Home ফিকহ ও মাসায়েল ইসলামী শরীয়তের আলোকে মুসলমানদের জন্য থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন

ইসলামী শরীয়তের আলোকে মুসলমানদের জন্য থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

আর কয়েক দিন পর খ্রিস্টিয় বর্ষ ২০২৩ বিদায় নিয়ে ২০২৪ সালের আগমন ঘটবে। এটাকে উপলক্ষ করে দেশে দেশে এখন বছরকে বিদায় দেয়া এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নানান উৎসব আয়জনের মধ্যদিয়ে পার করেন বিদায় বেলা। তবে থার্টি ফার্স্ট নাইট ও ১লা জানুয়ারি (নববর্ষ) পালন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নয়। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক-এর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।

বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মানুষের দ্বীন হচ্ছে ইসলাম, তাই সংবিধানের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর স্বীকারের প্রেক্ষিতে বিজাতীয় সংস্কৃতি থার্টিফার্স্ট নাইটসহ কোনো ইসলাম বিরোধী কাজ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশের জন্য থার্টিফার্স্ট নাইটসহ সকল ইসলাম বিরোধী কাজ করা একেবারেই উচিত নয়।

ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে তাঁর হাবীব হুজুর পাক (সা.)এর প্রতি ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত, একমাত্র পরিপূর্ণ, সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত, নিয়ামতপূর্ণ, অপরিবর্তনীয় ও মনোনীত দ্বীন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বলবত থাকবে। যে প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা “সূরা আলে ইমরানের” ১৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহ পাক-এর কাছে একমাত্র দ্বীন।”

আল্লাহ তাআলা “সূরা মায়িদার” ৩ নম্বর আয়াতে আরো ইরশাদ করেন, “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে (দ্বীন ইসলামকে) কামিল বা পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত তামাম বা পূর্ণ করে দিলাম এবং আমি তোমাদের দ্বীন ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট রইলাম।”

আল্লাহ তাআলা দ্বীন ইসলামকে শুধুমাত্র পরিপূর্ণ সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ও নিয়ামতপূর্ণ করেই নাযিল করেননি, সঙ্গে সঙ্গে দ্বীন ইসলামকে মনোনীতও করেছেন। তাই দ্বীন ইসলাম ব্যতীত অন্য সমস্ত ধর্ম যা ওহী দ্বারা নাযিল করা হয়েছিল। যেমন, তাওরাত শরীফ, যাবূর শরীফ, ইনজীল শরীফ ও ১০০ খানা ছহীফা এবং মানব রচিত মতবাদ, যা পূর্বে ছিল এবং বর্তমানে যা রয়েছে ও ভবিষ্যতে যা হবে সেগুলোকে তিনি বাতিল ঘোষণা করেছেন।

হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, “হযরত জাবির (রাযি.) রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব (রা.)  রাসূল (সা.)এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (সা.)! আমরা ইহুদীদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি, যাতে আমরা আশ্চর্যবোধ করি, এর কিছু আমরা লিখে রাখবো কি? রাসূল (সা.) বললেন, তোমরাও কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছ? যে রকম ইহুদী-নাছারারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে? অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিষ্কার দ্বীন নিয়ে এসেছি। হযরত মুসা ( আ.)ও যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে উনাকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।” (মুসনাদে আহ্‌মদ, বাইহাক্বী, মিশকাত, মিরকাত)।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করে। ১লা জানুয়ারি পালনের ইতিহাস ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার খৃস্টানদের তথাকথিত ধর্মযাজক, দুশ্চরিত্র (যার বিবাহ বহির্ভূত একটি সন্তান ছিল] পোপ গ্রেগরীর নামানুসারে যে ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। ইরানে নববর্ষ বা নওরোজ শুরু হয় পুরনো বছরের শেষ বুধবার এবং উৎসব চলতে থাকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত।

সাধারণভাবে প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জমশীদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নওরোজের প্রবর্তন করেছিল এবং এ ধারাবাহিকতা এখনো পারস্য তথা ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব পালিত হয়। ইরান হতেই ইহা একটি সাধারণ সংস্কৃতির ধারা বহিয়া মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে।

মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ বা আকিতু শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষূবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ জানুয়ারিতে। ইহুদীদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন গোঁড়া ইহুদীদের মতে সেই মাসের দ্বিতীয় দিন।

মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ, তারা ধারণা করতো, এদিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে।

বাদশাহ আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমীর ফতেহ উল্লাহ্‌ শিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল চালু হয় ১০ মার্চ ১৫৬৩ সালে। ইংরেজ আমলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হলেও রাজস্ব আদায়ে ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা সাল তথা ফসলী সন বেশি ব্যবহার করা হতো।

