দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার কাছে বর্তমানে লোক মুখে বহুল আলোচিত বিষয় “রমজানের ১৫ তারিখ শুক্রবারে হঠাৎ বিকট আওয়াজ” সম্বলিত হাদিস ও তার হুকুম এবং বর্তমানে আমাদের করণীয় কি- এ নিয়ে অসংখ্য ব্যক্তিবর্গ ও মুসলিম আমজনতা বারবার জানতে চেয়েছেন। আমি তাদেরকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, এটি একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গুজব। হাদীসের নামে যা প্রচার করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও জাল বর্ণনা।
হাদীসের গ্রন্থ সমূহে এই ব্যাপারে সহীহ ও নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা নেই। অতএব এই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ সহীহ হাদীস শরীফে কিয়ামতের পূর্ব নিদর্শনের অনেক কিছু বর্ণিত হয়েছে। যার অনেক কিছুই বর্তমানে প্রকাশও পাচ্ছে।
আলোচিত হাদীসটির সংক্ষিপ্ত তাহকীক নিম্নে তুলে ধরা হলো-
হাদিসটি শব্দের ভিন্নতায় একাধিক বর্ণনা রয়েছে। হাদিসটির বর্ণনাকারীর মধ্য হতে বেশ কয়েকজন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে জরাহ-তাদীলের ইমামগণ বিভিন্ন কালাম করেছেন। তন্মধ্যে ইবনে লাহিয়া সর্বসম্মতিক্রমে দুর্বল এবং আব্দুল ওয়াহহাবের ব্যাপারে ইমাম উকাইলী কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইবনে হিব্বান তাকে সারিকুল হাদীস (হাদীস চোর) বলে সাব্যস্ত করে বলেছেন, তার বর্ণিত হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করা গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম দারাকুতনী বলেছেন: “মুনকারুল হাদীস”।
ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী, ইবনুল কায়্যিম, জালালুদ্দিন সুয়ুতী, মোল্লা আলী কারী (রহ.) প্রমুখ এটিকে জাল বলেছেন। উকাইলী (রহ.) বলেন, এটি প্রমাণিত সূত্রে বর্ণিত নয়। (আল আসরারুল মারফুআ ১/৪৭২, আত তালখীস-আল মুস্তাদরক- ৮৫৮০, আল মানারুল মুনীফ ১/১১০, আল লাআলি ৪/২৬, কাশফুল খফা ২/২৬৪)।
এটি বর্ণনা করেছেন নুআইম ইবনে হাম্মাদ (রহ.) তার কিতাবুল ফিতানে। শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) নুআইম ইবনে হাম্মাদ ও তার কিতাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন-
অর্থাৎ- কারো জন্য জায়িয নয়, নুআইম ইবনে হাম্মাদকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা। তিনি কিতাবুল ফিতান রচনা করেছেন। এবং তাতে উল্লেখ করেছেন অনেক অগ্রহণযোগ্য ও মুনকার বর্ণনা। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৬০৯)।
ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেছেন, তিনি আল্লাহর রাসূল থেকে প্রায় বিশটি রেওয়ায়েত করেছেন, যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। (তাহযীবুত তাহযীব ৭/৩৩৪)।
ইমাম নাসায়ী (রহ.) বলেছেন, তিনি এমন পর্যায়ে গিয়েছেন যে, তার রেওয়ায়েত প্রমাণযোগ্য নয়। (তাহযীবুত তাহযীব- ৭/৩৩৪)।
নিম্নে এ বিষয়ক আরো কিছু রিওয়ায়াত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল
শাহর ইবনে হাওশাব থেকে একটি মুরসাল রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। রিওয়ায়াতটি এই-
এই বর্ণনায় একজন রাবী “আমবাসাহ ইবনে আব্দুর রহমান”; তিনি পরিত্যাজ্য রাবী।
তার সম্পর্কে ইমাম মিজ্জি (রহ.) তাহযীবুল কামালে (২২/৪১৮) ইমামগণের মন্তব্য নকল করেন-
তাছাড়া এটি মুরসাল বর্ণনা। মোল্লা আলী কারীও (রহ.) এটিকে জাল বলেছেন। (আল আসরারুল মারফুআহ ১/৪৭২)। আরেকটি রেওয়াত-
যুলকদা মাসে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে দ্বন্দ্ধ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ঘটনা ঘটবে। ফলে হজ্জ পালনকারীরা লুণ্ঠিত হবে এবং মীনায় যুদ্ধ সংঘটিত হবে। সেখানে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে। রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। এমনকি তাদের রক্ত জামরাতুল আকাবার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাবে। অবশেষে তাদের নেতা পালিয়ে রোকন ও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যখানে চলে আসবেন। তার অনীহা সত্ত্বেও মানুষ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে।
