Home ইতিহাস ও জীবনী আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.)কে নিয়ে দারুল উলূম হাটহাজারীর শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণ

আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.)কে নিয়ে দারুল উলূম হাটহাজারীর শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণ

[গত ৩ জুন শনিবার রাতের প্রথম প্রহর ১টায় উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর মহাপরিচালক হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.) আপন রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালের পানে ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। একই দিন বাদ মাগরীব জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী ক্যাম্পাসে আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.)এর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং জানাযা শেষে মাকবারায়ে জামিয়ায় শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) ও শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। জানায়ায় দেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বগণসহ লক্ষাধিক মুসল্লী শরীক ছিলেন।

আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.)এর ইন্তিকালে দেশের অনেক প্রখ্যাত আলেম ও বিশিষ্টজন শোকবার্তা দেনভ জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝেও গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেককেই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে দেখা যায় এবং অনেকে শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।

জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর পাঁচ জন শিক্ষার্থী আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.)এর উপর স্মৃতিচারণমূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে উম্মাহ২৪.কমে লেখা পাঠান। তাদের লেখাসমূহ ধারাক্রম অনুযায়ী নিম্নে পত্রস্থ করা হলো। – বিভাগীয় সম্পাদক]

আল্লাম শাহ ইয়াহিয়া (রাহ.): কিছু স্মৃতি কিছু কথা

গত ৩ জুন শনিবার ইন্তেকাল করেন দেশের সর্বজন মান্য ও শ্রদ্ধাভাজন আলেমে-দ্বীন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর, খতমে নবুয়ত বাংলাদেশ-এর সভাপতি এবং জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রাহ.)। সন্দেহ নেই, তাঁর ইন্তিকাল দেশ ও জাতির জন্য অনেক বড় শোক ও শূন্যতার।

হুযূর আমাদের ছেড়ে দুনিয়া থেকে চিরতরে চলে গেছেন, এটা এখনো বিশ্বাস হতে চায় না। হুযুরের কাছে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাকমীল জামাতে ‘শামায়েলে তিরমিযী’ কিতাব হুযুর পড়াতেন। যারা নিয়মিত হুযুরের দরসে অংশগ্রহণ করতো, আমিও তাদের মধ্যে ছিলাম। আমি কখনোই হযরত (রহ.)এর দরসে অনুপস্থিত থাকতাম না। হুযূর দরসে যখন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সূরত ও সীরাত একে একে বর্ণনা করতেন, আমরা সকলে মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতাম। দরসে হুযূরের তাকরীর যেনো এক মোহময় আধ্যাত্মিকতার আলোয় ভরপুর থাকতো। হুযূরের তাকরীরে অনেকের চক্ষু বেয়ে পানি গড়াতো নিজের অজান্তেই।

একই সাথে হযরত (রহ.) ইলমে ফারায়েযের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। অনেকেই হুযূরের কাছে ইলমে ফারায়েযের ‘সিরাজী’ কিতাব পড়ার অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। হুযূর সিরাজী পড়ানোর সময় এতো সহজবোধ্য ও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতেন, ছাত্ররা খুব সহজেই ফারায়েযের জটিল জটিল বিষয়গুলো আত্মস্থ করে নিতেন। জামিয়ার মহাপরিচালকের গুরু দায়িত্বে আসার পর হুযূর ‘সিরাজী’ পড়ানোর সময় করে ওঠতে পারতেন না। এতে অনেকেই আতৃপ্তি নিয়ে থাকতেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ।

আমাদের উস্তাদগণের থেকে জেনেছি এবং আমরা নিজেরাও দেখেছি, হযরত আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.) জামিয়া মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে অত্যন্ত সাদাসিধে, প্রচারবিমুখ ও নিবৃত্ত জীবন-যাপন করতেন। হুযূরের সাথে যে কেউ সহজেই দেখা করতে ও কথা বলতে পারতেন। হুযূর সকলের কথা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মহাপরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ ও অতি ব্যস্ত দায়িত্ব গ্রহণের পরও হুজুরের এই গুণাবলীর মধ্যে তারতম্য হয়নি। হুযূর জাতীয় পরিচিতি লাভ করেন দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। তবে এতো ব্যস্ততা সত্ত্বেও হুযূর যে কোন সাক্ষাতপ্রার্থীকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সময় দিতে সচেষ্ট থাকতেন। মনোযোগের সাথে সবার কথা শুনতেন, মেহমানদারি করতেন এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন।

আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া (রহ.)এর অন্যতম আরেকটি বড় গুণের কথা জেনে অভিভূত হয়েছি। যথা- দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার নিয়ম হচ্ছে, মুহতামিম সাহেব-এর মূল বেতনের সাথে উল্লেখযোগ্য অংকের একটা হাদিয়া দেওয়া হয় মেহমান ভাতা হিসেবে। কারণ, দারুল উলূম হাটহাজারী ভিজিট করতে আসা দেশি-বিদেশী মেহমানগণ স্বভাবত মুহতামিম সাহেব এর কার্যালয়ে যান। তাদেরকে মেহমানদারি করার জন্যই মাদরাসা প্রশাসন মুহতামিম সাহেবকে এই ভাতা দিয়ে থাকে। কিন্তু আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.) এই ভাতা কখনো গ্রহণ করেননি। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এই মাদরাসার জন্যই আমি আজ এতো বড়মাপের সম্মান পাচ্ছি। আগে আমাকে মানুষ কোথাও নিয়ে গেলে সিএনজি বা রিক্সায় নিয়ে যেতো। আর এখন প্রাইভেট কার আসে, বিমানে নেয়। আগে ২ হাজার টাকা হাদিয়া দিলে এখন ১০ হাজার দেয়। এগুলো কার উসিলায় পেয়েছি? মাদরাসার উসিলায়। সুতরাং যে মাদরাসা আমাকে এতো কিছু দিলো, সেই মাদরাসার মেহমানদেরকে আমি নিজ থেকে মেহমানদারি করাতে পারবো না, এটা হতে পারে না। তাই আমি মেহমান ভাতা গ্রহণ করি না”।

পরিশেষে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার দরবারে মিনতি করি, তিনি যেন দয়াপরবশ হয়ে হযরত (রহ.)কে মাগফিরাত ও জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন এবং আমাদেরকে তাঁর মিশন ও ভিশনকে এগিয়ে নেওয়ার তাওফীক দান করেন। আমিন।

– মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ,
শিক্ষার্থী- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

হৃদয়ে আঁকা আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.)

‘স্মৃতিচারণ’ যদিও বা আমরা এই শব্দটিকে অতিসহজেই উচ্চারণ করে নিতে পারি, কিন্তু এর গভীরতা হলো সমুদ্রের অতল গহ্বরের চাইতেও বেশি। তবে এর মাঝে রয়েছে একটি জগত কিংবা শুকতারার মতো একটি নক্ষত্র। একেকজনের স্মৃতিচারণ একেকরকম হয়ে থাকে। কারো কারো স্মৃতিগুলো রয়ে যায় প্রতিচ্ছবি হয়ে হৃদয়ের আঙিনায়। আবার কারো স্মৃতি মুছে যায় পেন্সিলে আঁকা ক্ষুদ্র বর্ণাত্মক রচনার মতো।

দুনিয়ার বুকে কিছু মানুষ থাকেন যাঁদেরকে আমরা আল্লাহর দ্বীনের পথের নিবেদিত প্রাণ বলি। আবার মনীষীও বলা হয় তাঁদেরকে।তাঁরা যখন মাতৃগর্ভ থেকে ভূপৃষ্ঠে ভূমিষ্ট হন, তখন মনে হয় যেন নতুন আরেক ইতিহাসের সূচনা হতে চলেছে। সেই ইতিহাস হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঈমানী চেতনা ও তাগুত শাসকদের বিরুদ্ধে ইসলামী খিলাফতের সূচনালগ্ন। জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারির সদ্যপ্রয়াত মহাপরিচালক হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.) ছিলেন তেমনই একজন মনীষী। দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে আপন জিন্মায় নিয়ে নিলেন। এই অল্প সময়েই মরহুম (রহ.) যে কীর্তিগাঁথা রেখে গেছেন, তা অমর হয়ে থাকবে। তাঁর সারল্যতা, তাকওয়া, দয়াদ্রতা এবং উম্মাহ চিন্তা আমরা কখনোই ভুলবো না। মেহেরবান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরতকে মাগফিরাত ও জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

– মুহাম্মদ ফেরদাউস
শিক্ষার্থী-  বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

সাধারণ থেকেও যিনি ছিলেন অসাধারণ

আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া (রহ.)[১৯৪৭-২০২৩] উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার অন্যতম একজন সফল মুহতামিম ছিলেন। যিনি ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদায় অসাধারণ হওয়া সত্ত্বেও সকলের মাঝে সাধারণভাবে থাকতেই পছন্দ করতেন। মাত্র দুই বছর আগেও যার নাম হয়তো বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ শুনেনি, যার খ্যাতি এবং পরিচিতি সম্পর্কে অনেকেই ছিল অজ্ঞ। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর ইন্তেকালের পর শূরার সদস্যরা তাঁর উপর ইহতেমামের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন।

