।। রিন্টু আনোয়ার ।।
কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন বিষয়ে বেশ কয়েক দিন ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি সর্বশেষ পরিষ্কার করেছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের করিডোর দেয়া নিয়ে যে গুজব উঠেছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিচ্ছি, করিডোর নিয়ে আমাদের সাথে কারো কোনো কথা হয়নি, কারো সাথে কথা হবে না।
করিডোর নিয়ে অগ্রিম মন্তব্য করে এক উপদেষ্টা মূলত গোলমাল বাধিয়েছেন। অনেকে না বুঝে এ নিয়ে বাড়াবাড়িমূলক কথা বলায় জট পেকেছে। মানবিক সহায়তা নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে কোনো মতপার্থক্য আছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সেনাপ্রধানের সাথে এ বিষয়ে তার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাথে এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকা বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সে কারণে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সাথেও আলোচনা চলছে।
এখন পর্যন্ত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, এ সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তারপর থেকে ইস্যুটি আমরা আন্তর্জাতিক অ্যাজেন্ডায় পুনরায় তুলে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এর আগে সাত বছর ইস্যুটি প্রায় অপসৃত হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আরো পেছনে পড়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এটি উত্থাপন করেছিলেন এবং জাতিসঙ্ঘকে এ ইস্যুতে একটি সম্মেলন আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে সাড়া দিয়েছে। একটি জাতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের এমন সম্মেলন আয়োজন বিরল। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ সচিবালয়ে এ সম্মেলন হবে। দ্বিতীয় যে বিষয় আমরা দেখছি, এ সমস্যার সমাধান কী? আমরা প্রথম থেকে ভেবেছি এ সমস্যার সমাধান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করা। এটিই সমাধান।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা আরো বলেন, আমাদের ওপর কারো চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যারা আছে অংশীজন, আমরা সবার সাথে কথা বলছি। তাড়াহুড়োর কোনো কথা নেই। হিসাব আমাদের সোজা, সেটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে এবং ফেরত গিয়ে আবার যেন ফেরত না চলে আসে। টেকসই প্রত্যাবাসন হতে হবে। আমরা আরাকান আর্মিকে বলে দিয়েছি কোনো এথনিক ক্লিনজিং আমরা মেনে নেবো না। আরাকান অস্থিতিশীল থাকলে প্রত্যাবাসনের আলোচনা সম্ভব হবে না।
এদিকে জাতিসঙ্ঘ চায় এ নিয়ে দুই সরকারের একটি ঐকমত্য। জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বরাতে ঢাকা অফিসের ভাষ্য : তারা রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতিতে খুব উদ্বিগ্ন। বিবৃতি দিয়ে এও জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে তারা মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে। জাতিসঙ্ঘের এমন বিবৃতিতে একটু দেরিতে হলেও তাদের অভিপ্রায় পরিষ্কার। তা হলে গোলমাল বা সমস্যাটা কোথায়? প্রথমত, কিছুটা গোপনীয়তা। রমজানে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব গুতেরেস যখন হাইপ্রোফাইল সফরে এলেন, ঘটা করে কক্সবাজার গেলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইফতার করলেন তখন এ ধরনের টুঁ শব্দও হয়নি; বরং বেশি ফোকাস হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসের খবর। কিন্তু, অল্প সময়ের ব্যবধানে ফেরতের বদলে আরো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেনের মাধ্যমে। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর দেয়ার নীতিগত সম্মতি দেয়া হয়েছে। এটি যত না মন্তব্য তার চেয়ে বেশি তথ্য। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর তা রাজনৈতিক অঙ্গন কাঁপিয়ে দেয়। ভয় জাগায় বিভিন্ন মহলে। একেক জনের একেক কথনে আলোচনা-সমালোচনার তেজ বেশ তীব্র। তবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা করিডোর শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন, পরে কিন্তু বলেছেন ‘পাথওয়ে’। সেটি স্লিপ অব টাং ছিল। কথাবার্তা অনেক সময় স্লিপ হতে পারে, কিন্তু উনি কারেক্ট করেছিলেন। উনি সেই কথা আর কখনো বলেননি। আর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু, তারপরও সমালোচনা-ক্ষোভের পারদ নামেনি। যে যা পারছেন বলছেন। বলে চলেছেন।
রাখাইনে ত্রাণ পাঠাতে একটি প্যাসেজ দিতে বাংলাদেশের প্রতি জাতিসঙ্ঘের অনুরোধের তথ্যটি প্রকাশ্যে আসলে লুকোচুরি না হলেও বিলম্ব হয়েছে, তা এর মধ্যে পরিষ্কার। সংস্থাটির প্রস্তাবে ভাসাভাসা সম্মতিও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্তও ছিল। এর মধ্যে রয়েছে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি, সবার জন্য সমানভাবে ত্রাণ বিতরণ, শর্তহীন ত্রাণ বিতরণ। এসব শর্ত না মানলে এমন প্যাসেজ দিতে নারাজের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনের নাগরিকরা যে খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কটে ভুগছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের কারো অজানা নয়। জাতিসঙ্ঘ এ ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল। এ কারণে রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘের প্যাসেজের প্রস্তাব দেয়া। যা দিয়ে বিপন্ন রাখাইনবাসীর জন্য বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, সার, বীজ, ওষুধসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে চায় জাতিসঙ্ঘ।
বিশ্বের সঙ্ঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পান না, বা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডোরের তাগিদ বোধ করে জাতিসঙ্ঘ। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সঙ্ঘাতময় অঞ্চলগুলোতে করিডোরের প্রচলন শুরু। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল ১৯৩৮-৩৯ সালে। নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজন সরিয়ে আনতে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডোর স্থাপিত হলেও সেটি দু’বছরের মধ্যে বন্ধ করে দেয় আজারবাইজান সরকার। ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহল নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরে আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। অনেক জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থও হয়েছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডোরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসঙ্ঘ।
বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডোর হয়েছে তার কোনো কোনোটি হয় বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে। জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায়ও হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন একটি স্বীকৃত পথ বা প্যাসেজের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়।
আরাকানের সাথে বাংলাদেশের প্যাসেজ এখনো ভবিতব্য। বিষয়টি নিয়ে রব উঠলেও এটি আসলে কতদূর বা তা কোন পথে হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। স্থল ও নৌ উভয় পথে প্যাসেজ হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশটির সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এ পথেও রাখাইন রাজ্যে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো সম্ভব। প্যাসেজে মিয়ানমার কি রাজি বা চেয়েছে? এ প্রশ্নেরও জবাব নেই। মিয়ানমার সরকার চাইলেও তা-কি সম্ভব? এ প্রশ্নও রয়েছে। প্যাসেজের জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন।
এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়তে পারে বলে সংশয়ের কথাও বলা হয়েছে। প্রায় সব দলের কথা এ রকম। সেই সাথে নানা ভয় ও শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। তাদের সার কথা হচ্ছে, এর মাধ্যমে আরাকান আর্মির মতো একটি রাষ্ট্রবিহীন, সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিষয়টি কি এমন? নাকি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
rintu108@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