Home শিক্ষা ও সাহিত্য ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বয়ানে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন যা বলেছেন

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বয়ানে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন যা বলেছেন

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ (১৪৪৩-৪৪হিঃ)এর ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন শিক্ষাবর্ষের সবকদান শুরু হবে।

সোমবার (৯ মে) জামিয়ার বায়তুল কারীম জামে মসজিদে নতুন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সহকারী পরিচালক আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন।

বক্তব্যে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও খ্যাতিমান দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান একটি মকবুল ইদারা। এই মকবুল ইদারায় আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে ভর্তি হওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। মকবুল ইদারায় পড়াশোনার বরকতে মানুষও মকবুল হওয়ার সুযোগ লাভ করে। যেমন মকীনের দ্বারা মাকানের দাম, মাকানের দ্বারা মকীনের দাম। যেমন বায়তুল্লাহ শরীফের ইমামের দাম। ৫/১০ মাইল হেঁটেও মানুষ তাঁকে দেখতে যান। বায়তুল্লাহ শরীফের পূর্ব পাশে একটা ঘর আছে, সেটা সবাই দেখতে যায়। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর জন্মস্থান হিসেবে এই জায়গা দামি হয়েছে। তদ্রূপ মকবুল ইদারায় লেখাপড়ার কারণে আপনারাও মকবুল হবেন, এটাই আমরা আশা করতে চাই।

তিনি বলেন, এই মকবুল ইদারা আমাদের আকাবির হযরতগণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চারজন প্রতিষ্ঠাতা হযরত- (১) মাওলানা হাবিবুল্লাহ কুরাইশি রহ. (২) মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী রহ. (৩) মাওলানা সুফি আজিজুর রহমান রহ. এবং (৪) মাওলানা আব্দুল হামিদ রহ.। এছাড়া এই মকবুল ইদারার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জগদ্বিখ্যাত বুযূর্গ কুতুবুল আলম মাওলানা জমিরুদ্দিন আহমদ রহ.। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনায় আরো ছিলেন মুফতিয়ে আযম ফয়যুল্লাহ রহ., মুফতিয়ে আযম আহমাদুল হক রহ., মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রহ., মাওলানা হামেদ রহ. মাওলানা আহমদ শফী রহ. প্রমুখ বাযূর্গ হযরাতগণ।

দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষা ভবন। ছবি- উম্মাহ।

তিনি বলেন, এই মকবুল ইদারার মুহাদ্দিসে কেরামের মধ্যে ছিলেন মাওলানা সৈয়দ আহমদ বড় মুহাদ্দিস রহ., মাওলানা ইয়াকুব রহ., মাওলানা ইবরাহীম বলিয়াভী রহ., মাওলানা আবদুল কাইয়্যুম রহ., মাওলানা আবদুল আযীয রহ., মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী রহ. প্রমুখ।

এ পর্যায়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, এজন্য এই মকবুল দ্বীনি ইদারায় আপনারা ভর্তি হতে পেরেছেন; এ জন্য মহান আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করবেন। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের সকল নিয়ম-কানুন যাতে যথাযথভাবে মেনে চলে উত্তমভাবে পড়াশোনা করতে পারেন এবং কোনরূপ আইনলঙ্ঘন করে যাতে বহিষ্কৃত হতে না হয়, সে জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে দোয়া করবেন।

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْوَهَّابُ

হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদের পথ দেখানোর পর আমাদের হৃদয়কে বিচ্যুত করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের উপর রহমত ও করুণা বর্ষণ করুন। কারণ, আপনিই মহাদাতা।

اللهم ارزقنا علما نافعا ورزقا واسعا وقلبا خاشعا وعملا متقبلا وشفاء من كل من كل داء

অর্থাৎ- হে আল্লাহ, আমাদেরকে উপকারী জ্ঞান, প্রশস্ত রিযিক, নম্র হৃদয়, গ্রহণযোগ্য আমল এবং সকল রোগ থেকে নিরাময় দান করুন।

আরো দোয়া করবেন- اَللَّھُمَ اھدنَا فِیمَن ھَدَیتَ وَعَافِنَا فِیمَن عَافَیتَ وَتَوَلَنَا فِیمَن تَوَلَّیتَ

