Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ শতবর্ষী জামিয়া বাবুনগর ও স্মরণকালের বৃহত্তম দস্তারবন্দী মহাসম্মেলন এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

শতবর্ষী জামিয়া বাবুনগর ও স্মরণকালের বৃহত্তম দস্তারবন্দী মহাসম্মেলন এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

।। মুফতি মুহাম্মদ ওসমান সাদেক ।।

মহান আল্লাহ্ পাকের অশেষ মেহেরবানী ও সর্বস্তরের আলেম উলামা এবং তাওহিদী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সার্বিক সহযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া বাবুনগরের তিনদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক শতবার্ষিকী মহাসম্মেলন অতি সম্প্রতি অত্যন্ত ঝাঁকঝমকপূর্ণ, সুন্দর, সুশৃংখল তথা সুষ্ঠুভাবে লাখো ইসলাম প্রিয় জনতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো। আলহামদুলিল্লাহ্।

দেশ বিদেশের যে সব ইসলামিক স্কলার, মুফতি মুহাদ্দিস ও পীর মাশায়েখের আগমন এবং তাঁদের সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী নসীহত ও মহামূল্যবান দিকনির্দেশনা ঝিমিয়ে পড়া মুসলমানদের ঈমানকে বেগবান করেছে এবং অনেক তাওহীদি জনতার অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়কে করেছে আলোকিত। তাঁদের কয়েকজন হলেন,ভারতের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার শায়খুল হাদীস আল্লামা ডক্টর খালেদ গাজীপুরী নদভী, পাকিস্তানের বেফাক মহাসচিব মাওলানা হানীফ জালন্ধরী, সৌদি আরব উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর আসসাহলি, যাত্রাবাড়ী মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা মাহমুদুল হাসান, দারুল উলুম হাটহাজারীর মুহতামিম আল্লামা ইয়াহিয়া সাহেব, জামিয়া দারুল মাআরিফের পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী, দারুল উলুম হাটহাজারীর শায়খু হাদীস আল্লামা শায়খ আহমদ, মুফতি ও মুহাদ্দিস মুফতি জসীমুদ্দীন, জামিয়া পটিয়ার মুহতামিম আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ, হেফাজত মহাসচিব আল্লামা সাজিদুররহমান, আল্লামা জুনায়েদ আল-হাবীব প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন জামিয়া বাবুনগরের মুহতামিম আমীরে হেফাজত, মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দামাত বরকাতুহুম।

এ সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন মনীষীগণের সারগর্ভ এবং তথ্যসমৃদ্ধ ঈমানদীপ্ত আলোচনায় জামিয়া বাবুনগর তার শত বছরের ইতিহাসে দেশ ও জাতিকে কি উপহার দিয়েছে তা উপস্থিত সবার কাছে সুস্পষ্ট তথা উদ্ভাসিত হয়েছে। সম্মেলনে জামিয়া থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্নকারী হাজার হাজার আলেম উলামা, মুফতি মুহাদ্দিস ও মুফাস্সির এর মাথায় দস্তারে ফজীলত দিয়ে সম্মানিত করে তাদেরকে ইসলামের জন্য আরো বেশি নিবেদিত হবার আহবান জানানো হয়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, জামিয়া বাবুনগরের এ মহাসম্মেলন অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে যিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায় তিনি হলেন- বহুমাত্রিক গুণাবলীসমৃদ্ধ আলেমেদ্বীন, চিন্তাশীল গবেষক, ক্ষুরধার লেখক শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহিমাহুল্লাহর হাতে গড়া প্রিয় শিষ্য,জামিয়া বাবুনগরের সিনিয়র মুহাদ্দিস,
প্রিয় উস্তাদ মুহতারাম শায়খ হারুন আযীযি নদভী হাফিযাহুল্লাহ।

