Home শিক্ষা ও সাহিত্য কবিতার কথা (৪)

কবিতার কথা (৪)

।। মালেকা ফেরদৌস ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

আগের পর্বে আমি স্যুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। আজ এ পরাবাস্তববাদের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।

একটা সময় কাব্য, সাহিত্য, শিল্প, গান শিল্পকলার নান্দনিকতা ও তাত্ত্বিকতায় ব্যাপকভাবে মার্কসের প্রভাব প্রতিফলিত হয়। কার্ল মার্কস ও রুশ বিপ্লবের প্রভাবে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিল্প, সাহিত্যে। মার্কসীয় তত্ত্বে বিশ্বাস ও মানবতাবাদী শিল্পীরা আর্টের চর্চা ও তথা উদ্দেশ্যহীন সাহিত্য চর্চা তত্ত্বের প্রতিবাদ করেন। তারা মনে করেন- সাহিত্য ও শিল্প মানুষের জন্য, মানবজাতির জন্য। তাদের বিশ্বাস মেহনত হতে হবে সব শিল্প- কলার উৎস।
সমারসেট মম তো বলেই ফেললেন- The value of artis not only for beauty but for right action (শুধু সৌন্দর্য সাধন নয়, উদ্দেশ্য সাধনা শিল্পকলার একটি মহৎ উদ্দেশ্য)। নিরন্নক্লিষ্ট মানুষকে উপেক্ষা করে যে সাহিত্য ও শিল্প, তাকে আমি সাহিত্য বলেই স্বীকার করি না।

মূলত এর আগে বিশ্ব কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ আধুনিক ইউরােপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও চিন্তার জগতে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। ইতালিতে গোড়াপত্তন হয় রেনেসাঁ যুগের। মানুষের ভাবনার জগৎ আলোড়িত করেছিল সেটি। গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল রেনেসাঁর ঢেউ। মানুষের চিন্তার কেন্দ্র বিশ্বাসভিত্তিক অপেক্ষা শিল্প সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছিল।

১৯২৪ সালে এই ফ্রান্সের প্যারিস থেকেই আদ্রে ব্রেত্যেঁ শিল্পে এক নতু আন্দোলনের ডাক দিলেন। তার দাবী ছিল- আঠারো ও ঊনিশ শতকে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আধিপত্য করছে তা অতি মাত্রায় যুক্তি নির্ভর। সেখানে তীব্রভাবে অবহেলিত হয়েছে মানুষের ভেতরের অবচেতন সত্তা, মন, চিন্তা, ভাষা। তিনি সুপার রিয়েলিটির কথা ভাবলেন, যা ছিল অভিজ্ঞতাকে যুক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা। স্যুররিয়ালিজমের ধারণা মূলত: এখান থেকেই উৎসারিত।

মালেকা ফেরদৌসের আরো কবিতা পড়তে পারেন-

‘প্রার্থনা’

‘শিরোনামহীন’

আমার বাবা

কড়া নাড়ে কেউ

মায়ের জন্য…

ব্রেতোঁ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বিশেষ করে স্বপ্নের উৎপত্তি নিয়ে ফ্রয়েড অবচেতন মনের যে ধারণার উত্থাপন করেছেন, তা তিনি একজন খাঁটি মার্কসবাদীর মত সামাজিক, যৌক্তিক বেড়াজাল থেকে মনকে মুক্ত করার আন্দোলন শুরু করলেন স্যুররিয়ালিজমের মাধ্যমে।

সাহিত্য, চিত্রশিল্প, সিনেমা, গান, রাজনীতি, দর্শন; এমন কি সমাজ বিজ্ঞানেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। সে সময়ের সব বিখ্যাত শিল্পীরাই ছিলেন এ আন্দোলনে। আন্দ্রে ব্রেতো, জোয়ান মিরো, সালভেদর ডালি, ফ্রিদা কাহলো, রব গনজালভেস। সমসাময়িক যুগের স্যুররিয়ালিজম যাদের শৈল্পিক আঁচড়ে রূপ পেয়েছে এক অনন্য জগত।

আন্দোলনের প্রথম ধাপটি প্রধানত: কাব্য সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফরাসি কবি লুই আপোলীনিয়র প্রথম তার একটা নাটককে পরিচিত করিয়েছিলেন স্যুররিয়ালিস্ত বলে।আমাদের অভিজ্ঞতার প্রকাশটা কিন্তু যুক্তির সাথে উন্মোচিত হয়। সেজন্যই এর মধ্যে ব্যাকরণ থাকে, থাকে শৃঙ্খলা।

অভিজ্ঞতার স্বঃস্ফুর্ত প্রকাশকেই অনেক শিল্পী সাহিত্যিকরা পরাবাস্তববাদ বলে আখ্যায়িত করেন। ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়- আমাদের বিশেষ মুহূর্তের স্বপ্ন দেখা, বিশেষ চিন্তা। ঠিক অন্য মুহূর্তেই আমরা হয়তো অন্য একটি ঘটনার চিন্তা করছি, ঠিক পর মুহূর্তেই অন্য একটি চিন্তা মনকে আক্রমণ করছে। এই তিনটা চিন্তাই যদি একসাথে প্রকাশ করি সেটা কি হয়? এই এককালীনতার বোধ থেকেই পরা বাস্তববাদের সৃষ্টি।

স্বতঃস্ফূর্ততা হচ্ছে একই সাথে সমন্বয়, সব কিছুই এক সাথে প্রকাশিত হয়। ব্রেতোঁর মতে যে বাস্তবতায় স্বপ্নের একটা পরিমন্ডল আছে সে পরিমন্ডলকে একটি দৃশ্যগত রূপ দেয়াই হচ্ছে পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য।

একটা সময় দেখা গেছে- সাহিত্যে, শিল্পে কোন নীতিবোধের বালাই নেই। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিল্প, সাহিত্যর ভেতর একটা নীতি কাজ করছে। বলা হচ্ছে যে, কোন একটা সবল বিশ্বাস মানুষের জীবনে থাকা প্রয়োজন এবং সে বিশ্বাসের দ্বারাই জীবন আলোড়িত হবে, লালিত হবে। পাশ্চাত্য সাহিত্য ও শিল্পের ভেতরেও এ রকম একটা বোধ কাজ করছে ইদানীং। পূর্বের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পরাবাস্তববাদ আন্দোলন এখন আর নেই। যদিও সে সময়ের শিল্পী সাহিত্যিকদের মূল্য রয়েছে। কারণ, তাদের সময়ে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আমেরিকাসহ সারা পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও শিল্পে এখন একটা বিশ্বাসের অহমিকা, আনন্দ যা বাস্তব সত্যকে প্রমাণ করার আকাঙ্ক্ষা দানা বেঁধেছে। তাই যে স্যুররিয়ালিজম এক সময় প্রয়োযজনীয়তা সিদ্ধ করেছিল, বর্তমানে স্যুররিয়ালিজমের সে দায়িত্ব আর নেই। (চলবে)

[তথ্য সুত্র সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ সফিউদ্দিন আহমদ ও কবি মাহফুজউল্লাহ]

– মালেকা ফেরদৌস, কবি, শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক।

আরো পড়তে পারেন-

কবিতার কথা (১)

কবিতার কথা (২)

কবিতার কথা (৩)