Home ইতিহাস ও জীবনী ১৯২২ সালের ২৩ মার্চ সংঘটিত ঐতিহাসিক কানাইঘাট লড়াইয়ের ১০০ বছর

১৯২২ সালের ২৩ মার্চ সংঘটিত ঐতিহাসিক কানাইঘাট লড়াইয়ের ১০০ বছর

।। শাহিদ হাতিমী ।।

সংগ্রাম বা লড়াই মানুষের মজ্জাগত একটি বিষয়। কেউ লড়ে নিজের জন্য কেউ অন্যের জন্য। কেউবা লড়াই করে দেশ জাতি ধর্ম ও ইসলামের জন্য। পৃথিবীর দেশে দেশে, নানান জনপদে প্রতিদিনই অসংখ্য ছোটো বড় ঘটনা, দূর্ঘটনা বা লড়াই হয়। সবগুলো কী আর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায়? ইতিহাসে স্থান পাওয়া তো বহুত দূর কি বাত। তবুও কিছু লড়াই বা সংগ্রামের কথা লিখতে হয়, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। তেমনি এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের নাম ‘কানাইঘাটের লড়াই’। ধর্মীয় তাহজিব রক্ষার আন্দোলনে সেদিন ৬জন মানুষ বৃটিশের পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। একবছর-দু‘বছর, একযুগ-দুইযুগ করে করে কানাইঘাট লড়াইয়ের ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে।

বিশ্বের আনাচে-কানাচে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বহুল পরিচিত । কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন কতো কঠিন তা ইতিহাসের পাঠক বলতেই বোধগম্য। আর স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে আরো কঠিন তা রক্ষা করা। একটি দেশের জন্ম হটাৎ করে হয়না। বিশ্বের মানচিত্রে দীর্ঘ ইতিহাস, সংগ্রাম, শাসন, শোষণ, অত্যাচার প্রভৃতির সংযোজন-বিভাজনে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে একটি দেশের আর্বিভাব ঘটে । বাংলাদেশ এক সময় ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। স্বতন্ত্র শাসক-ব্যবস্থা থাকলেও সবাইকে চেয়ে থাকতে হত দিল্লীর মসনদের দিকে। অনেকে আবার দিল্লীর শাসন মেনে নিতে না পারার জন্য যুদ্ধে হেরে গিয়ে পলায়ন বা মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ যুদ্ধ করে করেই টিকে থেকেছেন।

অনেকগুলো রাজ্যের মত বর্তমান সিলেটের প্রান্তিক জনপদ (কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সদর উপজেলার অধিকাংশসহ আসামের গোভা ও ডিমারূয়া অঞ্চলজুড়ে) জৈন্তা। আত্মসচেতনতার অভাব আর বহিরাগত কূটকৌশলের কাছে পরাজিত এখানকার সহজ-সরল অধিবাসীরা যদিও আজ তাচ্ছিল্যের পাত্ররূপে পরিচিত অনেকের কাছে। কিন্তু সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পদানত তখনও জৈন্তিয়া রাজ্যই ছিল স্বাধীন রাজ্য । বাংলাদেশ স্বাধীনের স্বপ্নও যখন কেউ দেখেনি সেই ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার প্রতীকরূপে স্বাধীন জৈন্তা রাজ্যে ‘সিংহচিহ্ন সম্বলিত’ পতাকা উড়তো পতপত করে। আর এ রাজ্যের অধিবাসীরাই বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে ঘোষণা করতে পারত যে, আমরা স্বাধীন। প্রাচীন গ্রন্থাধিতে সিলেটের গৌড় ও লাউড়কে পাত্তা না দিলেও জৈন্তারাজ্য কৌরবদের সাম্রাজ্যভক্ত হয় এবং পান্ডব অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ার গৌরব লাভ করে। হিন্দুদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে সিলেটের লাউড় ও গৌড় রাজ্যের উল্লেখ না থাকলেও প্রতিটি গ্রন্থে জৈন্তিয়া বা জয়ন্তার কথা উল্লেখ আছে। প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে লিখিত জৈমিনি মহাভারতে জৈন্তিয়া রাজ্যের অধিশ্বরী বীর রমণীর প্রমিলার কথা উল্লেখ করা আছে। এছাড়াও মন্ত্রচুড়ামণি, তন্ত্রচুড়ামণি, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতি পৌরাণিক গ্রন্থে জৈন্তিয়া বা জয়ন্তার নাম উল্লেখ হয়েছে সম্মানের সাথে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত আলেমদের মাধ্যমে শুরু হয়। ইংরেজদের উপমহাদেশীয় জুলুমের শাসনের বিরুদ্ধে মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভীর ঐতিহাসিক ‘দারুল হারব’ ঘোষনার মধ্য দিয়ে। এরপর ১৮৩১ সালের ৬ মে সংঘটিত ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ মাওলানা সৈয়দ আহমাদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদের নেতৃত্বে রচিত হয় বালাকোটের রণাঙ্গন। বৃটিশ-বিদেশী বেনিয়াদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য উপমহাদেশের বুকে পরিচালিত সর্বপ্রথম সুসংঘবদ্ধ রণডঙ্কা। ১৮৫৭ সালে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সিপাহী বিপ্লব এবং হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী, মাওলানা কাসেম নানুতবী ও মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহীর নেতৃত্বে সুচিত হয় শামেলীর ময়দান। ১৯১৪ সালে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর নেতৃত্বে হয় তাহরীকে রেশমি রুমাল। রেশমি রুমাল আন্দোলনে ব্যত্যয় ঘটলে আলেমসমাজের নেতৃত্বেই চলে খেলাফত আন্দোলনের নামে অসহযোগ লড়াই। সেই লড়াইয়ের প্রভাব পড়ে উদৃত জৈন্তারাজ্যে।

