নারীদের সম্মান ইসলামের চেয়ে অধিক আর কেউ কোনো দিন দেয়নি। ভবিষ্যতেও দিতে পারবে না। অধিকারের ক্ষেত্রেও একই কথা। ইসলামই প্রথম নারীকে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে। নারীদের যখন জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, তখন ইসলাম তাদের বাঁচার অধিকার দিয়েছে। যখন নারীকে মৃত স্বামীর সাথে সহমরণের নামে জীবিত অবস্থায় চিতার আগুনে জ্বালানো হতো, ইসলাম তখন তাদের জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। সতী নামক প্রথায় সারা জীবন নারীকে যখন সামাজিক শাস্তি ও অপমান সয়ে যেতে হতো, ইসলাম তখন বিধবা বিবাহ উৎসাহিত করে নারীকে অভিশাপ ও গঞ্জনামুক্ত করেছে। নারী যখন পিতার মৃত্যুর পর পুত্রদের ব্যবহারের বস্তু বলে গণ্য হতো, তখন ইসলামই তাদেরকে মর্যাদা সম্মান ও গৌরবের মাতৃ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিলনা, ইসলাম প্রথম তাদের সংসারভুক্ত জীবনধারা ও দায়দায়িত্ব অনুপাতে সুষম বণ্টন দিয়েছে।
বর্তমানে ইসলামের শত্রুরা, যারা নারীরও শত্রু, নারীর সম্মান ও অধিকারের শত্রু, তারা বিশ্বব্যাপী নারীকে আরও মর্যাদাহীন ও অধিকারহারা করার জন্য সংস্কারের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলাদেশেও অপসংস্কৃতির এজেন্টরা ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী শক্তিকে নারীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলিম নারীর প্রতিনিধিত্ব করে না এমন ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিবিরোধী কতিপয় নারীকে পশ্চিমারা মাঠে নামিয়েছে, যারা নারীর অবাধ যৌন অধিকার লাভের স্লোগান নিয়ে এবং নিজেদের বেশ্যা দাবি করে তাদের হিস্যা বুঝে নেওয়ার কথা বলে প্লেকার্ড হাতে রাস্তায় নামতে পারে। এদের অনেকেই নারীর স্বাভাবিক গুণাবলি থেকে বঞ্চিত। অনেকেরই স্বামী-সংসার নেই। অনেকেই অনৈতিক দেহ ব্যবসায় জড়িত। অনেকে আবার নারী নির্যাতন ও মাদক ব্যবসার শিখ-ি। কিছু হিজড়া। আর কিছু রূপান্তরিত নারী বা পুরুষ। এদের জন্য রাষ্ট্র রয়েছে। আইন-কানুন রয়েছে। এদের অধিকার বা দাবি কর্তৃপক্ষ পূরণ করতে পারে। যেসব দাবি বৈধ বা যৌক্তিক সেসব রাষ্ট্র পূরণ করবে। যেসব অবৈধ বা অযৌক্তিক সেসব পূরণ করবে না। এখানে ইসলামকে প্রতিপক্ষ বানানো বা আলেম-ওলামাকে অপমান করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে পশ্চিমারা এ কাজটি করাচ্ছে। ইসলামের শত্রুরা যেকোনো অপকৌশল প্রয়োগ করে দেশের নারী সমাজকে ভুল বার্তা দিয়ে ইসলামের মুখোমুখি করছে। যেন তারা বোঝাতে চায় যে, নারীর অসম্মান, অমর্যাদা, (নাউযুবিল্লাহ) ইসলামী আইনেই রয়েছে। নারীর অধিকার না দেওয়ার জন্যও আলেম-ওলামারাই দায়ী।
বলা হচ্ছে, মসজিদে নাকি নারীদের হেয় করে খতিব সাহেবরা বয়ান করেন। সারা বছর দেশজুড়ে হাজার হাজার ওয়াজ-মাহফিলে নাকি আলেম-ওলামাগণ নারীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ান, যদিও এসব কথা মিথ্যা ও বানোয়াট। আলেমরা যদি নারীদের ক্ষুদ্র একটি অংশের বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকা-ের সমালোচনা করেও থাকেন তা কোনোভাবেই নারীর প্রতি বিদ্বেষ বা অবমাননা বলে বিবেচিত হতে পারে না। আলেমদের এসব নৈতিক উপদেশ, ধর্মীয় নির্দেশনা এবং সমাজ ও সভ্যতার পক্ষে জনগণকে শিক্ষিত সচেতন করে তোলার প্রয়াস। এটি তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।
