Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মুমিনের ঈমানী দুর্বলতার স্বরূপ

মুমিনের ঈমানী দুর্বলতার স্বরূপ

।। মাওলানা শফিকুল  ইসলাম আমিনী ।।

মহান রাব্বে কারিম মানবজাতির জন্য সবচেয়ে দামি যে নেয়ামত দান করেছেন তা হলো, ঈমান। আপন রহমতে আবেদন ব্যতীতই তা দান করেছেন কিছু মানুষকে। তারাই মুমিন, ঈমানওয়ালা ও হেদায়েতপ্রাপ্ত। ঈমান ও হেদায়েতের জ্যোতিতে তারা বলীয়ান। পরিপূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি সব সময় থাকে পরিতৃপ্ত। আপন মালিকের শোকর গুজাররত এবং ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন। বিপদ-আপদ, রোগ-মুসিবতেও তারা হয়ে থাকেন আল্লাহ তাআলার প্রতি সন্তুষ্ট। পার্থিব সবকিছু আল্লাহর জন্যই সোপর্দ করে দেন। ফলে  আল্লাহর রহমতের ছায়া তাদেরকে সর্বদা ঢেকে রাখে। যতক্ষণ না আখেরাতে তারা জান্নাতে  প্রবেশ করবে।

ঈমানের বিষয়টি অন্তঃকরণের সাথে সম্পৃক্ত। আরবিতে যাকে ‘কলব’ বলে, তাকে পরিবর্তনশীল বলা হয়েছে। যেমন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “আদম সন্তানের অন্তঃকরণ ফুটন্ত পাতিলের চেয়েও দ্রুত পরিবর্তনশীল” অপর বর্ণনায় এসেছে- “ফুটন্ত পাতিলের চেয়েও বেশি পরিবর্তনশীল (মুস্তাদরাকে হাকেম-৩১৪২)। মুসলিম শরীফের বর্ণনায়- “সমস্ত আদম সন্তানের অন্তর আল্লাহ তাআলার দুই আঙ্গুলের মাঝে একটি অন্ত:করণের ন্যায়। তিনি একে যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন”। (সহিহ মুসলিম-২৬৫৪)।

সুতরাং ঈমান যেহেতু অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত, তাই প্রত্যেক মুমিনকে তার অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী অন্তরকে পবিত্র ও কলুষমুক্ত রাখা মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈমানের নূরে উজ্জীবিত করার যে সমস্ত পথ ও পন্থা কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে, তদনুযায়ী নিজেকে চালিত করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে। মুসলিম উম্মাহ ও মুমিনের  ঈমান দুর্বল করা, অন্তরকে রোগাক্রান্ত,  মোহরাঙ্কিত ও কঠোর করার সমস্ত উপায়-উপকরণ এবং পথ ও পাথেয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত, ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাকো এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না”। (সূরা আলে ইমরান, ১০২)।

সত্যিকারার্থে,  ঈমানের হাকীকত কী, এ বিষয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। হযরত সালেহ ইবনে মিসমার ও হযরত জাফর ইবনে বুরকান (রহ.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মালেক ইবনে হারিস (রাযি.)কে প্রশ্ন করলেন, হে হারিস! তুমি কী অবস্থায় আছো ?  তিনি আরজ করলেন, (আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে )আমি ঈমানী অবস্থায় আছি। তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কি সত্যিকার মুমিন? রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (চিন্তা করে বলো ) প্রত্যেক জিনিসের একটি হাকীকত আছে, তোমার ঈমানের হাকীকত (বাস্তবতা) কী ? তুমি কিসের ভিত্তিতে দাবি করছো যে, ‘আমি সত্যিকারের মুমিন’। তিনি আরয করলেন (আমার কথার বাস্তবতা এই যে), আমি আমার অন্তরকে পার্থিব জগত হতে সরিয়ে নিয়েছি, রাতে জেগে থাকি, দিনের বেলায় তৃষ্ণার্ত থাকি (রোযা রাখি), আর যখন আমার রবের আরশকে আনা হবে সেই দৃশ্য যেন আমি দেখতেছি। জান্নাতিদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাতের দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আর দোযখীদের চিৎকার যেন (আমি নিজ কানে) শুনতেছি। অর্থাৎ সর্বদা জান্নাত জাহান্নামের কল্পনা আমার অন্তরে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তার এ কথাবার্তা শুনে) বললেন, হারিস এমন একজন মুমিন যার অন্তর ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে গিয়েছে। (মুসাননাফে আব্দুর রাজ্জাক, বাব উল ঈমান ওয়াল ইসলাম, ১১/১২৯)।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, মুমিনের অন্তর ঈমানের নূরে পরিপূর্ণ আলোকোজ্জ্বল হতে পারে, অপরদিকে পাপ-পঙ্কিলতা, অন্তরের কাঠিন্যতা ও নেক আমলশূন্যতার প্রেক্ষিতে মুমিনের ঈমান মাঝেমধ্যে  দুর্বল হয়ে যেতে পারে। দুর্বল ঈমানের ব্যক্তিটি নিজেও বুঝতে পারে না যে, তার ঈমান অত্যন্ত দুর্বল। অথচ এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ঈমানের দুর্বলতার বিষয়টি যে সমস্ত বিষয় ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বোঝা যায় তা হলো-