তাকে বলা হবে, আপনি যদি আমাদের হাতে বাইয়াত নিতে অস্বীকার করেন তবে আমরা আপনার গর্দান উড়িয়ে দিব।
বদর যুদ্ধের সংখ্যার সমসংখ্যক মানুষ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে। সেদিন যারা তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) আরো বলেছেন, মানুষ ইমাম ছাড়া হজ্জ করবে এবং আরাফায় অবস্থান করবে। তারা মীনায় অবতরণ করতে যাবে, আর তখনি কুকুরের মতো কিছু তাদের উপর আক্রমণ করবে। তখন এক গোত্র আরেক গোত্রের উপর হামলা করবে, লড়াই করবে। ফলে (জামরাতুল) আকাবায় রক্ত প্রবাহিত হবে। তখন মানুষ তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে ছুটে এসে তাকে পাবে কাবা শরীফ জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায়। (আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. বলেন), আমি যেন তার অশ্রু দেখতে পাচ্ছি। মানুষ জোরপূর্বক তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
(আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. আরো বলেন,) ওহে মানুষ, তোমরা যখন তাকে পাবে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে। কারণ তিনি দুনিয়াতেও মাহদী আসমানেও মাহদী। (আল মুসতাদরক লিলহাকিম, হাদীস: ৮৫৩৭, আল ফিতান, নুআইম ইবনে হাম্মাদ, বর্ণনা: ৯৮৪)।
এই বর্ণনার একজন রাবী হচ্ছেন আবু ইউসূফ আল মাকদিসী (মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান)। তিনি অনির্ভরযোগ্য রাবী।
ইমাম ইবনে আদী (রহ.) তার সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি অগ্রণযোগ্য বর্ণনাকারী।
ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেছেন, তিনি মিথ্যায় অভিযুক্ত, নির্ভরযোগ্য নন।
ইমাম আবুল ফাত্হ আযদী (রহ.) বলেছেন, তিনি বড় মিথ্যুক, তার বর্ণিত হাদীস পরিত্যাজ্য। (মীযানুল ইতিদাল ৬/২৩৪)। তাই শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.) এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন, এর সনদ অগ্রহণযোগ্য। (তালখীস)।
সুতরাং আমাদের জন্য বর্তমানে করণীয় হল, এসব জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা থেকে বেঁচে থাকা এবং সহীহ হাদীসে ভবিষ্যৎ বাণী বা ফিতনা সংক্রান্ত যা কিছু আদেশ সূচক বর্ণিত হয়েছে, তা আমল করা ও নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যা আছে তা থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য জরুরি।
ইমাম মাহদীর আগমন, গাজওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হওয়া, দাজ্জালের আবির্ভাব ইত্যাদি কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ। এটা আমাদের আকিদা ও বিশ্বাস । কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ইমাম মাহদী, গাজওয়াতুল হিন্দ, দাজ্জাল এগুলোর নামে স্লোগান ও অতি উৎসাহিত হয়ে উম্মাহকে আতঙ্কিত করা বা অতি নিরু উৎসাহিত হয়ে গা ছেড়ে বসে থাকা।
মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যারা এ ধরনের অপপ্রচারে জড়িত, তাদের কর্তব্য প্রকাশ্যে তাওবা করে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা। অন্যথায় হাদিসের মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে গুজব রটনা করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য যারা শক্ত গুনাহগার হবেন।
মেহেরবান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে যাবতীয় মিথ্যাচার ও রটনা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
– হযরত আল্লামা মুফতি জসিম উদ্দিন (দা.বা.), মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি এবং সহযোগী পরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মু্ঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