।। আবরার ইউসূফ লাবীব ।।
ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় দুই শতাব্দী ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত ছিল। এই দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতবর্ষে যেসব অঞ্চল নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, কাশ্মীর তাদের মধ্যে অন্যতম।
কাশ্মীর- পর্বতমালায় পরিবেষ্টিত ৮৬,০০০ বর্গমাইলের একটি বিস্তৃত ভূখণ্ড, যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,২৭ মিটার। উপর থেকে কাশ্মীরের মানচিত্র দেখতে অনেকটা উল্টো পাঁচের মতো মনে হয়। এই অঞ্চলের শীতকালীন রাজধানী ‘জম্মু’ এবং গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ‘শ্রীনগর’। কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তে চীন, উত্তর-পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পশ্চিমে পাকিস্তান এবং দক্ষিণে ভারত অবস্থিত। ভারতের এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির দক্ষিণে রয়েছে হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্য। জম্মু ও কাশ্মীরের উত্তরে পাকিস্তান-অধিকৃত গিলগিট-বালতিস্তান এবং পূর্বে ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখ অবস্থিত।
সম্প্রতি, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তারিখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫(ক) ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে—যথা- জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। বর্তমানে কাশ্মীরের জনসংখ্যার আনুমানিক ৬৮.৩% মুসলিম, ২৮.৪% হিন্দু, ১.৯% শিখ, ০.৯% বৌদ্ধ এবং ০.৩% খ্রিষ্টান।
কাশ্মীরকে বলা হয় “ভূস্বর্গ”—সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। এখানে রয়েছে ঢেউ খেলানো পাহাড়, অপূর্ব বনভূমি এবং মনোমুগ্ধকর মালভূমি। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক শোভায় মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরের তৃণভূমিতে যদি মৃত্যুও আসে, তবুও তা সৌভাগ্যের বিষয়।” কাশ্মীরের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা, শান্ত-নিবিড় এক স্বর্গীয় প্রকৃতির দৃশ্য, যেন স্রষ্টা নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছেন এ ভূখণ্ডকে।
কাশ্মীরের প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য—দিগন্তজোড়া বরফঢাকা পাহাড়ের মাঝে প্রবাহমান স্বচ্ছ জলধারা, যার শব্দ প্রকৃতিকে করে তোলে আরও জীবন্ত। এখানে ঘুরে দেখার মতো বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, বিশেষত শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাল লেক, নাগিন লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন, নিশাত বাগ, শালিমার বাগ, চাশমেশাহী বাগ, পারিমহল, হযরত বাল দরগাহ এবং শংকরাচার্য হিল।

সোনামার্গে রয়েছে জোজিলা পাস, থাজিওয়াস হিমবাহ, গঙ্গাবাল লেক, গাদসার লেক, ভিসান্তার লেক এবং সাসতার লেক। এছাড়া আছে দুধপত্রী, কোকরনাগ, ডাকসুম, সিনথেন টপ, আহারবালের জলপ্রপাত, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্বাদুপানির হ্রদ উলার লেক, গ্যান্ডারবালে অবস্থিত মানসবাল লেক, এবং বরফে আচ্ছাদিত মনোমুগ্ধকর স্থান গুলমার্গ। এ মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্যপট দেখতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক ছুটে আসেন।
কাশ্মীরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বহু কবি রচনা করেছেন অনুপম কবিতা, বহু সাহিত্যিক সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গল্প ও উপন্যাস। প্রাচীন ভ্রমণকারীরা কাশ্মীরকে বলেছেন—“এশিয়ার গহনা”, কেউবা বলেছেন “মুক্তোর মাঝে পান্না বসানো”।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
“একটা সূর্য ডোবার যে রং, তার সব সৌন্দর্য কি লেখায় আসে? লিখতে গিয়ে বড্ড দুর্বল লাগে। দেখেছি, অনুভব করেছি, আনন্দিত হয়েছি- সেটা আর পাঁচজনকে বোঝাই কী করে!”