(১) পাপ কাজে আনন্দ পাওয়া এবং আকন্ঠ তাতে ডুবে থাকা: যে সমস্ত মুসলমান সব সময় পাপে নিমজ্জিত থেকে তার উপর অটল থাকে,অতঃপর তাতে মজা পেয়ে  যায় ও পাপ কাজ করার সময় আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয় তারাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেমন,হাদিসে বর্ণিত  হয়েছে, “আমার সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হবে। একমাত্র প্রকাশকারী ব্যতীত। প্রকাশকারী হলো সেই ব্যক্তি, যে রাত্রে পাপ করার পরে আল্লাহ তা গোপন রেখেছেন। কিন্তু সকালে সে বলে, হে অমুক, আমি আজ রাতে এমন এমন কাজ করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করল যে, তার রব তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন। আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেলল। (সহীহ বুখারী, ৬০৬৯; ফাতহুল বারী- ১০/৪৮৬)।

(২) ইবাদতে শিথিলতা প্রদর্শন: অর্থাৎ  সঠিক  সময় ও ভালোভাবে ইবাদত না করা। নামাযে অলসতা করা, কুরআন তিলাওয়াত শুদ্ধভাবে না করা। শুধু মুখে বুলি আওড়ানোর মতো দুআ মুখস্ত বলে যাওয়া। যাতে কোনরূপ আবেদন বা  প্রাণ থাকে না। যেদিক  ইশারা করে  মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- “বস্তুত  তারা যখন নামাজে দাড়ায়, তখন দাড়ায় একান্ত  শিথিলতভাবে” (সূরা নিসা- ১৪২)। এসমস্ত মানুষ নেকির কাজে আগ্রহী হয় না। এমনকি  কোন ফরয ইবাদত ছুটে গেলে তাদের মনে আফসোস বা কষ্ট অনুভব হয় না। সুন্নত পালন ও জামাতে নামাজের প্রতি তাদের অনীহা প্রকাশ পায়। এ সমস্ত লোকজনই ক্ষতিগ্রস্ত দুর্বল ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত।

আরও পড়তে পারেন-

(৩) অন্তর কঠিন  হয়ে যাওয়া: যখন কোন মুসলমানের অন্তর কঠিন  হয়ে যায় তখন সমস্ত  আমলে প্রভাব বিস্তার করে। সে নিজেই অনুভব করতে পারে তার অন্তরের কাঠিন্যতাকে। দ্বীনের কোন নসিহত, জান্নাত-জাহান্নাম এর আলোচনায় তার মন গলে না। এমনকি  মৃত্যুর কথায়ও এ ধরনের মানুষের মনে ভয় তৈরি হয় না। মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দাফন এমনকি নিজের হাতে কবরে নামানোর পরও তার মনে ভয়ের উদ্রেক হয় না। তাইতো মহা রবের বাণী-“অতঃপর  তোমাদের  অন্তর এ ঘটনার পর কঠিন হয়ে গেছে। এটি যেনো পাথরের মতো অথবা এর চেয়েও কঠিন”। (সূরা বাকারা-৭৪)।

এজন্যই  বর্তমানে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কবরের নামানোর  সময়, এমনকি মৃত্যু পথযাত্রী এক্সিডেন্টে পতিত রক্তাক্ত মানুষের সাথেও মোবাইলে সেলফি তুলতে ও ভিডিওধারণ করতে দেখা যায় অনেককে!! কতো ভয়ানক রোগ তাদের অন্তরের মাঝে!

