Home ওপিনিয়ন ইমরান খান: পাকিস্তানের ভবিষ্যতের কাণ্ডারী?

ইমরান খান: পাকিস্তানের ভবিষ্যতের কাণ্ডারী?

ইমরান খান (ডানে) ও জেনারেল আসিম মুনির। ফাইল ছবি। ছবি- এনএনআই/আইএসপিআর ভিয়া জিও নিউজG

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিয়ে একটা কৌতুক বেশি প্রচলিত — এ বাহিনী কখনো কোনো যুদ্ধে জেতেনি, কোনো নির্বাচনে হারেনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যত না সাফল্য, তার চেয়ে বেশি ‘সাফল্য’ নিজের দেশকে পঙ্গু করে ফেলায়। তার আরেকটি উদাহরণ হয়ে আছে সাম্প্রতিক ইমরান খান বনাম সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব, যেখানে আপাতত ‘ব্যাকফুটে’ আছেন সাবেক ক্রিকেট তারকা।

পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এখন ইমরান খান। দেশটির ইতিহাসে এমন জনঘনিষ্ঠ নেতা কমই দেখা গেছে, এবং এই তালিকায় ইমরান খানের নাম আসাটা সম্ভবত সবচেয়ে অভাবনীয় বিষয়। জমিদার ঘরের ছেলে, অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট, বিখ্যাত প্লেবয় — কোনোটাই ইমরান খানের পক্ষে ছিল না পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল দেশের আপামর জনগণের মন জয় করে নেওয়ার জন্য।

অথচ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট ক্যাপ্টেন এখন জনগণের মনও জয় করেছেন। মার্চ মাসে গ্যালাপ পাকিস্তান-এর করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৬১ শতাংশ জনগণ ইমরান খানকে সমর্থন করেন। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হবার আগ পর্যন্ত ইমরান খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশিদিন টিকে থাকা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এরপর রাজনৈতিক চালে ক্ষমতা হারালেও জনগণের চোখে তিনি হিরো হিসেবেই ছিলেন। তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর তার সমর্থকেরা বলেছিলেন যে ইমরান খান তাদের ‘রেড লাইন’ এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হলে দেশ জ্বলবে।

ইমরান খানের জনসমর্থনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় গত ৯ মার্চ তাকে গ্রেফতার করার সময়। এর আগে তার বাসভবন হাজার হাজার তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই) সমর্থক ঘিরে রেখেছিলেন, যেন প্যারামিলিটারি রেঞ্জার্স তাকে ধরে নিয়ে যেতে না পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানি প্রশাসন ও সেনাবাহিনী ইমরান খানকে গ্রেফতার করার জন্য সকল প্রচেষ্টা চালায়।

খেলার মাঠে ১৫০ রান কখনো করতে না পারলেও ১৫০ মামলার আসামি হতে সক্ষম হন ইমরান খান। অবশেষে ৯ মার্চ আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতির দায়ে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো ইমরান খানকে গ্রেফতার করে। এরপর সারা দেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ জনতা সেনাবাহিনীর সদর দফতর, জেনারেল হেড কোয়ার্টার ও জেনারেলদের বাসভবনে হামলা চালায়, যা পাকিস্তানের মতো দেশে অকল্পনীয় একটি বিষয়।

ইমরান খান ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১০ এপ্রিল ২০২২-এ পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার পর তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিরোধী দলগুলো তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর সারা সপ্তাহের নাটকীয়তা শেষে মধ্যরাতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার পদত্যাগের পেছনে প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন।

ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অভ স্টাফ জেনারেল আসিম মুনিরকে তার রাজনৈতিক দল ভেঙে ফেলার চেষ্টা করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। তার ওপর হওয়া হত্যচেষ্টার দায়ও তিনি আইএসআই-এর (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা) ওপর দেন। অথচ এই সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াকে ইমরান বিশ্বাসঘাতক বলে দাবি করেন, অথচ তিনিই খানকে ক্ষমতায় আনতে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এর পাশাপাশি ইমরান খান প্রথমবার আমেরিকার ওপর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনেন। তিনি দাবি করেন, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার রাশিয়া ভ্রমণে নিষেধ করেছিল আমেরিকা, যা তিনি শোনেননি। একই দিনে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। কিন্তু এর পক্ষে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারেননি। এটা সম্ভবত পাকিস্তানিদের ভেতর পুঞ্জিভূত আমেরিকা-বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগানোর একটা চেষ্টা, এবং তাতে ইমরান সফল।

আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক, এবং ইমরান খান নিজেও গত বছরের ১৪ নভেম্বর এক জনসভায় আমেরিকার সাথে তার সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ এসব শেষ। ওসব আমি ফেলে এসেছি পেছনে। আমি যে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দিতে চাই, তার সাথে সকল দেশের সুসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে আমেরিকার।’

কিন্তু ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আসা ইমরান খানের সঙ্গে বাহিনীটির এমন দা-কুমড়া সম্পর্ক কেন হলো? সেনাবাহিনীতো ইমরান খানের হয়ে মিডিয়াতে হস্তক্ষেপ করেছে, তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তার পলিসিকে সমর্থন করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইমরান খানের সরকার ছিল একটা হাইব্রিড রেজিম, যেখানে সরকার অসামরিক হলেও সরকার পরিচালনায় বড় ভূমিকা রাখে সামরিক বাহিনী।

ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সম্পর্ক ২০১৯ থেকেই খারাপ। সে সময় তিনি জেনারেল মুনিরকে আইএসআই-এর প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এরপর তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন যেন জেনারেল মুনির সেনাপ্রধান না হন; কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জেনারেল মুনির সেনাপ্রধান হয়েই ইমরান খানের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেন। ইমরান খানও জেনারেল মুনিরের কাছের লোক, আইএসআই-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের বিরুদ্ধে ইমরানের ওপর চালানো আততায়ী হামলার জন্য দায়ী করেন।

ইমরান খান যতই তার কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা জাহির করার চেষ্টা করছিলেন, ততই সেনাবাহিনী বুঝে যায় ইমরান আর তাদের পুতুল হয়ে থাকবেন না। তার মেয়াদ বাড়ানো, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ, গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা এবং নিরাপত্তা নীতির মতো বেশ কিছু বিষয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে ইমরানের মতানৈক্য হয়। খান বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে সেনাবাহিনীকেও ক্ষুব্ধ করেছিলেন। তিনি পাশতুন তাহাফুজ মুভমেন্ট (পিটিএম)-কেও সমর্থন করেছিলেন, যারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ট্রাইবাল এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ এনেছে। এসব কারণে সেনাবাহিনী তাকে সরাতে উঠেপড়ে লাগে।

আরও পড়তে পারেন-

অবশ্য ইমরান খানের শক্তিশালী বন্ধু আছে সবখানেই। সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার ইমরান খানকে পছন্দ করেন। বিচার বিভাগের একটা বড় অংশ তার পক্ষে, (পাকিস্তানের বিচার বিভাগ কিন্তু যথেষ্ঠ স্বাধীনতা ভোগ করে) — তারা তার জামিনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। লক-আপে একদিন রাখার পর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বিচারক তাকে আদালতে ডেকে ‘আপনাকে দেখে খুশি হয়েছি’ বলে তাকে একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রেখেছিলেন। পরদিন আরেক বিচারক ইমরানকে ছেড়ে দেন। আর রাজনৈতিক ময়দানে খানের সবচেয়ে বড় বন্ধু তরুণ ও নারী সমাজ, যারা এর আগে ভোট দেননি। ইমরান খানের পক্ষে লড়াই করেছেনই মূলত তরুণ ও নারীরা।

পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সব নেতাকে সেনাবাহিনী সরিয়ে দিয়েছে। জুলফিকার আলি ভুট্টো ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তার মেয়ে বেনজীর ভুট্টো দুইবার ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়ে শেষমেশ আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। শাহবাজ শরীফের ভাই নওয়াজ শরীফ আজও নির্বাসিত। কিন্তু ইমরান খানের বেলায় কেন এমন সেনাবিরোধী সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি হলো?

তার একটা বড় কারণ হতে পারে, ইমরান খানের পপুলিস্ট রাজনীতি এবং নবীন প্রজন্মের কাছে তার আবেদন। ইমরান খান পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকট পার করেছেন, এবং তিনি দেশকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু তিনি জনগণের কাছে সবকিছু প্রকাশ করেছেন — কোনো রাখঢাক করেননি, মিথ্যা আশা দেখাননি। আর জনগণও দেশের এ ক্রান্তিকালে আশার আলো খুঁজছে। তাদের কাছে সেটা ইমরান খান।

খানের অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট বক্তব্য তরুণদের উৎসাহিত করেছে। যদিও ইমরান নিজেই অতটা অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট মনোভাবের না, যতটা তিনি দাবি করেন। দিনশেষে তিনিও চান সেনাবাহিনী তাকে আগের মতো করেই সমর্থন দিক। কিন্তু তিনি যে কলিশন কোর্সে চলে গেছেন, সেখান থেকে ফেরার উপায় আর তার নেই।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য ৯ মে একটা সতর্কবাণী হয়ে গেছে। তারা বড় বড় শহরে সেনাবাহিনীর প্রতি অনুগত নাগরিকদেরকে দিয়ে বিশাল মিছিল করিয়েছে। তারা ৯ মে-কে শহীদ ফৌজি দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে, ধর্মীয় নেতাদের সাথে আতাত করছে। সবশেষে ইমরান খানের দলকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলছে চাপ দিয়ে।

এই সংকটের সমাধান কীভাবে হবে তার ওপর নির্ভর করছে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। ইমরান খান কি মুক্ত হয়ে একটি গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারবেন? নাকি তাকে বলপ্রয়োগ করে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে? অথবা সমঝোতা করে নেবেন তিনি? তিনি কি গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ নতুন পাকিস্তানের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন? নাকি একজন ব্যর্থ নেতা যিনি তার সুযোগ নষ্ট করেছেন এবং তার জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন — এই হিসেবে তাকে স্মরণ করা হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ধারিত হবে পাকিস্তান একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে টিকে যেতে পারবে কি না তার ওপর।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা উম্মাহ২৪.কম-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।