Home ওপিনিয়ন মিটফোর্ডের মর্মান্তিক ঘটনা ও বিএনপির অগ্নিপরীক্ষা

মিটফোর্ডের মর্মান্তিক ঘটনা ও বিএনপির অগ্নিপরীক্ষা

।। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ।।

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে ও উপর্যুপরি পাথর দিয়ে আঘাত করে একজন মানুষকে হত্যা করার দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও মর্মান্তিক। এমন বর্বরোচিত ঘটনার কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ব্যবসা ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে কোন্দলের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত। আরও জানা গেছে, এই নৃশংস ঘটনায় স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

দুঃখজনক হলেও সত্য, মিটফোর্ডের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো দৃষ্টান্ত নয়। গত ১১ মাসে দেশজুড়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি’র বিভিন্ন নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মারামারি ও বিশৃঙ্খলার বহু ঘটনার খবর ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর বিএনপির জন্য এমন ঘটনাগুলো নিঃসন্দেহে চরম লজ্জার ও হতাশাজনক। প্রায়শই দেখা যায়, এমন ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়, কিন্তু কয়েক মাস পেরোতেই আবার তাদের দলের সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চূড়ান্ত পর্যায়ে দুষ্টদের দল থেকে বিতাড়নের ঘটনা বিরল। সম্ভবত এই কারণেই দলের পরিচয়ধারী ধান্দাবাজ, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজেরা ব্যাপক আস্কারা পায়। তারা এটিকে ‘ছোটখাটো ঝামেলা এবং বড়সড় সুবিধা’ হিসেবেই গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতারই মর্মান্তিক ফল হলো মিটফোর্ডের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, যা হঠাৎ করে ঘটে যায়নি।

আরও পড়তে পারেন-

যদি বিএনপি এই ধারা বন্ধ করতে চায়, তবে তাদের চরিত্র ও আদর্শে নীতি-নিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, ক্ষমতায় থাকাকালেও বিএনপিতে নিজেদের দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক বেশি মাত্রায় সিদ্ধান্তহীনতা, বিলম্ব ও দুর্বলতা দেখা গেছে। দলের নেতিবাচক কাজে জড়িত নেতাকর্মীদের শক্ত হাতে এবং তাৎক্ষণিকভাবে দমন করার নজির খুব একটা নেই। ১৯৯১ এবং ২০০১, উভয় সময়পর্বেই এই দৃশ্য দেখা গেছে। দলীয়ভাবে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণেই ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ আর র‍্যাবের জন্ম হয়েছিল, যা ছিল বিএনপির প্রশাসনিক পদক্ষেপ; এবং দুটোই ছিল বিতর্কিত। ক্ষমতার গন্ধ নাকে লাগার আগেই যদি এখন যা শুরু হয়েছে, দল সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পরিণতি খারাপ হবে; যদিও বর্তমানে রাজনৈতিক ময়দানে আওয়ামী লীগ নেই।

বিএনপির একটি বড় সমস্যা হলো, ভেতরে-বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে দুর্বলতা, ভীতি এবং কালক্ষেপণ। দলের উপরের তলায় যারা কথায়, আচরণে, আবেগে, স্লোগানে দলের মূল লাইন লঙ্ঘন করছে, তাদের বিরুদ্ধে যেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না, তেমনি দলের নিচু তলায় যারা চাঁদাবাজি, বখরাবাজি, মাস্তানি করছে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে পারা নিয়ে বিএনপির ভেতরে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকট কাজ করছে। এই পরিস্থিতি তারই ফল। যেমন, ফজলুর রহমানরা একদিক দিয়ে দলের লাইন ক্রস করছেন, তেমনি মিটফোর্ডের হত্যাকারীরা আরেক দিক দিয়ে লাইন ক্রস করছেন। এদের বিরুদ্ধে ‘গালে থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করার মতো’ কোনো কঠিন পদক্ষেপ বিএনপি নিতে পারছে না। এই দ্বিধার কারণ সম্ভবত এই চিন্তা যে, ‘যদি নেতাটা চলে যায়! যদি কর্মীটা না থাকে!’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপি তার সমর্থক ও ভোটারদের বিশাল রিজার্ভ ও ভিত্তি সম্পর্কে এবং তাদের মনোভাব সম্পর্কে খুব কমই তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে।

দলের ভালো নেতাকর্মীদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু একটি পর্যায়ের পর বিএনপির মতো দলের এক লাখ দুষ্ট নেতাকর্মীকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেও কোনো সমস্যা নেই। বিএনপির প্রকৃত শক্তি ও প্রাণ তার সমর্থক ও ভোটারেরা। ১৯৭৫ পরবর্তী প্রেক্ষাপট এবং জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যে বিএনপির উত্থান, খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে দলটির বিকাশ, সেই বিএনপিকে অবশ্যই চিন্তা, কথা, আচরণ ও চরিত্রে সুপথে থাকতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে তার প্রভাব, সমর্থন ও বিশালত্ব টিকবে না।

কোনোভাবেই বিএনপিকে এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মেলানো যায় না। তবে উপরে-নিচে যদি এই ধরনের খারাপ কাজগুলো চলতে থাকে, তাহলে বিএনপি জনগণের সহানুভূতি হারাবে। নতুন বিবেচনা, প্রতিবাদ, প্রত্যাখ্যান এবং নতুন করে সবকিছুর বাছাই ও চেষ্টার একটি যুগ শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দৃঢ় ও সুস্থ পায়ে চলার মতো অনুশীলন বিএনপিকে করতে হবে।

লেখক: আলেমে-দ্বীন ও গবেষক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।