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর প্রথম কাশ্মীর ভ্রমণে এসে বলেছিলেন-
“পৃথিবীতে যদি কোনো স্বর্গ থেকে থাকে, তবে তা এখানেই।”
সুতরাং, বলা চলে—কাশ্মিরিরা যেন পৃথিবীর স্বর্গে বসবাসরত এক বিশেষ সম্প্রদায়।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, কাশ্মীরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই একে পরিণত করেছে এক ‘ভূ-স্বর্গে’। স্রষ্টার নিজ হাতে গড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে যে প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, তা পৃথিবীর আর কোনো কিছুর মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর বেদনা নিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন—
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি।”
এখন প্রশ্ন হলো—এই স্বর্গতুল্য ভূমি কীভাবে নরকে পরিণত হলো? কে বা কারা এর জন্য দায়ী?
নিম্নোক্ত আলোচনায় আমরা এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
আমরা জানি, স্বর্গ মানেই সুখ, শান্তি ও প্রশান্তির আধার। অথচ আজকের কাশ্মীর যেন এক জ্বলন্ত নরককুণ্ড। বাইরে থেকে যতই সে মোহনীয় হোক না কেন, ভেতরে যেন এক বিস্ফোরণপ্রবণ আগ্নেয়গিরি- জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। ‘বাহিরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’—ঠিক যেন সেই অবস্থা। এই ‘ভূ-স্বর্গ’ কীভাবে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলো নরকে, তা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়।

কাশ্মীর আমাদের কাছে মূলত দুটি নামে পরিচিত- ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এবং ‘আজাদ কাশ্মীর’। ভারতের নিয়ন্ত্রিত অংশকে বলা হয় ‘জম্মু ও কাশ্মীর’, আর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশকে বলা হয় ‘আজাদ কাশ্মীর’। তবে জানা জরুরি, ‘জম্মু’ ও ‘কাশ্মীর’ দুটি আলাদা অঞ্চল—ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ।
১৮৪৬ সালের অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, পুঞ্চ, গিলগিত ও বালতিস্তানের জমিদারি পান ডোগরা নেতা গুলাব সিং। তখন থেকেই দলিলপত্রে এই রাজ্যের নাম হয় ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’। ১৯৪৭ সালের পর ভারত এই অঞ্চলকে নিজেদের অঙ্গরাজ্য হিসেবে শাসন করে। এ অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিতে ভারতীয় সংবিধানে সংযোজন করা হয় ধারা ৩৭০ ও ৩৫(ক)। কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট এই ধারাদ্বয় বাতিল করে ভারত, এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে তৈরি করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল—‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এবং ‘লাদাখ’। একই সঙ্গে ভারত ‘পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর’-কেও নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে আসছে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ রাজ্যকে নিজেদের দাবি করে। সে সময় গিলগিত ও বালতিস্তান পাকিস্তানের দখলে যায়, যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে।
ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর শাসন করেছে নানা রাজবংশ- প্রথম গোনানডা, মৌর্য, কুশান, দ্বিতীয় গোনানডা, হোয়াইট হুন, কারকোটা, লোহারা, মীর, দৌলত কাসগরী, চাক, মোগল, পাঠান, শিখ ও ডোগরা- যাদের শাসন চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত।
এই অঞ্চলের বর্তমান সংকটের সূচনা ঘটে মূলত শিখ সাম্রাজ্যের সময় থেকে। শিখদের রাজা রঞ্জিত সিংয়ের রাজধানী ছিল লাহোরে। তাঁর অধীনে ডোগরা জমিদার গুলাব সিং ব্রিটিশদের সঙ্গে গোপন আঁতাত শুরু করেন। ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যু ও ১৮৪৫ সালে প্রথম শিখ-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় গুলাব সিং শিখদের সহায়তা না করায় ব্রিটিশরা সহজেই জয়লাভ করে। এ জয়ের পুরস্কারস্বরূপ ১৮৪৬ সালের অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ৭৫ লাখ রুপিতে গুলাব সিংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় কাশ্মীরসহ কয়েকটি পার্বত্য অঞ্চল।
