Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর কোন পুত্রকে কুরবানী দিতে চেয়েছিলেন?

হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর কোন পুত্রকে কুরবানী দিতে চেয়েছিলেন?

।। মাওলানা মুহাম্মদ ইরশাদুল্লাহ ।।

প্রভুর রাহে বিলীন হওয়ার এক অভূতপূর্ব আহ্বান- ঈদুল আযহা এসে উপস্থিত আমাদের দুয়ারে। আকাশে-বাতাসে বইছে ত্যাগ ও মহিমার চিরন্তন বার্তা। এই মহামানবীয় আহ্বানে সর্বপ্রথম সাড়া দিয়ে পরবর্তী উম্মতের জন্য এক অনন্য আদর্শ স্থাপন করেন খলীলুল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.)- নিজের প্রিয়তম পুত্রকে প্রভুর রাহে উৎসর্গ করার মাধ্যমে। এই বিসর্জিত পুত্রকেই বলা হয় ‘যবীহুল্লাহ’- আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত সন্তান।

‘যবীহুল্লাহ’ শব্দ দ্বারা বুঝানো হয় সেই পুত্রকে, যাকে আল্লাহর আদেশে তাঁর পিতা ইবরাহীম (আ.) যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি হলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। এটাই অকাট্য সত্য, যা কুরআনুল কারিমের সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং উম্মতের মুহাক্কিক ও বিশ্বস্ত আলিমদের সর্বসম্মত অভিমত।

অপরদিকে, হযরত ইসহাক (আ.)কে ‘যবীহুল্লাহ’ হিসেবে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মূলত এটি ইহুদিদের তাহরিফ (বিকৃতি) ও অপব্যাখ্যার ফল।

এই প্রবন্ধে আমরা ঐতিহ্যবাহী ও নির্ভরযোগ্য ইসলামী উৎসের আলোকে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।

১. কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ:

যবীহুল্লাহ সংক্রান্ত সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে সূরা আস-সাফফাতে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ. فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

অর্থ- অতঃপর আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর যখন সে পিতার সঙ্গে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন তিনি বললেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন বলো, তোমার কী মত?’ সে বলল, ‘হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হচ্ছেন, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্তই পাবেন’। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০১-১০২)।

এরপর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ

অর্থ- “আর আমি তাকে ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম, যিনি ছিলেন নেককারদের একজন নবী”। (সূরা আস-সাফফাত- ১১২)।

এই আয়াতের ক্রম ও প্রসঙ্গ থেকেই স্পষ্ট হয়- যিনি যবেহের জন্য নির্ধারিত হয়েছিলেন, তিনি ইসহাক (আ.) নন; বরং ইসমাঈল (আ.)। কারণ, যবেহের আলোচনার পরে ইসহাকের সুসংবাদের আলোচনা একেবারে নতুন করে শুরু হয়েছে। আবার, যবেহের জন্য নির্ধারিত সেই পুত্রের গুণ বলা হয়েছে حليم- অর্থাৎ ধৈর্যশীল। তিনিই বলেছিলেন-

سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

অর্থ- “আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্তই পাবেন”। (আস-সাফফাত- ১০২)। এই গুণ কুরআনে হযরত ইসমাঈল (আ.)এর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে-

وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا ٱلْكِفْلِ ۖ كُلٌّ مِّنَ ٱلصَّـٰبِرِينَ

অর্থ- “আর স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদ্রীস ও যুলকিফলকে; তারা সবাই ছিল ধৈর্যশীল”। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৫)। অথচ ইসহাক (আ.)এর বিষয়ে কুরআনের কোথাও এই ধৈর্যগুণের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

ইসমাঈল (আ.)-এর যবেহের বিষয় আরও স্পষ্ট হয়েছে কুরআনের এই আয়াতে-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ ۚ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا

অর্থ- এই কিতাবে তুমি ইসমাঈলের বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যবাদী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী। (সূরা মারইয়াম, আয়াত- ৫৪)।

এ আয়াত এবং যবেহের ঘটনার সময় তাঁর উচ্চারিত-إفعل ما تؤمر পিতাকে প্রতিজ্ঞা পূরণে আশ্বস্ত করার উক্তি প্রমাণ করে, যবেহের ঘটনা তাঁর সঙ্গেই সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসহাক (আ.)এর প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ ۖ وَمِن وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ

অর্থাৎ- “আমি তাকে (সারাহকে) ইসহাকের এবং ইসহাকের পর ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম”। (সূরা হুদ, আয়াত ৭১)।

অতএব, যেহেতু ইসহাকের পর ইয়াকুব (আ.)এর জন্মের সুসংবাদ আগেই দেওয়া হয়েছিল, তাহলে ইসহাককে যবেহ করার আদেশ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

এখান থেকে আরও একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে- ইসমাঈল (আ.)এর জন্মের সুসংবাদ আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ.)এর দোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দিয়েছেন-

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

অর্থ- “হে আমার প্রভু! আমাকে সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন”। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০০)।

অন্যদিকে, ইসহাক (আ.)এর সুসংবাদ আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে দিয়েছেন, ইবরাহীম (আ.)এর দোয়া ছাড়াই, যখন তিনি ফিলিস্তিনে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর বয়স ছিল প্রায় ১০০ বছর।

সুতরাং, সবদিক বিবেচনায় এটা অকাট্যভাবে প্রতিপন্ন হয়- যবেহের আদেশ হযরত ইসমাঈল (আ.)এর ব্যাপারেই ছিল, যিনি ছিলেন ইবরাহীম (আ.)এর প্রথম এবং অতিশয় স্নেহভাজন পুত্র।

২. ইঞ্জিলের আলোকে বিশ্লেষণ:

‘ইঞ্জিলে বারনাবাস’-এর ৪৩ ও ৪৪তম অধ্যায়ে হযরত ঈসা (আ.)এর বাণীতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে- কুরবানির ঘটনা ইসমাঈল (আ.)এর সঙ্গেই সম্পৃক্ত, ইসহাক (আ.)এর নয়। যদিও খ্রিস্টান সমাজ এ গ্রন্থকে স্বীকৃতি দেয় না, তথাপি এর অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধ বর্ণনা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং ইসলামী পরিপ্রেক্ষিতে এর উপস্থাপনা মোটেও অগ্রাহ্যযোগ্য নয়। (দ্রষ্টব্য- পৃষ্ঠা ১৭৭-১৮১)।

৩. তাওরাতের আলোকে বিশ্লেষণ:

তাওরাত ও বাইবেলের আলোকে যবীহুল্লাহ কে ছিলেন? তাওরাতের আদিপুস্তক ইড়ড়শ ড়ভ এবহবংরং-এর ২২তম অধ্যায়ের ২য় আয়াতে বলা হয়েছে- “তখন প্রভু বললেন, তোমার সন্তান, তোমার প্রিয় পুত্র ইসহাককে গ্রহণ করো এবং মারিয়ার ভূমিতে গিয়ে তাকে সেখানকার এক পাহাড়ে উৎসর্গ করো।”

এই বক্তব্যকেই ইসহাক (আ.)কে যবীহুল্লাহ প্রমাণের ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন খ্রিস্টান ও ইহুদি মতবাদ অনুসারীরা। কিন্তু প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ ও ইসলামি গবেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী- এটি পরবর্তীতে সংযোজিত একটি জাল বিবরণ, যার উদ্দেশ্য ছিল ইসমাঈল (আ.)এর মর্যাদা খর্ব করে ইসহাক (আ.)এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।

তবে তাওরাতের অন্যান্য অংশে উল্লিখিত বয়স ও ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়। উদাহরণস্বরূপ-

তাওরাত আদিপুস্তক ১৬:১৬-এ বলা হয়েছে- “ইসমাঈলের জন্মের সময় ইবরাহীম ছিলেন ৮৬ বছর বয়সী”।
তাওরাত আদিপুস্তক ২১:৫-এ বলা হয়েছে- “ইসহাকের জন্মের সময় ইবরাহীম ছিলেন ১০০ বছর বয়সী”।

অর্থাৎ ইসহাক (আ.)এর জন্মের সময় ইসমাঈল (আ.) ছিলেন প্রায় ১৪ বছর বয়সী একজন কিশোর। তাই কুরআনের ভাষায় غُلَامٍ حَلِيمٍ বা ‘ধৈর্যশীল যুবক’ উপমাটি একমাত্র ইসমাঈল (আ.)এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।