অর্থাৎ- হে আল্লাহ, যাদেরকে আপনি হিদায়াত দান করেছেন তাদের সাথে আমাদেরকেও হিদায়াত দান করুন, যাদেরকে আপনি সুস্থ ও নিরাময় দান করেছেন তাদের সাথে আমাদেরকেও সুস্থ ও নিরাময়ে রাখুন এবং যাদের আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের সাথে আমাদেরও দায়িত্ব নিন।

আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, আপনারা মকবুল ও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতে এসেছেন, তাই পড়াশোনার পাশাপাশি আপনাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজ সুন্নাত মোতাবেক করতে সচেষ্ট থাকবেন। বিশেষ করে প্রতিদিন দুই রাকআত সালাতুল হাজাত আদায় করে দোয়াগুলো করবেন। নিয়ম ও শৃঙ্খলার সাথে চলবেন। ভর্তির কাজ শেষ হওয়ার পর সকলে নিয়ম মেনে দরসে হাজির থাকবেন। মাগরীবের পরে সকলে সূরা ওয়াক্বিয়া ও সূরা মুলুক তিলাওয়াত করবেন। সূরা ওয়াকিয়া পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা রিযিকে বরকত দান করবেন। সূরা মুলুক পড়লে আল্লাহ তাআলা কবর আযাব মাফ করবেন।

বায়তুল কারীম জামে মসজিদে নতুনবর্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বয়ান করছেন আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন।

তিনি বলেন, আপনারা দ্বীনের বৃহৎ পরিসরে খেদমত করার মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েই দুনিয়াবী শিক্ষা ও খ্যাতির সম্ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে সফলতা আসতে হলে অবশ্যই আপনাদেরকে পূর্ণ মনোযোগ ও কঠোর অধ্যাবসায়ের সাথে দরসে নিয়মিত হাজির থাকতে হবে এবং সবকের বাইরের সময়ে জরুরি হাজতের কাজ ছাড়া বাকী সময় মনোযোগের সাথে কিতাব মুতালায়া করতে হবে। কিতাবের যে অংশ বুঝবেন না, নিজেদের মেধাবী সাথীদের থেকে জেনে নিবেন। অথবা উস্তাদদের সময় ও সুযোগ বুঝে তাঁদের থেকেও বুঝে নিতে পারবেন।

আরও পড়তে পারেন-

দৈনন্দিন মাসনূন আমলের বর্ণনায় আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, হযরত আবু বকর (রাযি.) যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন হযরত ওচমান গণি (রাযি.) তাঁকে দেখতে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন আপনার কি অসুবিধা? উত্তরে তিনি বললেন, আমার গুনাহ নিয়ে অসুবিধা। তারপর জানতে চাইলেন আপনি কি চাচ্ছেন। বললেন, আমি আল্লাহর রহমত চাচ্ছি। তারপর বললেন, আপনার জন্য একজন চিকিৎসক নিয়ে আসি। উত্তরে বললেন, আমার ডাক্তারই (আল্লাহ) তো আমাকে অসুস্থ করেছেন, আপনি কোন ডাক্তার আনবেন? তারপর বললেন, আপনার জন্য বায়তুল মাল থেকে কিছু বরাদ্দ করে দেই। উত্তর দিলেন, আমার যা আছে তাই যথেষ্ট। অথচ তিনি অভাবের কারণে নিজের জামার বোতাম লাগাতেন কাঁটা দিয়ে। তারপর বললেন, আপনার কাজে না লাগলে আপনার সন্তানদের কাজে আসবে। তিনি উত্তর দিলেন, তাদের কি প্রয়োজন বাকী থাকতে পারে, আমি তো তাদেরকে সূরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করতে বলেছি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত সূরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করবে, তার কোন অভাব-অনটন থাকবে না। সুতরাং আপনারা সবসময় সূরা ওয়াকিয়ার আমল জারি রাখবেন। ভোর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়বেন। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায় করবেন এবং রাতে তাহাজ্জুদ পড়বেন, তাকে আল্লাহ তাআলা মাকামে মাহমূদ দান করবেন।

اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِدُلُوۡکِ الشَّمۡسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیۡلِ وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ ؕ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡهُوۡدًا

অর্থাৎ- সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং ফজরের কুরআন (সালাত)। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (সালাতে ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়।

وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّهَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ

অর্থাৎ- আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন।

তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে গভীর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়ে সকলে দোয়া কবেন। তারপর ফজরের আগে ১-২ ঘণ্টা কিতাব মুতালায়া করবেন। ভোরে ফজর আদায়ের পর সকলে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করবেন। চলাফেরার সকল পর্যায়ে সুন্নাতের পাবন্দীর উপর গুরুত্ব দিয়ে চলবেন। এভাবে যদি মেহনত-সাধনা করে এবং জামিয়ার সকল আইন মেনে নিজেকে আদর্শ ও পরিশুদ্ধতা নিয়ে পরিচালিত করতে পারেন, ইনশাআল্লাহ আপনারা এখান থেকে শিক্ষাউত্তীর্ণ হয়ে কওম-মিল্লাতের যোগ্য রাহবার ও খাদেম হয়ে সম্মান ও শ্রদ্ধার্জনের সাথে ইলমে দ্বীনের প্রচার-প্রসার, দাওয়াত ও তাবলীগসহ দ্বীনের বহুমুখী কাজ আঞ্জাম দিতে পারবেন।

জামিয়ার অভ্যন্তরীণ আইন-কানুনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন বলেন, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিভিন্ন গবেষণা ও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে মোবাইলফোন শিক্ষাজীবনে ছাত্রদের জন্য অনেক ক্ষতিকর বলে প্রামণিত হয়েছে। যে কারণে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ আইনে শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই আপনারা কোনভাবেই মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে মোবাইলফোন ব্যবহার করবেন না। এই আইন আপনাদের কল্যাণের জন্যই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, মোবাইলের কারণে ছাত্রদের শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলা ও আখলাকী জীবনে অনেক ক্ষতি বয়ে আসছে। শুধুমাত্র বাটন মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন আছর থেকে মাগরীব পর্যন্ত এ সময়ে। এ সময়টাতে নিজেদের পরিবারে জরুরী যোগাযোগের কাজ শেষ করবেন। এই সময়ের বাইরে ছোট মোবাইলও ব্যবহার করা যাবে না।

তিনি সতর্ক করে বলেন, স্মার্টফোন কারো কাছে পাওয়া গেলে সেটা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান থেকে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীকে বহিষ্কারযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে। পাঁচওয়াক্ত নামায সকল শিক্ষার্থীকে অবশ্যই জামাতে আদায় করতে হবে। হাট-বাজারে ও রাস্তায় ঘুরাফিরা করবেন না। দরস চলাকালীন কেউ আবাসিক রুমে অবস্থান করবেন না ও দরসে গায়র হাজির থাকবেন না। প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য আইন-কানুন জেনে নিয়ে সেগুলো পুরোপুরি মেনে চলবেন। প্রতিষ্ঠানের উস্তাদগণ কে কোন যিম্মাদারিতে আছে, সেটা জেনে নিবেন। দরসে ও আবাসিক হলে সাথীদের সাথে উত্তম আচরণ করবেন। দেখা-সাক্ষাতে পরস্পর সালাম দিবেন। এতে একের প্রতি অন্যের মুহাব্বত বাড়বে। যে কারো গীবত-শেকায়েতে কখনো জড়াবেন না। সবসময় মনে রাখবেন, পুরো জাতি আপনাদের প্রতি আশাবাদি হয়ে আছেন। সুতরাং নিজেদেরকে জাতির ভবিষ্যত পথপ্রদর্শক ও নেতা হিসেবে মনে করে সেভাবে যোগ্যতা ও আদর্শের সাথে গড়ে ওঠতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন। ইনশাআল্লাহ এসকল নিয়ম মেনে চলতে পারলে আপনাদের সকলের জীবন কামিয়াব হবে বলে জোর আশাবাদি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকলকে সকল নিয়ম মেনে চলার ও সুন্নাতের উপর জীবনকে সাজানোর তাওফীক দান করুন; আমিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।