চুক্তির প্রথম ধারা ছিল অঞ্চল হস্তান্তর, নবম ধারায় বলা হয় কোনো বহিরাগত আক্রমণ হলে ব্রিটিশরা সাহায্য করবে, আর দশম ধারায় গুলাব সিং ব্রিটিশ শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এই চুক্তি অনুসারে কাশ্মীর যেন পরিণত হয় একটি ‘ক্রয়কৃত ভূখণ্ডে’। মহাত্মা গান্ধী এই চুক্তিকে বলেন “উববফ ড়ভ ঝধষব”, আর কবি আল্লামা ইকবাল কাশ্মীরিদের বলেন “বিক্রিত জাতি”। সাংবাদিক আর.এস. গুল মন্তব্য করেন, “১৬১৪ সালে মাত্র ২৪ ডলারে ডাচদের কাছে বিক্রি হয়েছিল নিউইয়র্ক, আর ৭.২ মিলিয়নে রাশিয়ার কাছ থেকে আমেরিকা কিনেছিল আলাস্কা। এর তুলনায় কাশ্মীরের বিক্রি আরও লজ্জাজনক।”
ডোগরা শাসকরা ছিল চরম শোষক। তারা ব্যয়ের তুলনায় অধিক রাজস্ব সংগ্রহে আগ্রহী ছিল। তারা প্রায় প্রতিটি বস্তুর উপর কর বসিয়েছিল। শুধু ১৮৬৮ সালেই উপত্যকা থেকে আদায় করে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৮ রুপি!
মহারাজার আমল থেকেই ‘জম্মু ও কাশ্মীর’-এর সীমানা নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। যদিও আলোচনায় সাধারণত ভারত-পাকিস্তানের নামই বেশি আসে, বাস্তবে কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তের কিছু অঞ্চল—যেমন লাদাখ, গিলগিত ও বালতিস্তানের কিছু অংশ—চীনের দখলে রয়েছে। বর্তমানে কাশ্মীরের মোট আয়তনের মধ্যে ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রায় ৪৫%, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ৩৬% এবং চীনের নিয়ন্ত্রণে ১৯%।
কালক্রমে এই অঞ্চলে নানা গণআন্দোলনের জন্ম হয়, এবং বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের মুখে পড়ে। এসব আন্দোলনের চাপে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। ফলে জন্ম নেয় স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—কাশ্মীর যাবে কোথায়?
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ৫৬২টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো যুক্ত হয় ভারতের সাথে, আর মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো যুক্ত হয় পাকিস্তানের সাথে। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় স্বাধীন থাকতে চায়। পরবর্তীতে হায়দরাবাদ ও জুনাগড় গণভোটের মাধ্যমে ভারতের অংশ হয়ে যায়।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র কয়েক দিন আগে, কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের নিকট ‘স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি’তে সাক্ষরের জন্য টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। পাকিস্তান চুক্তিতে সাক্ষর করলেও ভারত করে না। স্বাধীনতা অর্জনের পর অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার প্রভাব পড়ে কাশ্মীরের মুসলিম জনপদেও। এর প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (ঘডঋচ) থেকে পাঠান উপজাতিরা কাশ্মীর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। তবে, যেহেতু পাকিস্তান ‘স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি’-তে স্বাক্ষর করেছিল, তাদের নিয়মিত সেনাবাহিনী পাঠানোর বৈধতা ছিল না।
এমন পরিস্থিতিতে জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ নামক এক চুক্তিতে সাক্ষর করেন তিনি, শেখ আবদুল্লাহর সম্মতিক্রমে। এই চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালায়।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার করা দরকার- ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন স্বাক্ষরের আগের দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্পষ্টভাবে বলেন, “কাশ্মীরকে এই সংকটময় সময়ে সাহায্য করার অর্থ এই নয় যে, তাদেরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করা হচ্ছে।”
প্রেম নাথ তার উবসড়পৎধপু ঞযৎড়ঁময ওহঃরসরফধঃরড়হ ধহফ ঞবৎৎড়ৎ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর এক রেডিও ভাষণে নেহরু ঘোষণা দেন যে, কাশ্মীরিদের গণভোটের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার দেওয়া হবে—তারা চাইলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে কিংবা ভারতের সঙ্গে থেকে যাবে। প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী ও সিদ্ধার্থ গুহরায়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, নেহরু মহারাজা হরি সিংকে বলেন, “প্রথমে কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে এবং তারপর কাশ্মীরের জনগণ গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোন দেশের অংশ হবে।”