তখন অনেকে ভেবেছিলেন, এত বড় জিম্মাদারী তিনি কীভাবে পালন করবেন? যার নাম কখনো কারো মুখে তেমন উচ্চারিত হয়নি, তিনি কীভাবে মুহতামিম হবেন? মাঠে-ময়দানে যার তেমন আনাগোনা নেই, তিনি কী এত এত বাতিলের মুকাবিলা করতে পারবেন? কিন্তু অল্প দিনেই তিনি সকলের উদ্বেগাকূল ভাবনার ছেদ ঘটালেন বিস্ময়ের সাথে। মাত্র কয়েক মাসেই সকলে বুঝে গিয়েছিলেন, উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম হাটহাজারী বাস্তবিকই এক মকবুল প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের জিম্মা আল্লাহর ইচ্ছায় যথাযথ যোগ্যবানের হাতেই অর্পিত হয়েছে। হযরত ইয়াহইয়া (রহ.) নেতৃত্বগুণ, দক্ষতা, তাকওয়া ও উম্মাহ ফিকির অল্প দিনেই সকলে বিস্ময়ের সাথে অবলোকন করলেন।

মাত্র এক বছরে বাংলাদেশের সব সেক্টরে নিজের যোগ্যতা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে নিজের সব দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন।

জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী- মুহাম্মদ ওমর ফারুক।

“হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ”সহ বিভিন্ন মাদরাসার বোর্ডে তিনি নির্ভরযোগ্য সদস্য হ‌ওয়ার সাথে-সাথে নিজের একনিষ্ঠ খেদমতের মাধ্যমে এক কথায় প্রকাশ করেছেন যে, তাঁকে মুহতামিম হিসেবে নির্বাচন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কোন ভুল করেননি।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদাভিরু এবং সাদাসিধে জীবনের অধিকারি। রাসূল (সা.)এর প্রতি ভালবাসায় তাঁর হৃদয় সর্বদা ব্যকুল থাকতো। হুজুরের কাছে মিশকাত জামাতে জালালাইন শরীফ (২য় খন্ড)এবং দাওরায়ে হাদিসে শামায়েলে তিরমিযী পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে অধমের। তাই হুজুরের খোদাভীরুতা এবং রাসূলের প্রতি অগাধ ভালবাসার কথা খুব কাছ থেকেই দেখেছি।

এই তো কিছুদিন আগের ঘটনা। গত বছর শেষের দিকে যখন শামায়েলে তিরমিযী খতম করার সময় এলো। হুজুরকে দরস দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা হলো। একপর্যায়ে যখন রাসূল (সা.)এর অসুস্থতাসহ বিভিন্ন আলোচনা আসলো, তখন হুজুর পিতাহারা শিশুর মতো ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে অনেক কান্নাকাটি করতে লাগলেন‌। বেশ কয়েকবার সামনে পড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।

ফলে সেদিন হুজুর কিতাব শেষ করতে না পেরে চলে যান। অতঃপর কিছু দিন পরে পুনরায় এসে শামায়েল শেষ করেন। তাছাড়া মসজিদে আলোচনার সময় হুজুরের বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে বারাবার কেঁদে দেওয়ার দৃশ্য কারো অজানা নয়।

যার হৃদয়ে নবীপ্রেম পরিপূর্ণ, যিনি তালিবে ইলমের ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর এভাবে চলে যাওয়ার বেদনা সহ্য করা বাস্তবিকই অনেক কষ্টকর।

আল্লাহ তাআলা প্রিয় হুজুরকে জান্নাতের সুউচ্চ মকাম দান করুন। আমিন।

– মুহাম্মদ ওমর ফারুক
শিক্ষার্থী- ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

আরও পড়তে পারেন-

স্মৃতির টাইমলাইনে আল্লামা ইয়াহইয়া (রহ.)

