।। সাদেক মাহবুব ।।
কুরবানী-এক অনন্য ইবাদত, যা প্রতি বছর ঈদুল আযহার পবিত্র মুহূর্তে আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত হয়, আর মুমিন হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে ত্যাগ ও আনুগত্যের সুপ্ত আকাক্সক্ষা। হাদীসের অমীয় বানী এই সুরের মূর্ছনাকে করে তোলে আরও গভীর, ব্যঞ্জনাময় ও হৃদয়গ্রাহী। প্রিয় নবী (সা.)এর প্রতিটি সুন্নাত যেন বিশ্বাস ও ভালোবাসার কাব্যময় অনুরণন, যা অন্তরকে আবদ্ধ করে এক মোহাবিষ্ট আলোয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত- “আদম সন্তানের জন্য কুরবানির দিনের কোনো আমল আল্লাহর কাছে এত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কুরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কিয়ামতের দিন এই পশুগুলো তাদের শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে। আর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দিত মনে কুরবানী করো”। (সুনানে তিরমিযী, হাদিস- ১৫৬৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস- ৩১২৬)।
এই হাদিস যেন ত্যাগের এক মহাকাব্য, যেখানে কুরবানির প্রতিটি ফোঁটা রক্ত বহন করে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সুসংবাদ, আর মুমিন হৃদয়ে সৃষ্টি করে ঈমানী উচ্ছ্বাস।
আরেক বর্ণনায় যায়েদ ইবনু আরকাম (রাযি.) হতে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) জিজ্ঞাসা করলেন- “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কুরবানী কী?”
নবী কারীম (সা.) উত্তরে বললেন- “এটি তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাত”। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস- ৩১২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস- ১৯২৮৩)।
এই হাদিস যেন ইতিহাসের সেই পবিত্র পাতা উন্মোচন করে, যেখানে হযরত ইব্রাহিম (আ.)এর আত্মত্যাগের গৌরবগাঁথা আজও প্রতিধ্বনিত হয় মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে। কুরবানী কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং তা এক ধারাবাহিকতা- ঈমান, ইখলাস ও আনুগত্যের যুগান্তকারী স্রোত, যা যুগে যুগে নবীদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে আজও আমাদের অন্তরে বহমান।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
কুরবানির এই ইবাদত কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এর রয়েছে এক বিশাল সামাজিক তাৎপর্যও। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “তোমরা নিজেরা খাও, অন্যদের খাওয়াও এবং কিছু সঞ্চয় করো”। (সহীহ বুখারী, হাদিস- ৫৫৬৯)।
এই হাদিস যেন সহমর্মিতার ঝরনা, যা ধনী-গরিব সকলের মধ্যে গড়ে তোলে ভালোবাসার এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন। কুরবানির গোশত যখন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে, তখন তা শুধু আহারের চাহিদা পূরণ করে না- বরং সমাজে সৃষ্টি করে পারস্পরিক সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে, কুরবানির বাহ্যিক রূপের চেয়ে অন্তরের বিশুদ্ধতা ও নিয়তের সততাই প্রধান।
হাদিসে এসেছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক অবয়ব ও সম্পদের প্রতি দৃষ্টি দেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি দৃষ্টি দেন”। (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ২৫৬৪)।
এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- লোক দেখানো আমল নয়, বরং খাঁটি তাকওয়াসম্পন্ন আমলই আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য। কুরবানির পশু নয়, কুরবানিদাতার অন্তরের খাঁটি অনুভবই প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়।
আসলে কুরবানী শুধু একটি পশু উৎসর্গের নাম নয়; এটি এক আত্মিক পরিশুদ্ধির অনুপম উপায়। অন্তরের পশুত্ব, অহংকার, স্বার্থপরতা ও কুপ্রবৃত্তির কুরবানিই এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ছিল এ ত্যাগের অনুপম আদর্শ- তিনি তাঁর সময়, শ্রম, সম্পদ- সবকিছুই উৎসর্গ করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাঁর প্রতিটি কর্ম ও পদক্ষেপ আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা কুরবানির আসল তাৎপর্য অনুধাবনে আমাদের সহায়ক।
তাই আসুন, আমরা কুরবানিকে হাদিসের সুরের মতো হৃদয়ে ধারণ করি, ত্যাগের মহাকাব্য হিসেবে পাঠ করি এবং এই ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে আত্মনিয়োগ করি। কুরবানির এই শাশ্বত শিক্ষা আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করুক, সমাজকে আলোকিত করুক, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে আমাদের রাহবার হোক- এই হোক আমাদের একান্ত প্রার্থনা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ (২য় বর্ষ), দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