোচকদের ডাকে “রাইতা” বলে। হিন্দি বাগধারা “রাইতা ফাইলানা” থেকে আসা এই শব্দের অর্থ যারা সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। 

রাইতারা বলে থাকেন, তারা সহিংসতা ছাড়া মতামত প্রকাশ করার পক্ষে। 

ট্র্যাড: ডানের চেয়েও ডান 

টুইটারে ‘এইচআর’ নামে পরিচিত এক দলিত তরুণ ঘটনাক্রমে ট্র্যাডদের জগতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পূর্বে একসময় অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত দলিতরা হিন্দু বর্ণপ্রথার সবার নিচে অবস্থান করে। 

২০২০ সালের মার্চ মাসে এইচআরকে একটি ইন্সটাগ্রাম গ্রুপে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গ্রুপে বলা হয়, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, “হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সত্য তথ্য প্রচার করা”। গ্রুপের কর্তারা এইচআরকে জানান, অনলাইনে মুসলমানদের বিপক্ষে তার তর্ক করার দক্ষতা দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছেন।

তাকে বলা হয়, এই গ্রুপের জন্য আরও ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের যোগাড় করতে। 

এইচআর জানান, এই গ্রুপে যুক্ত হয়ে প্রথমে খুবই ভালো লাগছিল তার। কারণ নিজের ধর্ম নিয়ে তিনি বেশ গর্বিত। কিন্তু দ্রুতই গ্রুপের সদস্যদের গোঁড়ামি দেখে ভুল ভাঙে তার। তিনি দেখতে পান, শুধু মুসলমান না, দলিতদের ব্যাপারেও তীব্র ঘৃণা পোষণ করে গ্রুপের সদস্যরা। 

এইচআর বলেন, “তারা বিশ্বাস করে যে দলিতরা হিন্দু না। এবং একটি হিন্দু ভারত গড়তে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করাটাও ভুল কাজ না। এমনকি এই স্বার্থে শিশুদের খুন করাটাও ন্যায্য।” 

গ্রুপে কখনোই নিজের বর্ণ পরিচয় দেননি এইচআর। ছয় মাস পর গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে আসেন তিনি। 

দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, যে ব্যক্তি সেই নিলাম অ্যাপ তৈরি করেছিল সেও একটি ট্র্যাড গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। 

গভীর বিভাজন

নিজেকে রাইতা হিসেবে পরিচিতি দেওয়া মোনা শর্মা জানান, তিনি এবং অন্যান্য ডানপন্থী নারীরাও অনলাইনে ট্র্যাডদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। শর্মা বলেন, “ট্র্যাডদের কাছে কোনো শিক্ষিত মহিলাই যথেষ্ট হিন্দু না।” 

ট্র্যাডরা অনলাইনে তার উপর আক্রমণ চালিয়েছে এবং তার স্বামীর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে বলেও জানান তিনি। 

শর্মা আরও বলেন, তিনি নিজেও উদারপন্থীদের ট্রল করেন এবং তাদের পক্ষ থেকেও ট্রলের শিকার হন। কিন্তু সেগুলোকে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন না তিনি। 

এই নিবিষ্ট ইকোসিস্টেম সম্বন্ধে পুলিশের ধারণা খুবই কম। 

মুম্বাই পুলিশের সিনিয়র অফিসার ব্রিজেশ সিং বলেন, “বিদেশী কোম্পানির মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোর লক্ষ লক্ষ অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ এবং ট্র্যাক করার সামর্থ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নেই।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ঘৃণার চেয়েও প্রকট। 

লেখক-সাংবাদিক স্নিগ্ধা পুনম বিশ্বাস করেন, হিন্দুদের এই মৌলবাদ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য একটি অশনি সংকেত। 

“আমি খেয়াল করেছি, সাধারণ ভারতীয়রা এখন ঘনঘন পাকিস্তানকে উদাহরণ হিসেবে টানে। তারা চায় ভারতও পাকিস্তানকে অনুসরণ করুক,” বলেন পুনম। 

“হিন্দুদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে, ভারত শুধু হিন্দুদের। এবং এখন তারা নির্দ্বিধায় এসব কথা বলে বেড়ায়।” 

রিতেশ বিবিসির কাছে স্বীকার করেন, তার কাজগুলো “নৈতিকভাবে ভুল” ছিল। তিনি আরও বলেন, তার মতো ছেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। 

“আমরা বুঝতে পারি না ঘৃণা কীভাবে আমাদের মনে শেকড় গেড়ে নেয়। যারা ঘৃণার এজেন্ডা চালাচ্ছে তারা ব্যতীত ঘৃণা কারোর জন্যই উপকার বয়ে আনে না।”

সূত্র: বিবিসি। 

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।