উম্মুল মাদারিস জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া (রহ.) যে এতো চুপিসারে আকস্মিকভাবে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন, কারো ভাবনায় ছিল না। হুজুরকে হারানোর কষ্টে আমাদের কান্না যে এতো ব্যাকুলতায় হৃদয় ভাঙা কষ্টে রূপ নিবে, কে জানতো! দায়িত্ব গ্রহণের অল্প দিনেই হুজুর (রহ.) যেভাবে সকলের আপন হয়ে ওঠেছিলেন, সেটা ছিল বিস্ময়ের। জামিয়ার শিক্ষক, ছাত্র সকলেই হুজুরকে সমানভাবে আপন করে নিয়েছিলেন। কারণ, হুজুর যে সবাইকে কোনরূপ পার্থক্য না করে আপন বুকে আগলে নিয়েছিলেন। তাই আকস্মিক হুজুরকে হারানোর বেদনা সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না।

হুজুরের ইন্তিকালের সংবাদ শোনার পর সবার এই পরিস্থিতি হয়েছিল যে, কেউ কাউকে কিছুই বলতে পারছিলেন না, সবাই যেনো নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। সবার চেহেরা মলিচ্ছন্নতায় ভরপুর, বেদনায় কাতর। অনেককে দেখা গেছে, হুজুরের সুপরিসর কার্যালয়ে বসে অঝোর ধারায় কান্নার পর কান্না করছেন। সবারই একই প্রশ্ন, কি হয়ে গেল! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না কোনো দিন না! আহ কি যে এক পরিস্থিতি যে, কেউ দেখে হয়তো নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না।

সর্বপ্রথম যেদিন হুজুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য আমি গিয়েছিলাম, তখন হুজুর রুমে সজাগ অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমি সালাম দিয়ে হুজুরের হাতে হাত রাখলাম। এরপর একান্ত বিনয়ের সাথে হুজুরের বর্তমান অবস্থা কেমন জানতে চাইলে হুজুর বললেন, ‘হৃদয় আল্লাহর ঘর’  তখন আমার মনের ভেতরটা কেমন জানি নাড়া দিয়ে ওঠেছিল! এরপর হুজুর কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। চোখ বন্ধ করে হুজুর কি যেন ভাবলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন–  আহ! আল্লাহ আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করলেন, কি জন্য সৃষ্টি করলেন! এই কথাটা বার বার বলতে লাগলেন। এরপর হুজুর আবারও চুপ রইলেন। তারপর বললেন– মানুষ পৃথিবীর আলো বাতাসে জন্ম নেয়, তারপর সেগুলো গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে, তারপর কিছু সময় অপেক্ষা করে দুনিয়ার নিয়ম থেকে বিদায় নেয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ জানতেও পারে না যে কেন সে পৃথিবীতে এসেছিল এবং কেন তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এই বিষয়টা না জানার কারণে সে জঙ্গলের বাসিন্দা হয়ে জীবন কাটায়। অন্যান্য প্রাণীরা যেভাবে বাঁচে, তারাও তেমনিভাবে বাঁচে এবং তারা সেভাবে বাঁচার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে,  যেভাবে জঙ্গলে একজনকে বেঁচে থাকতে হলে অন্যজনকে মেরে ফেলতে হয়।

জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর আরবী সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী- খালেদ হোসাইন ফাহিম।

হুজুরের এসব হৃদয় ছোঁয়া কথা সেদিন আমার মনের অস্থিরতাটা জাগিয়ে দিয়ে ছিল। হুজুরের কথা মতে যখন আল্লাহর ঘরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু থাকে, তখন বান্দাকে অস্হিরতা গ্রাস করে। এটা বোঝানোর জন্য কোনো গায়েবি অথবা অলৌকিক ক্ষমতার দরকার পড়ে না। এটা সেই বিচ্ছেদের জ্ঞান, যা ঘটনার ভিতর দিয়ে বিশ্বজগতের পাঠশালায় শিক্ষা দেওয়া হয়। যা হুজুরের কথা থেকে বুঝতে পারছিলাম। আহ হুজুরের কথাগুলো এখন শুধুই স্মৃতি আর স্মৃতি হয়ে অন্তরে জেগে আছে!

হুজুর তখন আরও বললেন, হৃদয় যদি আল্লাহর ঘর হয়, তাহলে কি মানুষ শুধু আল্লাহকেই ভালবাসবে? কোনো মানুষ প্রাণী বা বস্তুকে ভালোবাসবে না? এইরকম হলে আল্লাহ তাআলা ভালবাসার অনুভূতি কেন সৃষ্টি করলেন?