আজ থেকে একশত বছর আগে। ১৯২২ সালে ২৩শে মার্চ, জৈন্তারাজ্যের কানাইঘাট বাজার সংলগ্ন মাদরাসা মাঠে যথানিয়মে আয়োজন করা হয় ওয়াজ মাহফিলের। কিন্তু আচমকাই ইংরেজ প্রশাসন বাধা দিয়ে বসে মাহফিলে। ইসলামের অমিয় বাণী শুনতে তবুও ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে ধর্মপ্রাণ তৌহিদী জনতা। লোক সমাগম ঠেকাতে না পেরে কোনোপ্রকার আইনি অজুহাত ছাড়াই স্থানীয় বৃটিশ প্রশাসন হঠাৎ জারি করে ১৪৪ধারা। এতে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন অগত মুসল্লীরা। সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ৬জন মানুষ। কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয়- রক্তক্ষয়ী সেই কানাইঘাট লড়াইয়ের কথা ইতিহাসের বইগুলোতে নেই বললেই চলে।

আরও পড়তে পারেন-

১৯৪৭ সালে ইংরেজদের শাষণ থেকে শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী, মাওলানা যুফর আহমাদ উসমানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে মুক্তিলাভ হয়। এরপর শহীদ জব্বার, রফিক, সালাম ও বরকতের নেতৃত্বে চলে ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে পরাধীনতা, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের অনেক বছর। বীর বাঙালির হৃদয়ে ভাষা আন্দোলনসহ ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজকের বাংলাদেশ সেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশীরা পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত দেশ ও পতাকা। বস্তুত এ দেশে তথা উপমহাদেশের আলেমসমাজ আযাদী আন্দোলনে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং প্রায় দু‘শবছর ধরে যেভাবে এই সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছিলেন, তা সত্যিই অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। ১৮৫৭ সালের জাতীয় অভ্যুত্থানের পর এক বিস্ময়কর ও বড় ট্রাজেডি হচ্ছে কানাইঘাটের লড়াই। ১৯২২ সালের ২৩ মার্চ কানাইঘাট মাদরাসার জলসায় (ইসলামি মহাসম্মেলন) ব্রিটিশের পেঠুয়া বাহিনীর সাথে যে সংঘর্ষ হয়েছিল ইতিহাসের পাতায় তা “কানাইঘাটের লড়াই” হিসেবে সুপরিচিত৷

সেই যুদ্ধে তথা কানাইঘাট লড়াইয়ে শাহাদতবরণ করেন কানাইঘাট উপজেলার বায়মপুর গ্রামের মাওলানা আব্দুস সালাম, কানাইঘাট উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের মৌলভী মুসা মিয়া, কানাইঘাট উপজেলার উজানিপাড়া গ্রামের হাজি আজিজুর রহমান, কানাইঘাট উপজেলার সরদারিপাড়া গ্রামের মৌলভী জহুর আলী, কানাইঘাট উপজেলার নিজ বাউরবাগ গ্রামের আব্দুল মাজিদ, কানাইঘাট উপজেলার ছোটদেশ চটিগ্রামের মুহাম্মদ ইয়াসিন মিয়া প্রমুখ। অত্যন্ত আফসোসের বিষয় ইতিহাসের পাতায় এই ছয়জন মহাবীর শহীদের নাম ছাড়া আর কোনো তথ্যের উল্লেখ কিংবা জীবনবৃত্যান্ত বিষয়ক কোনো উদৃতি পাওয়া যায়নি। যাঁরা আহত হয়েছিলেন তাদেরও সমৃদ্ধ কোনো ফিরিস্তি নেই। অথচ তখন এই ৬জন শহীদ হওয়ার খবরে সারাদেশে ইংরেজবিরোধী ঘৃণার বন্য বয়েছিল। ৬ শহীদের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানরা জালেম ইংরেজদের নিন্দা জানিয়েছিল।

বালাকোটের পর মাওলানা সৈয়দ আহমদ শহীদ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে, সিতানা নামক স্থানে। বস্তুত পাক-ভারত উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনের ইতিহাসে সিতানার কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে, কেননা এই অজপাড়া গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই বৃটিশের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। একইভাবে এদেশে ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষায় মাওলানা মুশাহিদ বায়মপুরীর স্মৃতিতধন্য কানইঘাটে সংঘটিত ঐতিহাসিক “কানাইঘাটের লড়াইটি” বোদ্ধামহলে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা জৈন্তারাজ্যের ঐতিহাসিক “কানাইঘাট লড়াইটি” নিসন্দেহে ইসলামের পক্ষে ছিল। এখনও কানাইঘাট মাদরাসার জলছা বা দারুল উলূম কানাইঘাটের মাহফিলের কথা শুনলে স্বাধীনচেতা ঈমানী মন শিহরিত হয়। প্রজন্মরা এই বলে অনুপ্রেরণা লাভ করে যে, আমরা এ দেশে ইসলাম রক্ষার আন্দোলনের সম্ভবত প্রথম সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধের এলাকার সন্তান। বৃটিশ প্রশাসনের অন্যায় নির্দেশের প্রতিবাদ এবং ইসলামের জন্য বিলিয়ে দেয়া কানাইঘাটের ৬ মনীষী একসাগর লাল খুন আমাদেও অনুপ্রেরণার অনুসঙ্গ। আমরা ঐতিহাসিক “কানাইঘাটের লড়াইয়ে” প্রাণ উৎস্বর্গকারী ছয় শহীদকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধার সাথে। মহান আল্লাহ তাঁদেরকে ভালোবাসুন।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক- শায়খুল ইসলাম জামেয়া, সিলেট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।