এর পাশাপাশি তাওরাতের আদিপুস্তক ২১:৯-১২-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পাওয়া যায়- সারা (ইবরাহীম (আ.)এর স্ত্রী) ইসমাঈল (আ.)এর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে হাযারা ও তাঁর পুত্র ইসমাঈলকে ত্যাগ করতে বলেন। তখন ঈশ্বর ইবরাহীমকে বলেন- ‘সারার কথা মেনে নাও, কারণ ইসহাকের মাধ্যমেই তোমার বংশধারা চলবে’।

এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাওরাত ও বাইবেলে ইসমাঈল (আ.)এর বংশধারাকে উপেক্ষা করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। অথচ কুরআনুল কারীম ও নির্ভরযোগ্য ইসলামি ঐতিহাসিক সূত্রসমূহ সাক্ষ্য দেয়- আরব জাতির উৎপত্তি এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব ঘটেছে ইসমাঈল (আ.)এর বংশধারা থেকেই। এটাই সর্বজনগ্রাহ্য ও প্রমাণিত সত্য।

এ পর্যায়ে আমাদের প্রশ্ন হলো- হে ইহুদিগণ! তোমরা বলো, কুরবানির জন্য আদেশপ্রাপ্ত ‘একমাত্র পুত্র’ যদি ইসহাক (আ.) হতেন, তাহলে সেই সময় ইসমাঈলই (আ.) কোথায় ছিলেন? আর ইবরাহীম (আ.)-এর ‘একমাত্র পুত্র’ তো ইসহাক (আ.)এর জন্মের আগে একমাত্র ইসমাঈল (আ.) ছিলেন। তাহলে কীভাবে ‘একমাত্র পুত্র’ ইসহাক (আ.) হতে পারেন? (আল ইসরাঈলিয়াত ওয়াল মাওজুআত, পৃষ্ঠা- ২৫০)।

৪. গবেষকদের বক্তব্যের আলোকে বিশ্লেষণ:

গবেষকদের মতামত ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত বিস্তৃত, তাই এখানে কেবল নমুনাস্বরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

১. ইবনুল কায়্যিম (রহ.) তাঁর শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন- এই বিষয়ে ইতিহাসবিশারদগণের মাঝে মতভেদ নেই যে, আদনান ছিল হযরত ইসমাঈল (আ.)এর বংশ থেকে। সাহাবা, তাবেইন ও পরবর্তীদের বেশিরভাগই ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে যবীহ বা কুরবানির জন্য আদেশপ্রাপ্ত সন্তান তিনিই, অর্থাৎ হযরত ইসমাঈল (আ.)। ইসহাক (আ.)এর ব্যাপারে যে মত আছে, তা বহু দিক থেকে বিকৃত ও ভিত্তিহীন।

আমি শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.)কে বলতে শুনেছি, মূলত আহলে কিতাব থেকে বক্তব্য নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিকৃত ও মিথ্যা। কারণ, যেখানে বলা হয়েছে ‘তোমার একমাত্র পুত্রকে যবেহ করো’, সেখানে ইসহাক (আ.) তো প্রথম সন্তান নন, প্রথম সন্তান ছিলেন ইসমাঈল (আ.)। আবার ‘তোমার একমাত্র পুত্র’ বলা হয়েছে, অথচ ইসমাঈল (আ.) তখনও জীবিত ছিলেন।’

আরও পড়তে পারেন-

এরা এভাবে ধোঁকা দিয়ে বলে যে, তাদের সংগৃহীত তাওরাতে রয়েছে, ‘তোমার পুত্র ইসহাককে যবেহ করো’- যা তাদের সংগৃহীত তাওরাতের আগের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। ইহুদিরা ইসমাঈল (আ.)এর এই মহৎ গুণ হিংসার বশে অস্বীকার করে, কারণ তারা চায় শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে। (আল ইসরাঈলিয়াত ওয়াল মাওজুআত, পৃষ্ঠা- ২৫২)।

২. সাহাবিয়ে রাসূল, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন- যার পরিবর্তে দুম্বা কুরবানী করা হয়েছে, তিনি ছিলেন ইসমাঈল (আ.)। ইহুদিরা তাকে ইসহাক বলে ডাকে, যা একটি মিথ্যাচার। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড ৪, পৃঃ ১৯)।

