।। সালাহ উদ্দিন তোফায়েল ।।
ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। হাজার বছর ধরে এই উৎসব ইসলামি ঐতিহ্যের এক গৌরবময় নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই দিনে মুসলমানরা আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, আত্মত্যাগ ও আত্মনিবেদনের মহত্ত্ব অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী করে। কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলেও এর ফযীলত নিয়ে সমাজে বহু জাল ও ভিত্তিহীন হাদিস প্রচলিত রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আমলের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সময়ের দাবি হলো, কুরবানির প্রকৃত গুরুত্ব ও মাহাত্ম তুলে ধরা এবং জাল হাদিসগুলোকে সুন্নাহর আলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর মুখোশ উন্মোচন করা। এই প্রবন্ধে কয়েকটি প্রচলিত হাদিস তুলে ধরা হলো, যেগুলোর বেশিরভাগই জাল বা অগ্রহণযোগ্য। আলোচনা শুরু করছি কাজী ইবনুল আরাবী (রহ.)-এর একটি উক্তি দিয়ে। তিনি তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যা-গ্রন্থ ‘আরিজাতুল আহওয়াজি‘তে বলেন— কুরবানির ফযীলত সম্পর্কিত কোনো সহীহ হাদিস নেই। মানুষ যদিও এতে আশ্চর্যনক অনেক কিছু বলে, যা নির্ভরযোগ্য নয়। (আরিজাতুল আহওয়াজি- ৬/২২৮।)।
প্রথম হাদীস:
হাসান ইবনু আলি (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন—
“ من ضحى طيبةً بها نفسُه محتسبا لأضحيته كانت له حجابا من النار”
অর্থ- “যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট মনে এবং সওয়াবের আশায় কুরবানী করে, তা জাহান্নাম থেকে তার জন্য আড়াল হবে”। (উৎস- তাবরানী, মুজামুল কাবীর, হাদিস- ২৭৩৬।)
হাদীসটি জাল। সনদে রয়েছে সুলাইমান ইবনু আমর আন-নাখয়ী, যিনি একজন মিথ্যাবাদী রাবী (বর্ণনাকারী)। (বিস্তারিত- মাজমাউজ জাওয়ায়েদ- ৪/১৭, খুলাসাতু বদরিল মুনির- ২/৩৮৬, নাইলুল আওতার- ৫/১৯৬। আত-তাইসীর, আব্দুর রউফ মুনাবী- ২/৪২৮, সিলসিলা যঈফা- ৫২৯, ২/১৫।)
দ্বিতীয় হাদীস:
হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত। নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন—
“يا أيها الناس ضحوا و احتسبوا بدمائها فإن الدم و إن وقع في الأرض فإنه يقع في حرز الله”
অর্থ- “হে মানুষ! কুরবানী করো এবং তার রক্তের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশা রাখো। কেননা রক্ত মাটিতে পড়লেও তা আল্লাহ্র হেফাজতে পৌঁছে যায়”। (উৎস- তাবারানি, মুজামুল আওসাত, হাদীস- ৮৩১৯। আত-তারগীব, মুনজিরী- ২/১৬০)।
হাদিসটি জাল। রাবী আমর ইবনু হুসাইন হলেন ‘মাতরুকুল হাদীস’। (বিস্তারিত: মাজমাউজ জাওয়ায়েদ- ৪/১৭, মিজানুল ইতিদাল- ৪/২০৫, দিওয়ানুজ জুয়াফা- ৩১৬৮, মাতালিবুল আলিয়া- ৮৩৬, ৩২১৬, জুয়াফা, দারাকুতুনী- ৩৮৮, সিলসিলা যঈফা- ৫৩০, ২/১৬।)
তৃতীয় হাদীস:
জায়েদ ইবনু আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন—
قال أصحابُ رسولِ اللهِ ﷺ يا رسولَ اللهِ ﷺ ما هذه الأضاحي قال سُنَّةُ أبيكم إبراهيمَ، قالوا فما لنا فيها يا رسولَ اللهِ؟ قال بكلِّ شَعرةٍ حسنةٌ، قالوا فالصُّوفُ؟ قال بكلِّ شَعرةٍ من الصُّوفِ حسنةٌ.
অর্থ- সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! এই কুরবানিগুলো কী? তিনি বললেন, এটি তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। তাঁরা বললেন- হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? তিনি বললেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! পশমওয়ালা পশুগুলোর প্রতিটি পশমের জন্যও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পশমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের জন্যও একটি করে নেকী রয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ- ১৯২৮৩, ইবনু মাজাহ- ৩১২৮।)
হাদিসটি সহীহ নয়, বরং মওজু বা জাল। এতে আবু দাউদ নামের একজন রাবী রয়েছেন, যিনি ‘মুনকার’। তাছাড়া আয়িজ নামে অপর একজন রাবী রয়েছেন, যিনি সকলের মতে দুর্বল (জয়িফ)। (বিস্তারিত- জখিরাতুল হুফফাজ- ৩৮৩৫, মিসবাহুজ জুজাজা- ৩/২২৩, জুয়াফা ইবনু আদী- ৩/৫৫, রাবী- ১৫১৫, জুয়াফা উকাইলী, রাবী- ১৪৬০, ১৯০৮। আল মুহাজ্জাব- ৩৮৪৩, ইতহাফুল মাহারা- ৪৭১৪। তালখীসুজ জাহাবী- ৩৫০৮, ৩৪৬৭। শায়খ আলবানী (রহ.) বলেন, হাদিসটি মওজু বা জাল। (সিলসিলা যঈফা- ৫২৭।)
চতুর্থ হাদীস:
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) বলেন—
“عظموا ضحاياكم فإنها على الصراط مطاياكم”
অর্থ- “তোমরা তোমাদের কুরবানের পশুগুলোকে সম্মান করো, কারণ সেগুলোই হবে পুলসিরাতের উপর তোমাদের বাহন”। (উৎস- জুওয়াইনি, নিহায়াতুল মাতলাব- ১৮/১৬১, মুসনাদুল ফিরদাউস- ২৬৮)।
হাদিসটি জাল। রাবী ইয়াহয়া ইবনু উবাইদিল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি মুনকার হাদীস বর্ণনা করেন। (বিস্তারিত: কাশফুল খাফা- ২/৭০, আত-তালখীস- ৪/২৫০, খুলাসাতু বদরিল মুনির: ২/৩৭৭, মাকাসিদুল হাসানাহ- ১০৮, ফয়জুল কাদীর- ১/৪৯৬, শরহু মুশকিলিল ওয়াসিত- ৪/১৯৯, সিলসিলা যঈফা- ১/১৭৩।)
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
পঞ্চম হাদীস:
ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন—
“ما أنفقت الورق في شيء أحب إلى الله من نحير ينحر في يوم عيد”
অর্থ- “ঈদের দিন কুরবানির জন্য পশু জবাই ছাড়া অন্য কোনো খাতে রৌপ্যমূদ্রা ( সম্পদ) ব্যয় করা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। (তাবারানি, মুজামুল কাবীর- ১১/১৭, ১০৮৯৪, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ- ৫৯৩৮।)
এ হাদিসটি অত্যন্ত দুর্বল। সনদে এমন এক বর্ণনাকারী রয়েছেন- ইবরাহিম ইবনু ইয়াজিদ, যিনি হাদিসের ক্ষেত্রে ‘মাতরুক’ বা ‘মুনকারুল হাদীস’ হিসেবে পরিচিত। (বিস্তারিত: আল-কামিল ইবনু আদি- ১/২২৮, কিতাবুল মাজরুহীন ইবনু হিব্বান- ১/১০১, সুনানুল কাবীর, বায়হাকী- ১৯০১৪, জখিরাতুল হুফফাজ- ৪৭৬৫, মারিফাতুত তাজকিরাহ- ৬৬১, সিলসিলা যঈফা- ৫২৪।)
উপসংহার: কুরবানির গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য নিয়ে সহীহ হাদিস রয়েছে, তবে জাল হাদিস প্রচার করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কঠিন গোনাহ। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে আমার নামে মিথ্যা কথা বলবে, সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন পাকা করে নিল!” (সহীহ বুখারী- ১০৭, সহীহ মুসলিম- ৩)। তাই আমাদের উচিৎ সহীহ হাদিসের আলোকে আমল করা এবং জাল বা মনগড়া হাদিস থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হক বুঝে তাতে আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, উলূমুল হাদিস (১ম বর্ষ), দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