Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ একজন ভাসানী’র বড় বেশী প্রয়োজন!

একজন ভাসানী’র বড় বেশী প্রয়োজন!

।। মোহাম্মদ আবদুল গফুর ।।

আজ অনেকের অলক্ষ্যেই চলে গেল এমন এক বিপ্লবী জননেতার মৃত্যুবার্ষিকী, যাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশ ও দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির জন্য যে কোন প্রভাব ও শক্তিশালী জালিমের বিরুদ্ধে নিরাপোষ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া নামের গ্রামে হলেও তিনি প্রধানত আসামের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য উপমহাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অনেকেরই হয়ত জানা নেই, আসামের বনজঙ্গলপূর্ণ বিশাল অনাবাদী এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আবাদ করে মনুষ্যবাসোপযোগী করে তোলেন তারা ছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দরিদ্র কৃষকেরা যাদের অধিকাংশই ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন মুসলমান। পরবর্তীকালে প্রধানত মুসলমান হওয়ার অপরাধে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায় এক শ্রেণীর বিবেকবর্জিত সাম্প্রদায়িক নেতা। এই অপচেষ্টা ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে বঙ্গালখেদা আন্দোলন হিসাবে।

এই বঙ্গালখেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমগ্র আসামে নিপীড়িত মানবতার জননেতা হিসাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণকারী এই সংগ্রামী বীর পুরুষ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হিসাবে। অবশ্য তাঁর নামের সঙ্গে ভাসানী যোগ হওয়ার পেছনে ১৯২৯ সালে আসামে ধুবড়ী জেলার ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন সংগঠনের যোগছিল। এর পূর্বে ১৮৯৭ সালে তিনি তাঁর পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে আসামে গমন করেন।

১৯০৩ সালে তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের জন্য ১৯০৭ সালে তিনি দেওবন্দ যান। সেখানে তিনি দুই বছর অধ্যয়ণ করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদানের মধ্যদিয়ে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।

১৯২৬ সালে তিনি আসামে প্রথম কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারিতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাউরাখোলায়, ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। একই বছরে আসামে কুখ্যাত লাইন প্রথা চালু হয় কৃষকদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে। তিনি লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ. কে ফজলুলহকের সঙ্গে মিলে ঐতিহাসিক লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালে তিনি আসামে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৪৮ সালে তিনি মুক্তিলাভ করায় তদানীন্তন পূর্ব বঙ্গে আগমন করেন। ১৯৪৯ ঢাকায় যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগ গঠিত হয় সেই সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৪৯-৫৭) নির্বাচিত হন। পরবর্তী কালে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী জোরদার করার উদ্দেশে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পূর্বে অবশ্য তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরকারী নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট পালন ও মুক্তিলাভ করেন।

১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং তাঁর নিজের দল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আহ্বায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাথে মিলে যুক্তফ্রণ্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মুসলি লীগকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। এর পর যুক্তফ্রণ্ট পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব বঙ্গে যুক্তফ্রণ্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানী ষ্টকহোমে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বার্লিন যাত্রা করেন। সম্মেলনে যোগদান শেষে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করলে সরকার সামরিক শাসন জারী করে মওলানা ভাসানীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করল তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে বলেও ভীর্বত প্রদর্শন করা হয়। ফলে তিনি ১১ মাস বার্লিন, দিল্লী, কলকাতা প্রভতি স্থানে অবস্থানের পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

এরপর তিনি পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান এবং প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন সরকারের মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি বাতিলের দাবী জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সে দাবী মানতে অস্বীকার করলে তিনি ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে এক সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি আলাদা দল গঠন করেন এবং তার সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর জেনারেল আইউব খান দেশে সামরিক আইন জারী করলে ১২ অক্টোবর (১৯৫৭) মওলানা ভাসানীকে মির্জাপুর হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর দেশে নির্বাচনে তিনি আইউব খানের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমা জিন্নার প্রতি সমর্থন জানান। ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত ৬ দফা দাবীর বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রভৃতি যেসব মামলা দায়ের করে সেসব মামলার সকল আসামীর নি:শর্ত মুক্তি দাবী করেন তিনি। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তিনি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করেন। এছাড়া শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতি তাঁর ছিল আগাগোড়া বলিষ্ঠ সমর্থন।

মওলানা ভাসানীর জীবনে একটা ব্যাপার ছিল লক্ষ্যনীয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করলেও কখনো নিজে ক্ষমতা যাওয়ার চেষ্টা করেননি। অথচ আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য এই যে তারা কখনও নিজ রাজনৈতিক দল বা নিজে ক্ষমতা যাওয়ার কথা ভুলতে রাজী নন। মওলানা ভাসানীর রাজনীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল দরিদ্র জনগণের বিশেষ করে ভুখানাঙ্গা তথা বঞ্চিত মানুষদের প্রয়োজনের কথা কখনও ভুলতেন না।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সহজ সরল অনাড়ম্বন জীবন ধারার অনুসারী। ফলে তার সমর্থকরাও যখন তার আয়োজিত কোন অনুষ্ঠানে আসতেন, তারা সেই অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য নিয়ে আসতেন।

তাঁকে অনেকে সমাজতন্ত্রী বলে মনে করতেন। কিন্তু এটা তাদের ভুল ছিল। তিনি আসলে ছিলেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী। যা বাহ্যত অনেকটা সমাজতন্ত্রের মতো মনে হলেও মূলত তা ছিলো ইসলামের প্রাথমিক যুগের খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আলোকে আলোকিত।

তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। এ ধারণা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের মুখের কিছু কথা বললে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। চীন সফরে গিয়ে তিনি মাও সেতুংক বলেছিলেন মাও, তোমার সহজ সরল গণমুখী আদর্শের আমি ভক্ত। তবে আমার মহাননবীর আদর্শের তুলনায় তুমি কিচ্ছু না। মাও সেতুং তাঁর একথার জবাবে বলেছিলেন, মওলানা, তোমার নবীকে তো তুমি দেখ নাই। এটা হয়ত তোমার অতিভক্তির প্রমাণ। ভাসানী একথার জবাবে বলেছিলেন, দেখ মাও, তোমার এমন অনেক ভক্ত আছে আমাদের দেশে, যারা তোমাকে কখনও দেখেনি অথচ তারা তোমার ভক্ত। তবে তোমার প্রতি তাদের ভক্তিও কি মিথ্যা বলে মনে কর? এই কথার জবাবে মাও সেতুং সম্পূর্ণ চুপ হয়ে যান।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মওলানা ভাসানী ছিলেন এক সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবেই মজলুুম জনগণের নেতা। অন্য নেতারা যেখানে নিজের বা নিজের দলের ক্ষমতার বাইরে কিছু কল্পনা করতে পারেন না। তিনি সেখানে নিজের বা নিজ দলের ক্ষমতার কথা না ভেবে দরিদ্র বঞ্চিত জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেছেন। তাঁর প্রদর্শিত রাজনীতি আমাদের চিন্তাধারায় মূল নিয়ামক হলে এদেশের জনগণের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

যুব সমাজে ভয়াবহ অবক্ষয় এবং আমাদের ভবিষ্যৎ