Home ওপিনিয়ন নতুন পাঠ্যবই : একটি পর্যালোচনা

নতুন পাঠ্যবই : একটি পর্যালোচনা

।। অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম ।।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রীকে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার জন্য। বছরের শুরুতেই নতুন বই দেয়ার ঐতিহ্য সৃষ্টির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে মহতী আয়োজন, নিঃসন্দেহে তা চিন্তা ও চেতনার ঐক্য এবং সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। শুরুতেই নতুন বইয়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রীই প্রথম দিনেই গোটা বই পড়ে ফেলে তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের সাথে সাথে অভিভাবকরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এই দিনটির জন্য। এবারও একই আনন্দের চিত্র ছিল। কিন্তু এই আনন্দে বাদ সেধেছে কয়েকটি বিষয়।

জাতিগঠনের মৌলিক উপাদান শিক্ষা। শিক্ষাই শিক্ষার্থীকে পরিচিত করে দেশ ও জাতির ইতিহাসের সাথে, পরিচিত করে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবহের সাথে। লোকাচার, জীবনাচার, ধর্মীয় বিশ্বাস বোধের সাথে আত্তীকরণ ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। দেশপ্রেম, জাতীয় সত্তা, দায়বোধ, কর্তব্য নিষ্ঠা এবং সামনে চলার পথ শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষাই শিশুকে পথ দেখায়। তার মনন তৈরি করে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দায়বোধের শিক্ষা দেয়। এজন্যই ইসলামে শিক্ষাকে আবশ্যকীয় (ফরজ) ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো জাতি বা দেশ নেই যেখানে শিক্ষার মৌলিক নীতিমালায় এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটানো হয়নি। দায়িত্বশীল, যোগ্য, সৎ, চরিত্রবান নাগরিক তৈরির মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে শুধু শিক্ষিতই করে না, মানুষকে সৃষ্টিশীলতা এবং দায়বোধ শেখায়। যে দায়বোধ তাকে দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত্যের পথে, দেশ গড়ার পথে প্রেরণা জোগায়। দায়বোধ, কর্তব্যপরায়ণতা এবং দেশপ্রেমের মৌলিক নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আদর্শিক চেতনা। এ কারণেই শিক্ষার নীতিমালার ভেতর সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির বিশ্বাসবোধের প্রতিফলন থাকে। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনাচার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাসবোধ, মানবিক মূল্যবোধের সমন্বিত প্রতিফলন থাকে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার পাঠ্যসূচি বিন্যাসের দিকে খেয়াল করলে এটা উপলব্ধি করা যায়।

আরও পড়তে পারেন-

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা সমন্বিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষার অভাব লক্ষ্য করেছি। প্রাথমিক শিক্ষা (সরকারি ও বেসরকারি) বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম, মাদরাসা শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই ছিল সমন্বয়হীনতা। এ শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণাহীন এক বিশাল তরুণ সম্প্রদায় যারা নিরাশা এবং হতাশার শিকার। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, দেশীয় সমাজ বিকাশের ধারা এবং তার উত্তরাধিকার সম্পর্কে, বলতে গেলে, তাদের ধারণা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ।

বর্তমান কর্তৃপক্ষ অবশ্যই প্রশংসা ও ধন্যবাদের দাবিদার এ জন্য যে, তারা এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিয়েছেন। একটি সমন্বিত নতুন পাঠ্যসূচির প্রবর্তন করেছেন। এই পাঠ্যসূচি নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, সমালোচনা, পরামর্শের অবতারণা হয়েছে। খোদ জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে সম্মানিত সংসদ সদস্যরা কথা বলেছেন। সংসদের বাইরেও তা নিয়ে এন্তার কথা হয়েছে এবং হচ্ছে বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় বিষয়টি আরো গুরুত্ব পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ব্যাপারে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অভিভাবকদের মনে সৃষ্টি হয়েছে আশঙ্কা। যেসব বিষয়ে কথা উঠেছে সেগুলো কোনোটিকেই ফেলে দেয়া যায় না। অজস্র বানান ভুল, নিম্নমানের কাগজ, ভেতরে ব্যবহৃত ছবি, নিয়ে কথা উঠেছে। পাশাপাশি বাইরের দোকানে উন্নত মানের কাগজে ছাপা বই পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এরপর অভিযোগ উঠেছে ভুল তথ্য পরিবেশনার। সন্নিবেশিত হয়েছে বিতর্কিত ও সংবেদনশীল কিছু বিষয়। অভিযোগ উঠেছে, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সামাজিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ঐতিহ্য, জীবনাচার, রীতিনীতি এবং মৌলিক মানবিক চেতনাবোধকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মাত্রিকতা দেয়ার ব্যাপারে। আমাদের কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের একটি গৌরবময় অবস্থান রয়েছে। এ অবস্থান কোনোভাবেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এ ব্যাপারে সবাইকেই সতর্ক থাকা দরকার। আবহমান কাল থেকেই এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করছে। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে এক সাথে পথ চলেছে। গড়েছে এ দেশের মাটি, সভ্যতা ও জীবনাচারকে। বর্ণিল ও সমৃদ্ধ করেছে এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাকার্যক্রম ও পাঠ্যসূচির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গৌরব। যে কোনো অবস্থায় এই অবস্থান ধরে রাখা দেশপ্রেম ও নাগরিক দায়িত্বের অংশ।

অপর একটি অভিযোগ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তা হচ্ছে কাট পেস্টের ব্যাপারে। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায়, অনৈতিক এবং প্রতারণার শামিল। যারা এসব বই লিখনের এবং সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মাত্রিকতা দেয়ার ব্যাপারে যা নিঃসন্দেহে অজানা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এ ব্যাপারে দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। স্মরণে থাকার কথা, পাকিস্তান সরকার এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও কৃষ্টিকে অস্বীকার করে পাকিস্তান ‘দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি নতুন বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করায় এ দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী এবং অভিভাবকদের ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা বাংলাদেশ আন্দোলনকে বেগবান করতে সহায়তা করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠের চেতনাকে অস্বীকার করা মোটেই সমীচীন হয়নি। এ ব্যাপারে ত্বরিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

মোট কথা, যেসব পাঠ্যবইয়ে ভুল রয়েছে অবিলম্বে সেগুলোকে প্রত্যাহার করে সংশোধিত সংস্করণ ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পৌঁছানো দরকার। যারা এসবের দায়িত্বে ছিলেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। দুটো কারণে। প্রথমত সরকারি তহবিল; যা এ দেশের জনগণের কর থেকে উৎসারিত তার অপব্যবহার, দ্বিতীয়ত ভুল তথ্য সরবরাহ। এটা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে করা প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে ওঠার লক্ষ্যে, অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধে সিক্ত জাতীয় চেতনার মহাসড়কে একীভূত করার প্রয়োজনে এটি দরকার।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ।
Email- shah.b.islam@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।