Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সফর বা ভ্রমণ

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সফর বা ভ্রমণ

।। ডা. তানজিনা রহমান ।।

ছেলেবেলায় ‘মাই হবি’ রচনায় অনেকেই লিখেছি ‘ট্রাভেলিং’। কেউ কেউ বড় হবার পর শখের পাশাপাশি উপার্জনের মাধ্যমও করে নেয় এই ‘ট্রাভেলিং এন্ড ট্যুরিজম’ বা ‘সিয়াহাহ’ কে। যেহেতু ইসলাম মুসলিমদের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, কাজেই ট্রাভেলিং এন্ড ট্যুরিজম এর বিষয়েও কুরআন এবং সুন্নাহ অনুসারে আমাদের গাইড লাইন দেয়া আছে। আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের প্রতিটা কাজের জবাবদিহিতা রয়েছে। লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন কোন কাজে বা স্রেফ আনন্দ করার জন্য সময় নষ্ট করা একজন মুসলিমের জন্য কখনো শোভনীয় নয়। গোড়া থেকে যদি ভাবি, ইসলাম এসেছে যে কোন বিকৃত কন্সেপ্ট বা মানুষের কল্পনা প্রসূত ভুল ধারণাসমূহকে একটি সম্মানজনক চিন্তাধারার সাথে সমন্বয় ঘটাতে।

জাহেলী যুগে এই ট্রাভেলিং ব্যাপারটা এক ধরনের মানসিক এবং শারীরিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সাথেই জড়িত ছিল। সে যুগের কালচার ছিল মানুষকে অপরাধের শাস্তি হিসেবে দূরে কোন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো বা স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য। সিয়াহাহ সম্বন্ধীয় এই নেতিবাচক কনসেপ্টকে ইসলাম নাকচ করে দিয়ে একে আরো উঁচু অবস্থানে নিয়ে গেছে, আমাদের রবের সন্তুষ্টি আছে এমন কিছু কাজের সাথে এর যোগসূত্র ঘটিয়ে।

অন্য সব কিছুর মতোই একজন নন মুসলিম আর একজন মুসলিমের ট্রাভেলিং এর সংজ্ঞা কখনোই এক রকম নয়। আমাদের ঘোরাঘুরি বা ভ্রমণকেও ইবাদতের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। কেননা, আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কেবল ইবাদতের উদ্দেশ্যেই দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা হজ্জ এর মাসগুলোতে হজ্জ এর উদ্দেশ্যে আর সারা বছরই উমরাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর দিকে যাত্রা করাকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ্জ উমরাহ-র উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আনন্দ জড়িয়ে থাকে ইবাদতের সাথে। আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা হজ্জকে উমরাহ ও উমরাহকে হজ্জের অনুগামী করো। (অর্থাৎ হজ্জ করলে উমরাহ ও উমরাহ করলে হজ্জ করো)। কারণ, হজ্জ ও উমরাহ উভয়ই দারিদ্র্য ও পাপরাশিকে সেইরূপ দূরীভূত করে যেরূপ (কামারের) হাপর লোহার ময়লাকে দূরীভূত করে”। (নাসাঈ- তিরমিযী)।

লক্ষ করে দেখুন, হজ্জ এর ট্যুর প্ল্যানে ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যিয়ারাহ থাকে। হজ্জ এর ৫ দিনের আনুষ্ঠানিকতা বাদে হুজ্জাজ বাকী ৩০ বা ৪০ দিন মাসজিদে সালাহ পড়ে, তাওয়াফ করে, অন্যান্য ইবাদত করে, আবার বেড়াতেও যায়। পছন্দের খাবার খায়, অন্যকেও খাওয়ায়, এমনকি মানুষ তার প্রিয়জনের জন্য কেনাকাটাও করে। এটা বৈধ এবং সব কিছুর উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। এ এক সাংঘাতিক আনন্দঘন পরিবেশ।