এমনকি ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির কাছে পাঠানো এক বার্তায়ও নেহরু গণভোটের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন। ৩১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো বার্তাতেও তিনি কাশ্মীর থেকে সেনা প্রত্যাহার ও গণভোট আয়োজনের আশ্বাস দেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেনি এবং পাকিস্তানও একইভাবে কাশ্মীর থেকে সেনা সরাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ।
শুধু নেহেরুই নন, তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনও ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ একসেশন’-এ স্বাক্ষরের সময় ব্রিটিশ ক্রাউনের পক্ষ থেকে বলেন, “এই একসেশন যদি ভবিষ্যতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি করে, তবে তার সমাধান হবে কাশ্মীরের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে।”
চুক্তিটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তসাপেক্ষে— অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব তিনি নিজে ভোগ করবেন এবং ভারত সেই সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি ভারত কাশ্মীর ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করলে, ১৯৪৮ সালের ৬ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৪৭ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে— যেখানে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর দেওয়া গণভোটের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বলা হয়, কাশ্মীরের জনগণই গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে তারা স্বাধীন থাকবে, ভারতের সঙ্গে থাকবে না পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, নেহেরুসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব কাশ্মীরিদের গণভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন এবং জাতিসংঘও এ বিষয়ে প্রস্তাব পাস করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- সেই গণভোট আজও অনুষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীরিদের স্ব-নির্ধারণের অধিকার এখনও উপেক্ষিত, যার ফলে পাক-ভারত দ্বন্দ্ব আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
এখন অনুমাননির্ভর একটি প্রশ্ন উঠে আসতে পারে— যদি কখনো ভারতের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি বা বলপ্রয়োগ ছাড়া একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভোট আয়োজন করা হয়, তাহলে তার ফলাফল কী হতে পারে? কাশ্মীর কি ভারতে থাকতে চাইবে, নাকি পাকিস্তানে যুক্ত হতে চাইবে?
এই বিষয়ে উইলিয়াম বেকার তাঁর কধংযসরৎ: ঐধঢ়ঢ়ু ঠধষষবু, ঠধষষবু ড়ভ উবধঃয গ্রন্থে উল্লেখ করেন, গণভোট অনুষ্ঠিত হলে কাশ্মীর সম্ভবত পাকিস্তানের পক্ষেই রায় দেবে। তাঁর যুক্তিগুলো হলো-
১. জম্মু ও কাশ্মীরের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম, যেমন পাকিস্তানেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে ধর্মীয় একাত্মতা রয়েছে।
২. কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান পাকিস্তানশাসিত পাঞ্জাবের সন্নিকটে।
৩. ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরের অর্থনীতি পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
৪. বহির্বিশ্বের সঙ্গে কাশ্মীরের বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রধান রুট পাকিস্তানের দিকেই।
৫. সিন্ধু, ঝিলাম ও চিনাব নদীর প্রবাহ পাকিস্তান হয়ে আসে, যা পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।
বেকারের অভিমত- ভারত সরকার ভালো করেই জানে, গণভোট হলে ফলাফল পাকিস্তানের অনুকূলে যাবে, সে কারণেই তারা গণভোটের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি।
সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে নেহেরুসহ অনেক নেতৃবৃন্দের প্রতিশ্রুতি এবং জাতিসংঘের সুপারিশ উপেক্ষা করায় কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান আজও হয়নি। বরং এই অঙ্গীকার ভঙ্গ ও আন্তর্জাতিক প্রস্তাব উপেক্ষার ফলেই কাশ্মীর আজ রক্তাক্ত সংঘর্ষের মঞ্চে পরিণত হয়েছে— একসময়কার ‘ভূস্বর্গ’ এখন যেন এক ‘ভূ-নরক’। এই সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক: উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ (২য় বর্ষ), দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