আরও পড়তে পারেন-

বর্ষবরণের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুভূতি যোগটা সে শুরু থেকেই ছিলো বা বর্ষবরণকারীরা ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকেই তা করতো। অথবা বর্ষবরণকে তাদের বিশেষ ধর্মীয় আচার বলে বিশ্বাস করতো। মজুসী বা অগ্নি উপাসকরা এখনো বর্ষবরণকে সরকারিভাবেও ব্যাপক জাঁকজমকভাবে পালন করে থাকে। একে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করে এবং একে নওরোজ বা নতুন দিন বলে অভিহিত করে।

ফসলী সনের নববর্ষ হিন্দুদের খাছ ধর্মীয় উৎসবের দিন। এর আগের দিন তাদের চৈত্র সংক্রান্তি। আর পহেলা বৈশাখ হলো ঘট পূজার দিন।

আজকে অনেক মুসলমান থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করছে। ইংরেজি নববর্ষ, ফসলী সনের নববর্ষসহ বিভিন্ন নববর্ষ পালন করছে। আর এতে করে তারা বিজাতি ও বিধর্মীদের সাথেই মিল মিশ রাখছে। তাদেরই অনুসরণ অনুকরণ করছে।

পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই সমস্ত প্রাণীর মাঝে আল্লাহ তাআলার নিকট কাফিররাই নিকৃষ্ট, যারা ঈমান আনেনি।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৫৫)। আর নববর্ষ পালনের দ্বারা সে কাফিরদেরই অনুসরণ-অনুকরণ করা হয়।

হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সঙ্গেই হবে।” (সুনানে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)।

ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, সব নববর্ষের প্রবর্তকই বিধর্মীরা। তাই ইসলাম নববর্ষ পালনকে কখনোই স্বীকৃতি দেয় না।

ইংরেজী বর্ষকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে যারা উন্মাতাল হয়ে নগ্ন হয়ে যুবক-যুবতীদের রাজপথে উলঙ্গ নৃত্য করে, এত দাপাদাপি, থাতামাতি করে, তারা কি আহাম্মক, বোকা, মুর্খ? অথচ আক্কেল-বুদ্ধির ভান্ডার নিয়েই তো তারা চলাফেরা করে। তাহলে? কোন যুক্তিতে মুসলমান নামের যুবক-যুবতীরা এমন বেসামাল অনুষ্ঠান করে। কথিত আছে, আহাম্মক, বোকারা হাসে অন্যকে হাসতে দেখে। বস্তুতঃ যারা এই বেহায়াপনায় লিপ্ত হয়, তারা কি ইংরেজী মাস ও বারের ইতিহাস জানে না? নাকি জানা সত্ত্বেও আত্মবিক্রিত চরিত্রের অধিকারী হয়ে পরকীয়া সংস্কৃতির সেবাদাস আর দাসী বনেছে।

ইংরেজরা যদি তাদের বর্ষবরণ করতে গিয়ে উন্মাতাল হয়, তা হতে পারে। কারণ তা তাদের কৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তা আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরিধিভুক্ত নয়। আমাদের দেশের আত্মবিক্রিত সেবাদাস-দাসী আহাম্মকরা যদি এ সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারত, তাহলে নগ্ন নৃত্য করে, মদ্যপ হয়ে নিজের দেহ বিলিয়ে দিত না এবং রাজধানীর বাসিন্দাদের আরামের ঘুমকে হারাম করত না।

একটি জাতির আর্টিলারী ফোর্স-এর প্রাণ শক্তি হচ্ছে যুবক শ্রেণী। তারাই নিজ জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক এবং ভৌগলিক প্রতিরক্ষায় দুর্বার ও দর্জয় যোদ্ধা হিসেবে শত্রুর হামলা থেকে নিজ জাতিকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যেই শক্তি ও অভিব্যক্তি ঘটা উচিৎ ছিল নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি বন্দনা ও বরণে এবং বাস্তবায়নে অনুশীলনে, সে উল্লাস উদ্যোম দেখছি বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির বন্দনা ও জয়গানে। তাই আসুন, ইংরেজী মাস ও বারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি এবং অপ-সংস্কৃতির সেবাদাসে পরিণত হয়ে প্রকৃত পক্ষে দু’কুলই যেন না হারাই। আগামী ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত প্রতিরোধের বুহ্য সৃষ্টি করি এবং সিংহ বিক্রমে হুংকার ছাড়ি যে, এই বর্ষবরণে মুসলমানদের আনন্দ করার মত কিছুই নেই।

দিলের শেষ মিনতি, যদি নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা থেকে থাকে, তবে ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে প্রতিরোধের বুহ্য সৃষ্টি করুন। আল্লাহ্ সবাইকে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: প্রখ্যাত মুবাল্লিগে ইসলাম, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং সহযোগী পরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।