Home শিক্ষা ও সাহিত্য কবিতার কথা- ৫

কবিতার কথা- ৫

।। মালেকা ফেরদৌস ।।

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে যখন রেনেসাঁ- অর্থাৎ মানব সত্তার দুর্লভ বাসনার উন্মোচন,বিশ্ব জয়ের আকাঙ্খায় মানুষের অভিসার,গীর্জার গতানুগতিক উপাসনা- এবং আধিপত্য থেকে মুক্তিই ছিল মানুষের কাম্য,তারা জ্ঞান ও যুক্তির মাহাত্মকে সমর্থন করেছিলেন।ঠিক তখনি মধ্য এশিয়ার রেনেসাঁ ছিল অন্তর্মুখীন।যেখানে ইউরোপের রেনেসাঁ ছিল বর্হিমুখীন।আমরা কেবল ইউরোপের অহংকারের কথাই বেশি শুনি,তাদের প্রতাপ সর্বত্র নন্দিত।জয়োল্লাস এবং অহংকার যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে,অন্তর্মুখীন সাধনা এবং বিনয় ততটা ব্যাপকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।

ইরান ছিল খোরাসানের অংশ এবং এর বিস্তৃতি ছিল পশ্চিম চীন থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত। এই বিস্তৃত ভূমি অনেক রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ত্রয়োদশ শতকে চেঙ্গিস খান ও পরে তৈমুরের নিষ্ঠুরতার কারণে কোন সুশৃঙ্খল শাসন প্রস্তুত হতে পারেনি। এ ছাড়াও ক্রুসেডের পৈশাচিকতায় একটা অস্থিরভাব থাকলেও ইসলামের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলে একটা আদর্শগত ঐক্য নির্মিত হয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল তৈমুর বংশীয়দের ইসলাম গ্রহণের পর। হিরাতে তৈমুর বংশীয়দের রাজত্বকালে যে চিৎপ্রকর্ষ আবেগ ও জ্ঞানের প্রযুক্তি ঘটেছিল তা ছিল পৃথীবির ইতিহাসে বিস্ময়কর, কালজয়ী, অনন্য সাধারণ।

পবিত্র কুরআনের বাণীর উপর নির্ভরশীলতার ফলে নিহিতার্থ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন জীবিত জীবনের সব অস্তিত্বের। পুরুষ, নারী, বৃক্ষলতা, পুষ্পগুচ্ছ সব সৃষ্টির মধ্যেই বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন আছে। যারা বধির, রুদ্ধবাক তারাই শুধু নিদর্শন দেখে না, কিন্তু জ্ঞানীদের জন্য বিভিন্ন প্রতীকগত ব্যাঞ্জনায় সব কিছুর মধ্যেই সত্যের স্বাক্ষর আছ তা এই সময়াতীতকে চিহ্নিত করেছেন কাব্যে এবং চিত্র কলায়। জালালউদ্দিন রুমী (রহ.) বলেছেন- “যিনি আল্লার সৃষ্টিকে সম্মান করেন, তিনি মহত্বকে অধিকার করেন”।

এ সময় নানা রাজনৈতিক অস্থরতা থাকলেও কাব্য,স্থাপত্য,চিত্রকর্ম এক কথায় সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে ভাব প্রকাশের একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই ঢেউ এসে আঁছড়ে পড়েছিল এই উপমহাদেশেও। সুফিবাদে আত্মার নিগূঢ়তম সত্তায় উপমহাদেশের অনেক লেখকরাই ছিল মুগ্ধ।

সুফিতত্বের বিচারে সব বস্তুর ভেতরেই আত্মার অধিষ্ঠান স্বীকার করা হয়।নিজামীর ‘খামসা’,ফরিদউদ্দীন আত্তারের ‘মানকেতুর তয়ের’, জালালউদ্দীন রুমীর ‘মসনভী’, সাদীর ‘ গুলিস্তা’,ও ‘বোস্তা’, হাফিযের ‘দেওয়ান,জামীর ‘ বাহারিস্তান’, আমীর খসরুর ‘ লায়লা ও মজনু’,সব রচনাতেই আত্মার উপলব্দির পরীক্ষাও পরিচয় সুস্পষ্ট।দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে অদৃশ্য সত্তাকে উপলব্দি করার যে প্রয়াসএবং নিবেদন সুফি কাব্যে বিধৃত।তাঁরা অস্তিত্বের অন্তরঙ্গ গভীরতায় প্রবেশ করেছিলেন এবং ব্রহ্মাণ্ডের সাথে একাত্মতা অর্জন করেছিলেন। এ উপমহাদেশে রুমী যাদেরকে প্রভাবিত করেছিলেন-