তিনি জামিয়া বাবুনগরের ইতিহাস ঐতিহ্য, পরিচিতি, বিরল বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং তার মিশন ও ভিশনকে বাংলাভাষী ও আরবিভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য পাঠকমহলে সাড়া জাগানো “আলহারুন স্মারক” নামক বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করেন। মানে গুণে নান্দনিকভাবে বইটি রুচিশীল পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে মোটেই কার্পণ্য করেননি।

একটি বই কম্পোজ থেকে নিয়ে প্রিন্টেড হয়ে বাজারে আসা পর্যন্ত কত যে ত্যাগের নযরানা পেশ করতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ জানে না। পরিতাপের বিষয়, আমাদের সমাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু মানুষ এমন আছে, যারা এই কষ্টের মর্যাদা বুঝে না, বুঝতে চেষ্টাও করে না। তাদের কাছে এই কষ্টের কোন মূল্য নেই।

বলা বাহুল্য, শায়খ হারুন আযীযির মতো অষ্টধাতুর মানুষ এই সমাজে খুবই বিরল। সময় থাকতে তাদের মূল্যায়ন করা খুবই প্রয়োজন। তিনি তাঁর রুচিশীল এই চিন্তা চেতনা, ইলম ও সাহিত্য জগতে তাঁর ত্যাগ সাধনা, দক্ষতা ও পারঙ্গমতার এই মহৎ গুণগুলো লাভ করেছেন তাঁর আপন তিনজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বির কাছ থেকে। তাঁদের একজন হলেন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রদূত সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদভী রাহিমাহুল্লাহ। অপর জন হলেন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহিমাহুল্লাহ। তৃতীয় জন হলেন ইসলামি সাহিত্যের দিকপাল আমার প্রিয় আব্বাজান মরহুম মাওলানা হাফেজ আবু জাফর সাদেক রাহিমাহুল্লাহ।

জামিয়া থেকে প্রকাশিত শতবর্ষী স্মারকটি সংশ্লিষ্ট সবার সংগ্রহে থাকা অত্যন্ত জরুরি মনে করছি। কারণ এতে রয়েছে জামিয়া বাবুনগর ও মাশায়েখে বাবুনগরের শত বছরের ইতিহাস।

জামিয়ার একজন নগণ্য ফাজিল হিসেবে আমিও দস্তারে ফজীলত লাভ করলাম এবং সৌভাগ্যবানদের তালিকায় আমার নামও অন্তর্ভুক্ত হল। আলহামদুলিল্লাহ্।

আমার জন্য বর্ণনাতীত সৌভাগ্যের বিষয় হলো; জামিয়া বাবুনগরকে যাঁরা তাঁদের উল্লেখযোগ্য ত্যাগ, মেধা, শ্রম দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, বানীয়ে জামিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত গাঙ্গুহীর রাহ, আজল্লে খলীফা হযরত মাওলানা জমীরুদ্দীন চাটগামীর(রাহ.) সুহবতপ্রাপ্ত আরিফে রব্বানী শাহ মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরীর লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন, সর্বোপরি জামিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যকে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের অন্যতম প্রধান হলেন, দরস জগতের সম্রাট, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আমার প্রিয় মামা ও প্রিয় শায়খ কায়েদে মিল্লাত শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহিমাহুল্লাহ।

তিনি এতগুলো অবদান রেখে মহান প্রভুর ডাকে যদিও এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে আল্লাহ্ তাআলার সান্নিধ্যে চলে গেলেন তারপরও তাঁর সে অবদানের কথা জামিয়ার
কর্তৃপক্ষ মোটেই বিস্মৃত হননি। জামিয়ার সহকারী পরিচালক ওস্তাদ মুহাতারাম হযরত মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী হাফিযাহুল্লাহ ফাজিলীনদের পাগড়ি প্রদানকালে আমাকে ডেকে বললেন, আমার বড় ভাইতো ( আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ.) এই জামিয়ার সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতির জন্য বিশাল ভুমিকা রেখে গেছেন। তাই সংগত কারণে একটি সম্মানজনক পাগড়ি তারও প্রাপ্য। সাথে আমাকে এ কথাও বললেন -“এই পাগড়ি আপনিই গ্রহণ করবেন”।