ভেবে দেখুন, সাধারণ ভ্রমণের উদ্দেশ্য যদি হয় আনন্দ করা, তবে আপনি আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছেন গুনাহ মাফের সুযোগ আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন; এর চাইতে কল্যাণকর এবং আনন্দের ভ্রমণ আর কী হতে পারে। দ্বীনের জ্ঞান আহরণের জন্য দূর দূরান্তে সফর করা যেতে পারে। এই দিক বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ সফর সংঘটিত হয়েছিল ইসলাম শুরুর দিকের সময়গুলোতে। আল বাগদাদী তার একটি বিখ্যাত বইয়ে সে সকল বান্দাদের নাম লিপিবদ্ধ করেছিলেন যারা কেবল একটি হাদীস জানার জন্য দূর দূরান্তে গেছেন। শিক্ষা গ্রহণ বা নিজেকে স্মরণ করানোর উদ্দেশ্যে সে সকল স্থানে যাওয়া বৈধ, যেখানে নবী রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন এবং কেয়ামতকে অস্বীকার করায় তাদের ধ্বংস করা হয়েছিল। “তুমি বল- তোমরা ভূ-পৃষ্ঠ পরিভ্রমণ কর, অতঃপর সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের পরিণাম কী হয়েছে তা গভীর অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করো”। (সূরা আনাম, আয়াত ১১)।

“বল, পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো অপরাধীদের পরিণাম কীরূপ হয়েছে”। (সূরা নামল, আয়াত ৬৯)।

এখানে তাদেরকে বিশেষভাবে উদ্দেশ্য করা হয়েছে যাদের অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে এবং যারা শিক্ষা গ্রহণ করে, বিভিন্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান নিয়ে পড়াশোনা করে এবং শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পর্যবেক্ষণ করে। মুসলিমের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সফর হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর দেয়া জ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। যে জ্ঞান রাসূলের কাছে উন্মুক্ত করা হয়েছিল। নবী, রাসূল এবং তাদের পরে যারা এসেছেন এটা ছিল তাদের মিশন। সবশেষে এই সুবিশাল আসমান জমীন আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টি করেছেন শূন্য থেকে, কী নিদর্শন রেখেছেন বা এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য ভ্রমণ করা যেতে পারে (কাফির দেশ নয়)। এর উদ্দেশ্য, তাদাব্বুরের ফলে যেন তাওহীদের জ্ঞান আরো পরিষ্কার হয়, তাকওয়া বাড়ে এবং এক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আনুগত্যে অন্তর অবনত হয়। তাঁর আদেশ নিষেধের প্রতি শুনলাম এবং মানলাম এই বোধশক্তি জাগ্রত হয়।

আরও পড়তে পারেন-

“বলো- পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো কীভাবে তিনি সৃষ্টি শুরু করেছেন? অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান”। (আনকাবুত, আয়াত ২০)।

এবার আসি আমরা কোথায় যেতে পারব না সে প্রসঙ্গে। ইসলামী শরীয়ায় বেশ কিছু বিধিনিষেধ আছে যা দ্বারা একজন মুসলিমের ভ্রমণ এবং পর্যটন নিয়ন্ত্রিত। উদ্দেশ্য, এর দ্বারা উপরোল্লিখিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় এবং অশ্লীলতা বা অনৈতিক কাজ ছড়িয়ে পড়া থেকে সমাজকে রক্ষা করা যায়। শায়েখ সালিহ আল ফাওজান বলেন, কাফির দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কারণ, এতে কাফিরদের ভেতর থেকে তাদের সাথে মেলামেশার কারণে নিজের ঈমান এবং আদর্শকে ফিতনার সম্মুখীন করা হয়। ধর্মীয় কমিটমেন্ট হুমকির মুখে পড়ে। তবে জরুরত, হালাল চাহিদা এবং উদ্দেশ্য অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈধতা আছে।

যেমন- ১. চিকিৎসা- এমন চিকিৎসা যা নিজ দেশে বা কোন মুসলিম দেশে নেই। ২. শিক্ষা- এমন কিছু যার ব্যবস্থা নিজ দেশে বা কোন মুসলিম দেশে নেই। এই বিষয়টি এত বিষদ যে আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। ৩.ব্যবসা। এসব কারণে স্বল্প বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাফির দেশে অবস্থান করার অনুমতি রয়েছে। তবে শর্ত হলো, ব্যক্তি তার নিজ দ্বীন অনুসারে জীবন যাপন করবে, আল্লাহর দেয়া আদেশ নিষেধ মেনে চলবে। ওই দেশে সে তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য সক্ষমতা থাকতে হবে এবং প্রয়োজন শেষ হওয়া মাত্রই সে মুসলিম দেশে ফিরে আসবে। তিনি বলেন, ¯্রফে বিনোদনের বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে কাফির দেশে ভ্রমণ জায়েয নয়।

কারণ, এর কোন প্রয়োজন একজন মুসলিমের জীবনে নেই এবং এর ভেতর এমন কোন মহৎ স্বার্থ জড়িত নেই যা নিজের ঈমান এবং ধর্মীয় অঙ্গীকার হুমকির মুখে ফেলার অবস্থাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। (আল মুনতাকা মিন ফাতওয়া আল শায়েখ আল ফাওজান)। কোন সন্দেহ নেই, সেসব স্থানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ যেসব স্থানে এমন খাদ্য, পানীয় বা কাজের ব্যাপক প্রচার প্রসার ও প্রচলন আছে, যা আমাদের জন্য হারাম। যেমন বীচ বা এমন কোন জায়গা, যেখানে অনৈতিক কাজ সংঘটিত হয়। কোন বিদআতী অনুষ্ঠানে অংশ নেবার উদ্দেশ্যেও ভ্রমণ করা যাবে না।

সহীহ বুখারী এবং মুসলিমের হাদীসে এসেছে, তিনটি মসজিদ- মসজিদ আল হারাম, রাসূলের মসজিদ এবং মসজিদ আল আকসা ব্যাতীত অন্য কোন মসজিদে ইবাদত বা সাওয়াবের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা জায়েয নয়।

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস আছে। তিনি বলেন, “আমি তুরে গিয়েছিলাম সেখানে দেখা হয় কা’ব আহবারের সাথে। এরপর তিনি একটি বড় হাদীস বর্ণনা করেন। অতঃপর দেখা হয় বাসরাহ ইবনে আবি বাসরাহ এর সাথে, যিনি প্রশ্ন করে জানতে পারেন তিনি সিনাই থেকে এসেছেন। জানার পর তিনি বলেন, “আমি যদি আপনি বের হবার আগে জানতে পারতাম, তবে আপনি সেখানে যেতেন না। আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি, বাহনে চড়া উচিত নয়, তিনটি মসজিদ- মসজিদ আল হারাম, আমার মসজিদ এবং বাইত আল মাকদিস যাবার উদ্দেশ্য ব্যাতীত। [মুয়াত্তা, নাসাঈ হাদিসটি সহিহ বলেছেন]

শরীয়ায় নির্দেশিত নয় এমন কোন জায়গা পবিত্র ভেবে কিছু চাওয়া বা রহমতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হারাম; বিশেষ করে যে জায়গাসমূহে শিরক সংঘটিত হয়। যেমন কোন কবর, মনুমেন্ট বা মাজার। অমুসলিমদের তীর্থস্থান বা তাদের ধর্মে পবিত্র গন্য করা হয় এমন স্থানে ভ্রমণ জায়েয নয়। যেমন- ভ্যাটিকান বা বৌদ্ধ মঠ।

মুসলিম নারী মাহরাম ব্যতীত নিজ শহরের বাইরে বা যার যার এলাকা অনুযায়ী যে দূরত্বকে শহরের ভেতরে বিবেচনা করা হয়, তার বাইরে ভ্রমণ করা জায়েয নয়। অনেক আগে এক প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বের লেকচারে শুনেছিলাম, মুসলিমরা বেড়াতে যাবে মুসলমানদের জায়গায়। মক্কা মদীনায়। সাগর দেখতে ইচ্ছা হলে, জেদ্দায় সাগর আছে, এছাড়া পাহাড়েরও কোন অভাব নেই। বেড়ানো হবে ইবাদতও হবে। আমরা এই কনসেপ্টটাকে কেন যেন গ্রহণ করতে পারি না। মুসলিমদের সর্বাবস্থায় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে, যেন সে নিজে গুনাহ না করে বা তাদের সঙ্গী না হয় যাদের দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য আখিরাতের সফলতা। অন্যদের সাথে আমাদের পার্থক্য এখানেই।

লেখক: কন্সালট্যান্ট, সনোলজিস্ট।
ই-মেইল- dr.tanzina@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।