হুজুর এরপর একেক করে জবাব দিতে লাগলেন– ভালবাসা হচ্ছে একটা দায়িত্ব, আর এই দায়িত্বটা তোমাকে কে দেন? উত্তরে হুজুর বললেন, তিনি দেন, যিনি আমাকে এবং তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তোমার হৃদয়ের ঘর জুড়ে বসে আছেন, তিনি সমস্ত বিশ্বজগতের মালিক- আল্লাহ’ আল্লাহ’ ‘আল্লাহ।

হুজুর আরও বললেন, মানুষকে দয়া করবে আর তার সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসবে, সেটা শুধুই কথার কথা ভালবাসা নয়, সেই ভালবাসাটা হচ্ছে এক বিশাল দায়িত্ব। যেমন আমরা মানুষের সুখ-শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেছি। শোন, তার কারণ তোমরাও যেন মানুষকে ভালবাসো, মানুষকে ভালবাসার দায়িত্ব যেন নিতে পারো। মানুষকে ভাল না বাসতে পারলে তোমার এবং জঙ্গলের জীব-জন্তুর মধ্যে পার্থক্য থাকে না। তাই মানুষের মতো মানুষ হতে হলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে ভালবাসতেই হবে, ভালবাসতেই হবে। আর যখন এরকম হয়ে যাবে, তখন তোমার ভালবাসা হবে পৃথিবীর আলো বাতাস আর পানির মতো, যা সমস্ত প্রাণী সমান ভাগে ভোগ করতে পারবে। এরপর কিছু সময় নীরব থেকে বললেন, তুমি কি এই রকম চাও না? আমি বললাম- জ্বি হুজুর, অবশ্যই চাই।

হুজুর (রহ.) বললেন, দেখ তুমি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হয়েছে তোমার জন্য। আর তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাঁর জন্য। তুমি যখন তাঁর হবে, এই বিশ্বজগত সবকিছু তোমার হয়ে যাবে। তাঁর সাথে এই সম্পর্কটাই প্রকৃত ভালবাসা। আর এই ভালবাসাকে বলে ইবাদত। তুমি কি এই ইবাদতটা করতে চাও না? আমি উত্তরে বললাম, জ্বি হুজুর, অবশ্যই চাই। দেখ, তোমাকে এই ভালবাসার জন্যই এক অসীম এবং অমূল্য এক বস্তু দেওয়া হয়েছে, যার নাম হৃদয়। সেই হৃদয়ের ব্যবহারে মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সেই হৃদয়ে সব জীবের ভালবাসার জায়গা দিতে হবে। তুমি কি পারবে না? উত্তরে আমি বললাম- জ্বি হুজুর অবশ্যই পারব।

এরপর হুজুর আমাকে বিদায় দিলেন। আমি রুম থেকে বের হয়ে চলে আসছি এবং নিজের মনকে প্রশ্ন করতে করতে বুঝতে পারলাম, হুজুরের অন্তরে মানুষের জন্য কতোটা ভালবাসা জমে আছে, সেটা হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন প্রিয় হুজুরের কবরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ জায়গায় ভূষিত করেন। আমিন।

– খালেদ হোসাইন ফাহিম
শিক্ষার্থী- আরবি সাহিত্য বিভাগ
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

স্মৃতির পাতায় আল্লামা শাহ ইয়াহইয়া (রহ.)

একদিন হুজুর (আল্লামা শাহ ইয়াহইয়া রহ.)এর বাড়ির একটি মাহফিলে আমি আর সংগীত সম্রাট আসহাব উদ্দীন আল আজাদ সাহেব উপস্থিত হই। মাহফিল শেষ করে আসার সময় আসহাব উদ্দীন আল আজাদ সাহেব আমাকে বলেন, মিজান চলো আজকে ‘আল্লামা ইয়াহইয়া সাহেবের’ সাথে একটু দেখা করে আসি। আমিও বললাম, চলুন, যাই।

যাওয়ার পর দেখলাম হুজুর নিজেও সফর করে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভাবলাম, হুজুর যেহেতু বিশ্রাম নিচ্ছেন, এখন আলাপ করতে গেলে হুজুর কষ্ট পাবেন, তাই দেখা না করে চলে আসতে চাইলাম! পরে ভাবলাম আসছি যেহেতু হুজুরের সাথে দেখাটা হোক।

জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর পাঞ্জুম জামাতের শিক্ষার্থী- মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মিজান।

খাদেমের সাথে যোগাযোগ করে হুজুরের রুমে গেলে হুজুর আমাদেরকে কাছে টেনে নিলেন। হুজুরের সাথে দীর্ঘক্ষণ প্রায় (২ থেকে ৩ ঘন্টা) ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

আমি এখানে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হয়েছি! হুজুর সফর থেকে এসে বিশ্রাম না করে, আমাদের সাথে দীর্ঘ ২ ঘন্টারও অধিক সময় দিলেন পরম আন্তরিকতায়! এটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের ও প্রশান্তির সময় ছিল।

মেহেরবান আল্লাহ তাআলা হুজুরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক। আমিন।

– মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মিজান
শিক্ষার্থী- জামাতে পাঞ্জুম
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।