আরও পড়তে পারেন-

প্রিয় মামা মাওলানা আইয়ুব সাহেবের এমন প্রস্তাবের কথা শুনে আমি যুগপৎ আবেগ ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ি। পরক্ষণেই ভীষণ চিন্তায় ডুবে গেলাম। আর বার বার মনে এ প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছিল, আল্লামা বাবুনগরী রাহিমাহুল্লাহর মতো এত বড় ইলমের পর্বতের পাগড়ি ভার আমার মতো নালায়েকের মাথা কি বহন করতে পারবে? আমি কি এর যথাযথ কদর করার যোগ্য? আমার এরূপ আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে হঠাৎ মাইকে মঞ্চ পরিচালক হযরত মাওলানা মুফতি রহীমুল্লাহ সাহেবের ঘোষণা শুনলাম “এখন মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষ থেকে সম্মাননা পাগড়ি গ্রহণ করবেন উনার সুযোগ্য ভাগিনা মুফতি ওসমান সাদেক হাফিযাহুল্লাহ”।

ঘোষণা শুনে الأمر فوق الأدب হিসাবে কম্পিত শরীরে সামনে এগিয়ে গেলাম। তখন মঞ্চে উপবিষ্ট থেকে দস্তারে ফজীলত দিচ্ছিলেন জামিয়া প্রধান আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দামাত বরকাতুহুম, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ আল্লামা হাফেজ হাবীবুল্লাহ বাবুনগরী, ফকীহুল আসর আল্লামা মুফতি মাহমুদ হাসান, মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী, শায়খ হারুন আযীযি নদভী প্রমুখ।

তাঁরা সবাই মিলে আমাকে দস্তারে ফজীলত দান করলেন। আলহামদুলিল্লাহ্। পাগড়ি মাথায় নিয়ে যখন পিছনের সারিতে বসলাম তখন আমার পুরো শরীর কম্পিত হচ্ছিল। প্রাণপ্রিয় মামার কথা বিশেষভাবে স্মরণে আসায় অশ্রুসিক্ত হলাম। আর তখন বেদনা বিধুর হৃদয়ে ফিরে গেলাম সেই যুগে… যখন তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা ও বিচক্ষণতার সাথে জামিয়ার বার্ষিক মাহফিলগুলো খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করতেন। যার রাজ স্বাক্ষী ছিলেন আমার মতো অনেকেই।

কারা নির্যাতিত আলেম মাওলানা আজীজুল হক ইসলামাবাদী সাহেব তার আলোচনায় কর্তৃপক্ষ দারুল উলুম হাটহাজারীর সাবেক শায়খুল হাদীস, আমীরে হেফাজত আল্লামা বাবুনগরী রাহিমাহুল্লাহকে দস্তারে ফজীলত দ্বারা সম্মানিত করাতে জামিয়া কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে আন্তরিক মুবারকবাদ জানান।

শতাব্দীর ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী, দেওবন্দী চিন্তাধারার সূতিকাগার, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ভাষ্যকার জামিয়া ইসলামিয়া বাবুনগর কর্তৃক অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম এই আন্তর্জাতিক শতবার্ষিকী মহা সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য সবচেয়ে বেশি কুরবানীর নযরানা পেশ করেছেন জামিয়ার প্রবীন নবীন আসাতিযায়ে কেরাম এবং ফাজেলানে জামিয়া।

আমি তাদের সবার প্রতি আন্তরিক মুবারকবাদ জানাই। হৃদয়ের গভীর থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাই এবং মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করি, রাব্বে কারীম সবার এই নজীরবিহীন মেহনতকে কবুল করুন। নাজাতের ওসীলা করুন।

লেখক: উস্তাযুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া বাইতুল কারীম হালিশহর এবং প্রতিষ্ঠতা পরিচালক, মারকাযুর রাশাদ মাদরাসা,হালিশহর, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন