Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের দাবি

যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের দাবি

- প্রতিকী ছবি।

।। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ ।।

আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যদিও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে সমাজের বহুমাত্রিক ভাবাদর্শের ওপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল অর্থ উপার্জন নাকি ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ- তা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলে। সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের মানুষ থাকার কারণে শিক্ষার অর্থ ও সংজ্ঞায় বৈচিত্র্য আছে। চলমান এ বিতর্কের সহজে অবসান না হলেও, এটি নানাভাবে প্রমাণিত যে, শিক্ষা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গি।

পৃথিবীর যেসব দেশকে আজ আমরা সভ্য, গণতান্ত্রিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ উদাহরণ হিসেবে গণ্য করি, সেসব দেশের উন্নয়নের ইতিহাস আমরা কতটা জানি। ওই দেশগুলো আজকের মতো এমন উন্নত ছিল না; তাদেরও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আজকের এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে- মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষা। আধুনিক অর্থনীতির উন্নয়নের এ ধারণা ও তত্ত্ব প্রয়োগ করে বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে উন্নত হয়েছে। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, মানবসম্পদের এ তত্ত্ব ব্যবহার করে যে সব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, চীন ও মালয়েশিয়া। এক সময় এ সব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ছিল সীমিত। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদের এ তত্ত্ব ব্যবহার করে যে সব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে- সৌদি আরব, ইরান, কাতার, লিবিয়াসহ তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো। এদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ ছিল সীমিত। তৃতীয়ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদ- এই তত্ত্বকে ব্যবহার করে যে সব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে তাদের মধ্যে আছে- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি। এদের মানবসম্পদ ছিল খুব সীমিত।

উন্নয়ন মডেলের এ তিনটি ধারার প্রথমটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য; কারণ আমাদের আছে মানবসম্পদের প্রাচুর্য আর তার ব্যবহার করেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে এগোতে হবে। আর মানবসম্পদ ব্যবহারের সাথে সম্পর্ক উপযুক্ত শিক্ষার; যে শিক্ষার সাথে দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি পরিকল্পিত সংযোগ থাকবে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়ন নির্ভর করছে মূলত দক্ষ জনশক্তির ওপর। বিশ্বব্যাংক (২০০০), ইউএনডিপি (২০০০), ইউনেস্কো (১৯৯৯) সালে তাদের রিপোর্টে বলেছে, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের আর কোনো পথ খোলা নেই। সব রিপোর্টেই বলা হয়েছে- দেশের এই অধিক জনগোষ্ঠীকে অতি জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল শ্রমবাজারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কথা।

বর্তমান বিশ্বে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি, কোনো বিষয় জানা ও বোঝা। আসলে মানুষ জন্মের পর থেকেই চারপাশের পরিবেশ থেকে নানান কিছু শিখতে থাকে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই আমরা শিক্ষা হিসেবে সাধারণত ধরে নিই। শিক্ষাই মানুষকে তার মনুষ্যত্ব অর্জনে সাহায্য করে। তাই বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সম্প্রীতি বাড়ায়, কুসংস্কার দূর করে সমাজকে আলোকিত করে। অধুনা শিক্ষাকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা হচ্ছে- সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই পৃথিবী দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। তাই কর্মমুখী শিক্ষা উন্নতি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

স্বাধীনতার আগে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৫ বছর আমরা এক ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর প্রায় ৫০ বছর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে তেমন বড় রকমের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা পরিচালিত ব্যবস্থাতেই ঘুরপাক খেয়েছি। বিভিন্ন নামে যা কিছু পরিবর্তন হয়েছে তাকে যথার্থ পরিবর্তন বলা যাবে না। রুপার অলঙ্কারে সোনার প্রলেপ দেয়া হলেই সেটি সোনার অলঙ্কার হয়ে যায় না। বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে ভেতরের অবস্থা বোঝার সুযোগ নেই। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু গুণগত দিক থেকে কী পরিবর্তন হলো সেটিই বিবেচ্য হওয়া উচিত। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পাঁচ বছর মেয়াদি লেখাপড়া শেষে একটি সমাপনী পরীক্ষা চালু হয়েছে- যা দৃশ্যমান। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ শেষে একটি জেএসসি পরীক্ষা চালু হয়েছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আগে কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি মিডিয়াম ভার্সনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। আজকের এ সময় অলিগলিতে পাড়া-মহল্লায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো কমতি নেই। এ সব প্রতিষ্ঠানে একেকজন ছাত্রকে প্রায় আট থেকে ১০টি বই পড়তে হয়। অধিকন্তু পাঁচ থেকে ছয় বছরের ছেলেমেয়েদের ১৪ থেকে ১৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মানের লেখাপড়া করতে হয়। এতে শিক্ষাবিপাক তথা পরিপাকতন্ত্রের পতন ঘটানো ছাড়া অন্য কিছু কি হচ্ছে? অভিভাবকরা মনে করেন, রাতারাতি তাদের ছেলেমেয়েরা যেন উপরে উঠে আসে। এ পরিস্থিতিতে ছোট ছেলেমেয়েদের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় ছেলেমেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ছে। আমাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি।

আরও পড়তে পারেন-

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। সেই পরিবর্তন বা সংস্কার নিম্নরূপ হতে পারে- সাধারণ শিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি-ও-বিজ্ঞান শিক্ষা, ধর্মীয় নৈতিক বোধের শিক্ষা, ক্রিয়া ও সংস্কৃতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সিভিল ডিফেন্স। উপরিউক্ত বিভাগের জন্য কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন- সাধারণ শিক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ধর্মীয় মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়ার ব্যবস্থা নতুনরূপে ঢেলে সাজানো যেতে পারে।

দেশকে দ্রুত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষার প্রসার একান্ত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ সময় যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা আধুনিক শিক্ষার অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে চিন্তা ও চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোথায় যেন আটকে গিয়েছিলেন। তাই প্রকৃতপক্ষে দেশের মানসম্মত, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এদিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলতে হবে, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য বা দর্শন এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, জাতীয়ভাবে আমাদের এখনো কোনো শিক্ষার মডেল বা আদর্শ নেই। পশ্চিমা ধাঁচের যে শিক্ষা ধারাটি এখনো প্রধানভাবে চলছে তাকেও বর্তমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আধুনিক বলা যায় না। মূলত বহু দিন আগে ব্রিটিশ প্রবর্তিত এ শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং দেশের প্রয়োজন মেটাতেও সেভাবে সক্ষম নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকার বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। সে কমিশন যথানিয়মে রিপোর্টও দিয়েছিল এবং সে রিপোর্টের ভিত্তিতে কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে সে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কাজকর্ম এগোয়নি। শিক্ষা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষা এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। কিন্তু এত কিছুর পরও শিক্ষার সর্বজনীনতা আসছে না। শিক্ষার দৈন্য কাটছে না। শিক্ষায় আসছে না পরিবর্তনের হাওয়া। কাজেই যুগোপযোগী ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে এবং একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষানীতির প্রাধান্য দিতে হবে- যার বাস্তবায়ন হলে বাঙালির চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে।

সুষ্ঠু শিক্ষানীতি ও তার সফল বাস্তবায়নে বাঙালি কর্মদক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে এবং যথার্থ মানবসম্পদের উন্নয়নও ঘটবে। শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যতিরেকে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। উন্নয়ন শুধু কাগজের ফিরিস্তি হয়েই ভেসে বেড়াবে। কাজেই প্রকৃত উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নবান্ধব পরিবেশ ও যথাযথ বিনিয়োগ এবং নীতিমালা সংযোজনের বিকল্প অন্য কিছুতে কোনো সমাধান আসবে বলে আমরা মনে করতে পারি না। আসুন একটি সুন্দর শিক্ষা নীতিমালা প্রস্তুত করে এবং দক্ষ মানবসম্পদের বিকাশ ঘটিয়ে আমাদের জাতীয় মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করি।

বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আছে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও কর্মসংস্থানের অভাব। তাই আর বিলম্ব না করে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিশ্বের জাতিসমূহের উন্নয়ন ও প্রগতির ধারার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাকে জীবনমুখী করে তোলার সময় এসেছে। জাতীয় প্রতিভার অপচয় আর অর্থনৈতিক প্রশ্ন বিবেচনায় এনে আমাদের ব্যাপারে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। এই অপরিহার্য কেবল কারিগরি শিক্ষার জন্যই। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সাধারণ সনদপত্র নয়, বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করে জীবনসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাহলে জাতি অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে। বাঁচবে দেশ। সার্থক হবে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা। আমরা একটি উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক, সাবেক উপমহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।