Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতীয় স্তরে জায়গা করে নিতে দ্বীনের দায়ীদের বিশুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চায় এগিয়ে থাকতে...

জাতীয় স্তরে জায়গা করে নিতে দ্বীনের দায়ীদের বিশুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চায় এগিয়ে থাকতে হবে

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অপার দান। মায়ের ভাষার কথা বলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ ভাষা দিয়ে মানুষ নিজের মনের ভাষা প্রকাশ করে। তাই ইসলামে মুসলমানদের জন্য কুরআন-হাদীস ও জান্নাতের ভাষা আরবীর পর পরই যার যার অঞ্চলের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

মহান আল্লাহ সব নবী-রাসূলকে স্ব-জাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা স্বীয় জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দ্বীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। (সূরা ইবরাহিম, ৪ আয়াত)।

কুরআনে মাজিদের এ আয়াত থেকে ইসলামের আলোকে মুসলমানদের জন্য আরবী ভাষার পরেই মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনের পথে দাওয়াত প্রদাকারীদের জন্য মাতৃভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের নির্দেশনাও পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কুরআনে কারীমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার রবের পথে দাওয়াত দিন কৌশল ও উত্তম ভাষণের মাধ্যমে’। (সূরা নাহল, ১২৫ আয়াত)।

সুতরাং কুরআন-হাদীস তথা ইসলামকে ভালভাবে বুঝার জন্য আরবী ভাষা জানা-বুঝা যেমন জরুরি, তেমনি সর্বসাধারণের মাঝে ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ওপর পারদর্শিতা অর্জনও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচে’ বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী’। রাসূলের এ বাণী থেকে প্রমাণিত হয়; বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করা রাসূল (সা.)এর আদর্শ।

আল্লাহদ্রোহী সম্রাট ফেরআউনকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার লক্ষ্যে হজরত মূসা (আ.) নিজ ভাই হযরত হারুন (আ.)কে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। কারণ, হযরত হারুন (আ.) খুব সুন্দর ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে ও বুঝাতে পারতেন। এ প্রসেঙ্গে কুরআনে কারীমে এসেছে, ‘(হে প্রভু) আমার ভ্রাতা হারুন আমার চেয়ে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন’। (সূরা ক্বাসাস, ৩৪ আয়াত)।

কুরআনে কারীমের বর্ণনা অনুযায়ী ভাষা বৈচিত্র মহান আল্লাহর অনুপম নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’। (সূরা রুম, ২২ আয়াত)।

বর্ণিত এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, স্ব স্ব জাতির জন্য মাতৃভাষাও মহান আল্লাহ পাকের নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। তাই মাতৃভাষা চর্চার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব প্রদানসহ যত্নশীল হওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়ার নির্দেশনায় শামিল।

আরও পড়তে পারেন-

আলহামদুলিল্লাহ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম প্রাচীন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৩৪ইং সন থেকে ‘ইসলাম প্রচার’ নামে বাংলা ভাষায় একটি মাসিক পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। সে সময় চট্টগ্রামে ছাপাখানা না থাকায় সমূদ্র পথে সুদূর রেঙ্গুন থেকে পত্রিকাটি ছাপিয়ে আনা হতো। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এই ‘ইসলাম প্রচার’ নামের পরিবর্তন করে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ নামকরণ করা হয়। যা এ যাবত নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ইসলামের বিধিবিধান, মানবিক, সামাজিক, আর্থিক ও ন্যায়-ইনসাফ এবং নীতি-দর্শনের বাংলা ভাষায় প্রচার-প্রসারে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ইসলামী পত্রিকা হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানালগ্ন থেকেই দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় মাতৃভাষা বাংলার চর্চাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের লিখিত সহস্রাধিক বই রয়েছে বাংলা ভাষায়। এই প্রতিষ্ঠানের ফতোয়া বিভাগে থেকে ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে যেসব ফতোয়া লেখা হয়, তাও প্রধানত বাংলাতেই লেখা হয়। একই বিভাগ থেকে ‘দুরুসুল ফিকহ’ নামে বাংলা ভাষায় গবেষণা স্তরের এক সিরিজ ফতোয়া গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

উম্মুল মাদারিস বা কওমি মাদ্রাসা জননী খ্যাত বাংলাদেশের বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রাথমিক থেকে নিম্নমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ’ নামে স্তানতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পৃথক বিভাগও রয়েছে এখানে। যেখানে ৬ জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাংলা সাহিত্যের উপর স্নাতকোত্তর তরুণ আলেমদেরকে উচ্চতর বাংলা ভাষা পাঠ ও সাহিত্য চর্চার পাঠ দেওয়া হয়।

এছাড়াও লেখালেখির চর্চা এবং আরবী, উর্দু ও ফার্সী থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের উপর প্রশিক্ষণ দিতে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ‘শুবায়ে তাসনিফাত’ বা লেখালেখির চর্চার উপর পৃথক আরো একটি স্নাতকোত্তর বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগের তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষায় সিরিজ ফতোয়া গ্রন্থের প্রকাশ হয়।

অন্যদিকে দেশের হাজার হাজার নূরানী মাদ্রাসায় কোটি শিক্ষার্থীকে বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষাপর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সূরা ও হাদীসের বাংলা অনুবাদ শেখানো হয়। একই সাথে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পঠন ও লিখন সুন্দরভাবে শিখানো হয়। এতে করে নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়া ও বাংলা ভাষা চর্চাকে এগিয়ে নিতে নূরানী মাদ্রাসাসমূহও বিশাল ভূমিকা ও অবদান রেখে আসছে।

কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, যে লক্ষ্য, চেতনা ও আবেগ নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, আন্দোলনের এতো বছর পরও এই সময়ের সে চেতনার প্রতিফলন তথা মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার সর্বস্তরে সেভাবে প্রতিষ্ঠাত লাভ করেনি। যে আবেগ ও প্রেরণা নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, মাতৃভাষা বাংলার প্রতি নবপ্রজন্মের সেই ভালোবাসা নেই বলে মনে হচ্ছে। হিন্দি সিনেমা, সঙ্গিত ও সিরিয়াল দেখে শিশুরা হিন্দি কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিত্তরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এটিকে অনেকে এক ধরণের আভিজাত্য বলে মনে করছেন।

বাংলা ভাষার প্রতি এ রকম উদাসীনতা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা ও ভাষা শহীদের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করার শামিল নয় কি? এ জন্য কি ভিনদেশী ভাষা ও বিজাতীয় সংস্কৃতিকে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা চালুকারী অতি প্রগতিবাদীরা দায়ী নয়?

তাই আসুন! ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসে আমরা সকলে সংকল্প করি, মাতৃভাষাকে ভিনদেশী আগ্রাসনমুক্ত রাখার। রুখে দাঁড়াই বিজাতীয় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই। সেই সঙ্গে ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে কবরে ফুল দেওয়া, গান-বাজনা করা, বিজাতীয় সংস্কৃতি অনুসরণসহ কোন ধরনের শিরকি ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া থেকে নিজেদেরকে হেফাজতে রাখি। বরং যাঁরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদাতবরণ করেছেন, তাঁদের কবরে ঈসালে সাওয়াবসহ রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া-মুনাজত করি।

লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও মুঈনে মুহতামিম- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।