৩. বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে কাব আলকুরাযী (১২০ হিজরী) বলেন- আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.)কে যেই পুত্রকে কুরবানির আদেশ দিয়েছেন, তিনিই হযরত ইসমাঈল (আ.)। এটি কুরআনে স্পষ্ট। কেননা কুরবানির পরে আল্লাহ ইসহাক (আ.) ও তাঁর বংশধর ইয়াকুবের সুসংবাদ দেন- فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ অর্থ- ‘অতঃপর আমরা তাকে (সারা) ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম এবং ইসহাকের পর (তার পুত্র) ইয়াকুবেরও’। আমি ইসহাককে এবং তার পরে ইয়াকুবকে শুভ সংবাদ দিলাম’। এতে ইসহাককে কুরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে বলাটা অসঙ্গত। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড ৪, পৃঃ ২০)।

৪. মুহাম্মাদ ইবনে কাব আলকুরাযীর বর্ণনা অনুসারে, যখন উমর ইবনে আবদুল আযীযকে জিজ্ঞাসা করা হল- যবীহ কে ছিলেন, ইসমাঈল নাকি ইসহাক- তখন মজলিসে একজন ইহুদি পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন যিনি পরে মুসলমান হয়েছেন। তিনি বলেন- আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর শপথ, যবীহ ইসমাঈলই ছিলেন। ইহুদিরা এ কথা জানে, কিন্তু আরবদের প্রতি ঈর্ষার বশে দাবি করে যে যবীহ ছিলেন ইসহাক। (ইবনে জারীর, তাফসীরুত তাবারী, খণ্ড ১০, পৃঃ ৫১৪)।

৫. বিখ্যাত ভাষাবিদ আসমায়ী একবার আবু আমর আলআলা (১৫৪ হিজরি)কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যবীহ কে ছিলেন?’ তিনি বলেন- তোমার বুদ্ধি-বিচার কোথায় গেল? ইসহাক কি কখনো মক্কায় ছিলেন? আর ইসমাঈল তো পিতার সঙ্গে মক্কায় কাবা নির্মাণ করেছেন। কুরবানীও তো মক্কায় হয়েছিল! (আবু হাইয়্যান আন্দালুসী, আলবাহরুল মুহীত, সূরা সাফফাত)।

৫. হজ্জ এবং ভৌগোলিক পটভূমি

হজ্জের প্রতিটি নিদর্শন- সাফা-মারওয়া, জমজম কূপ, কুরবানী, রমী জামারাত- সবকিছুই ইসমাঈল (আ.)এর জীবনের ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। কাবার নির্মাণ, হজ্জ আহ্বান, কুরবানী- সবই তাঁর জীবনকেন্দ্রিক। অতএব, হজ্জ ও যবীহুল্লাহ উভয়ের কেন্দ্রবিন্দু হযরত ইসমাঈল (আ.)।

সংশয়ের উৎপত্তি কেন?

ডঃ মুহাম্মদ আবু শাহাবাহ বলেন- ইবনে জারীর, বাগাভী ও ছাহিবে দুররে মনসুর সহ কিছু মুফাসসির, সাহাবা, তাবেইন ও কা’ব আহবার থেকে কিছু ভুল বর্ণনা উপস্থাপন করে বলেন যে যবীহুল্লাহ ইসহাক (আ.)।

মূলত যবীহুল্লাহ ইসহাক (আ.) হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো আহলে কিতাবের ইসরাঈলীয়াত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। কা’ব আহবারের মতো আহলে কিতাব থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারাই এসব প্রচার করছিলেন। পরে অনেক উলামায়ে কেরাম এসব বর্ণনায় সংশয়ের শিকার হয়েছেন। (তাফসীরে আলূসী, খণ্ড ২৩, পৃঃ ১৩৫-১৩৬)।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়; যথা-

  • কুরআনের ভাষা ও ক্রমবিন্যাস স্পষ্টভাবে যবীহুল্লাহকে হযরত ইসমাঈল (আ.)কে বলছে।
  • হাদিস, হজ্জ ও কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইসমাঈল (আ.) কে যবীহ হিসেবে নিশ্চিত করে।
  • সাহাবা, তাবেয়ীন ও অধিকাংশ মুহাক্কিক উলামাগণ এ মতই সমর্থন করেন।
  • ইহুদি ও খ্রিস্টীয় বিকৃত ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামের ইতিহাস হযরত ইসমাঈল (আ.)কে যবীহুল্লাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, উলূমূল হাদীস বিভাগ (১ম বর্ষ), জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।