শাহ্‌ আব্দুল লতিফ বিহতি,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্দুল হোসাইন যারিঙ্কুব, আব্দুল করিম সরুশ, হোসেন এলাহি গোমশী, স্যার ডক্টর আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, হাফিজ নোয়াব আলী, শায়খুল বাঙ্গাল (রাহ), হোসেইন নাসর। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী কাব্যের আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো রুমীর দ্বারা প্রভাবিত।

বাঙালীদের জন্য গর্বের বিষয় হল, সে সময়কাল বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ কবি হাফিয শিরাজীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি না আসতে পারলেও সে কথা তার কবিতায় লিখে গেছেন।এবং আযম শাহের জন্য একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন।

আরও পড়তে পারেন-

বাংলা ভাষাভাষী কবি সাহিত্যিকদেরও তিনি দারুণভাবে নাড়া দিয়েছেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতো নিজে ১৯৩২ সালে ইরানের শিরাজ নগরে কবির মাজারে উপস্থিত হয়ে ম্রদ্ধা নিবেদন করে এসেছেন। এমনকি কবির পিতা মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির অসম্ভব ভক্ত ছিলেন।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে এই ব্যাপারে লিখেছেন, ‘আমি জানি যে হাফিজের ধর্মীয় দর্শন ও কবিতা আমার পিতাকে যতখানি অভিভূত করত, বৈষ্ণবদের দর্শন ও সঙ্গীত ততখানি করতে পারত না। হাফিজ ছিলেন তাঁর ঐশ্বরিক আনন্দ। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন না। হাফিজের কবিতাই তাঁর সৃষ্টির আকাঙ্খাকে পূরণ করতো। উপনিষদ তার ক্ষুধা নিবারণ করত এবং হাফিজ তাঁর তৃষ্ঞা মিটাত।’ জানা যায় মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরো দিওয়ান মুখস্ত ছিল।

গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ঞচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কান্তিচান্দ্র ঘোষ, হরেন্দ্র নাথ দেব প্রমুখ বিখ্যাত কবিরা কবি হাফিজের বহু রুবাইয়াৎ ও গযল অনুবাদ করেছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাফিজকে এত মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন যে, তাঁর পুত্র বুলবুলের মৃত্যুশয্যায় বসেও তাঁর রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন। তিনি ফার্সী থেকে মোট ৭৩টি রুবাই সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করেন।

তিনি যেদিন অনুবাদ শেষ করেন সেদিন কবি পুত্র বুলবুল ইন্তিকাল করেন। কবি তাই বেদনার সাথে লিখেছেন, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও সবচেয়ে প্রিয় সম্পদকে উপঢৌকন দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাংলাদশে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ইরানের কবি সম্রাট হাফিজ বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিনের আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। কিন্তু তিনি আমার আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে পারতেন না।’

বাংলা ভাষায় দিওয়ানে হাফিজের বহু অনুবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অনুবাদ কর্মটি বাংলা ভাষার এক অসামান্য প্রকাশনা। এ বইয়ের দীর্ঘ উপক্রমিনাতে তিনি হাফিজকে বাংলা ভাষাভাষির কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে কাজী আকরাম হোসেনের অনুবাদটিও চমৎকার। পশ্চিম বাংলার দু’জন আধুনিক কবি যারা প্রগতিবাদি হিসেবেও পরিচিত, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুবাস মুখোপাধ্যায় কবি হাফিজের সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করেছেন।

মহাকবি গ্যেটে বিমুগ্ধ ছিলেন সিরাজী হাফিযে-

“হে হাফিয তোমার বাণী চিরন্তনের মত মহান। কেননা, তার জন্য আদি ও অন্ত নেই। তোমার ভাষা আসমানের গম্বুজের মত একাকী নিজের ওপরই স্থিত। তোমার গজলের অর্ধেকটায় বা প্রথম কলিতে কিংবা অন্য কোন অংশের মধ্যে মোটেও পার্থক্য করা যায় না। কেননা এর সবটাই সৌন্দর্য ও পূর্ণতার নিদর্শন। একদিন যদি পৃথিবীর আয়ূ ফুরিয়ে যায়, হে আসমানী হাফিজ! আমার প্রত্যাশা যে, একমাত্র তোমার সাথে ও তোমার পাশে থাকবো। তোমার সঙ্গে শরাব পান করবো। তোমার মতই প্রেমে আত্মহারা হব। কেননা এটাই আমার জীবনের গৌরব ও বেঁচে থাকার পাথেয়।” (গ্যেটে)। [চলবে]

তথ্যসূত্র: রচনাসমগ্র- সৈয়দ আলী আহসান ও মাহবুবুল আলম, উইকিপিডিয়া (বাংলা)।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

আরো পড়তে পারেন-

কবিতার কথা (১)

কবিতার কথা (২)

কবিতার কথা (৩)

কবিতার কথা (৪)