(৪) কথা ও কাজে গরমিল থাকা। যে ব্যক্তির কথায় কাজে কোন মিল থাকে না। তাদের ঈমান অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির। এ সমস্ত লোক আল্লাহর কাছে এবং মানুষের কাছেও ঘৃণিত হয়ে থাকে। এটা এক ধরনের মুনাফিকের আলামত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ তোমরা যা করো না, তা কেনো বলো? তোমরা  যা করো না তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক”। (সূরা সফ- ২-৩)। এ ধরনের মানুষ অন্যদের সদোপদেশ দান ও সৎকাজের আদেশ করেন, কিন্তু নিজে তার উপর আমল করে না।

(৫) কৃপণতা: দুর্বল ঈমানওয়ালা ব্যক্তিরা সাধারণত কৃপণ স্বভাবের  হয়ে থাকে। হাদিসে  এসেছে, “কস্মিণকালেও কোন বান্দার অন্তরে কৃপণতা ও ঈমান একত্র হতে পারে না”। (সুনানে নাসায়ী- ৩১১০)।

পবিত্র কুরআনে এসেছে, “যারা কৃপণতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই প্রকৃত সফলকাম”। (সূরা হাশর, আয়াত- ৯)। সুতরাং  কৃপণ স্বভাবের ব্যক্তিরা সমাজ ও অসহায় গরিব-দুঃখীদের কোন উপকারে আসে না। তাই তারা আল্লাহর কাছে চরম ঘৃণিত।

(৬) হারাম ও অশ্লীল কোন কাজ সংঘটিত হতে দেখলেও নিজের  ভেতর কোন ক্রোধ, রাগ-গোসসা তৈরি না হলে: কোন হারাম কাজ হতে দেখলে নিজের ভেতর অস্থিরতা-রাগ তৈরি হওয়া ঈমানী চেতনার দাবি অথচ এ ধরনের ব্যক্তিদের কোন গায়রতবোধ থাকে না। এ সমস্ত রোগাক্রান্ত দুর্বল ঈমানের ব্যক্তিদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মানুষের অন্তরে ফিতনা দানা বাধে। যেমন চাটাই  একটি একটি করে পাতা দিয়ে গাঁথা  হয়ে থাকে। সুতরাং যে অন্তর এগুলো গ্রহণ করবে, তার অন্তরের উপর একটি করে কালো দাগ পড়তে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে,তা আস্তে আস্তে হাঁড়ির কালির মতো অন্ধকার হয়ে যায়। তখন এ অন্তর ভালোকে ভালো বলে চিনে না এবং মন্দকে মন্দ বলে গণ্য করে না। সে মনে যা চায়, তাই করে”। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ১৪৪)।

এ ছাড়াও আরও কিছু আলামত ও আচরণ রয়েছে যেগুলো দুর্বল ঈমানের পরিচয় বহন করে। যেমন- কোনো মুসলমানের বিপদ বা ক্ষতি হতে দেখলে মনে মনে খুশি হওয়া। সন্দেহমূলক কাজকর্মে পতিত হওয়া যা এক সময় হারাম কাজ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মেজাজ খিটখিটে  হওয়া ও অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়া। কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। আল্লাহ তাআলার যিকির করাকে কঠিন মনে হওয়া এবং ছোট ছোট নেক কাজকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। আল্লাহ তাআলা সকল মুমিন বান্দাদেরকে এসকল  রোগ থেকে বেচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।

লেখক: শিক্ষক, জামিয়া দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী, সহকারী সম্পাদক –মাসিক মুঈনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।