তারা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে একথাই বলে থাকেন যে, কোনো নারী বা পুরুষ যদি ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাহলে তাদের উভয়কেই আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও পুরস্কার দেবেন। হাদীস থেকে প্রাপ্ত এসব কথা আলেমগণই বলেন যে, নারীরা পুরুষের বোন। দুনিয়ার মানুষ যেমন পরস্পরে ভাই ভাই, নারীরাও তেমন পুরুষের কাছে বোনের মতো। নারী আর পুরুষ জন্মগতভাবে একই প্রক্রিয়ায় দুইটি প্রজাতি হয়ে পৃথিবীতে আগমন করে, যা ভাই-বোনের মতো জন্ম প্রক্রিয়া। নারীদের জন্য কঠিন দায়িত্ব ও অধিক পরিশ্রমের কাজ ইসলামের নিয়ম ও বিধানে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সন্তান জন্মদানের মতো যে কঠিন ও মহতি দায়িত্ব পালন করে এবং সভ্যতার বুনিয়াদি ইউনিট তথা পরিবার গঠন লালন ও সম্যক সযতœ তত্ত্বাবধান করে, এর কোনো বিকল্প নেই। দুনিয়ার নবী রাসূল ও সকল পুরুষ কোনো না কোনো নারীরই সন্তান। নারীকে তারা পেয়েছেন মা বোন মেয়ে হিসাবে। স্নেহ, মায়া ও মমতাময়ী বহুরূপে আত্মীয়-পরিজন হিসাবে পেয়েছেন, পেয়েছেন জীবনের সঙ্গী হিসাবে। এজন্য নারীর মর্যাদা ও সম্মান অতুলনীয়। ইসলামে তাই নারীর ওপর পরিবারের সুরক্ষা, জীবিকা উপার্জন, লালন-পালন, ভরণ পোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
মানব জাতির সৃষ্টি থেকে আল্লাহতাআলা নারী ও পুরুষকে পরস্পরের জীবনসাথী হিসাবে তৈরি করেছেন। দুনিয়ায় এমন কোনো যুগ ছিল না যখন মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে মানুষ বিয়ে-শাদি করেনি, নারী-পুরুষের মিলনে সন্তান হয়নি এবং সংসার ও পরিবার ছিল না। ঈমানদার, কাফের, মুশরিক সবাই এই সংসার জীবন বা পারিবারিক রীতি পালন করে এসেছে। কোরআনের ভাষায় নারী ও পুরুষকে যাউজ বলা হয়েছে। যার অর্থ জোড়া। অন্যান্য ধর্মে এটিকে জোড়া বা জীবনসাথী না বলে বরং এমন সব শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ইসলামী ধারণার সাথে যায় না। যেমন : বাংলায় স্বামী, যার অর্থ অধিপতি বা মালিক। অপর দিকে স্ত্রী, যার অর্থ আশ্রিতা বা অসহায়। এখানে ইসলামপূর্ব জাহিলি সংস্কৃতির প্রচ্ছন্ন ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ ইসলামী ধারণায় পুরুষ কখনোই স্ত্রীর মালিক নয়, জীবনসাথী। যাউজ বা জোড়া। ক্বাওওয়াম বা জিম্মাদার ও দায়িত্বশীল। নারীকে বলা হয়েছে, যাউজাহ, অর্থাৎ জোড়া। নারী-পুরুষ মিলে জাওজান। পরিভাষায় বলা হয়েছে, রব্বাতুল বাইত, অর্থাৎ ঘরের মালকিন। জীবনসাথী অর্থে সাহেব বা সাহেবা। এর বেশি বা কম নয়।
ব্যাপক পড়াশোনা করেন, এমন মানুষের জানা থাকার কথা যে, ইসলামের আগে বা পরের অন্য ধর্ম ও মতবাদে নারীকে কীভাবে ছোট করে দেখা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের দরোজা বলা হয়েছে। শয়তানের এজেন্ট ও রাক্ষসী ডাইনি বলা হয়েছে। রমণ বা রতিক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য করে (নাউজুবিল্লাহ) তাদেরকে রমণী নাম দেওয়া হয়েছে। অক্ষম অবলা আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর ইসলাম নারীকে নাম দিয়েছে ব্যক্তি বা মানুষÑ আল মারআতু। পুরুষের নাম ব্যক্তি বা মানুষ হিসাবে যেমন, আল মারউ। আর কেউ এমন সম্মান মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারেনি। নারী শব্দটিতে লিঙ্গ বা যৌন পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠায় মুসলমানরা বেশি সম্মানসূচক শব্দে তাদেরকে মহিলা বলতে পছন্দ করেন। মহিলা অর্থ যিনি মহল বা গৃহের মালকিন। অন্য শব্দে আহলিয়া বা গৃহিণী।
অধিকারের বেলায় পৃথিবীর সব নারী স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের শক্ত কাঁধের ওপর ভর করে জীবনযাপন করে চলেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি হচ্ছে দুনিয়ার স্বাভাবিক ও বাস্তব নিয়ম। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম যা আছে তা বিশ্ব জনসংখ্যার তুলনায় না থাকার সমান। দর্শনে একটি কথা আছে, বিরল দৃষ্টান্ত থাকা, না থাকার মতোই। আর যুক্তিশাস্ত্রে এ কথা স্বীকৃত যে, ব্যতিক্রমী ঘটনার জন্য সাধারণ আইন বা বিধান প্রভাবিত হয় না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত সন্তানের মায়েদের পদতলে।
এক সাহাবী কার প্রতি সর্বাধিক উত্তম আচরণ করবেন জানতে চাইলে জবাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমার মায়ের প্রতি।’ অতঃপর কার প্রতি জানতে চাইলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমার মায়ের প্রতি।’ এরপর কার প্রতি, সে সাহাবী আবার জানতে চাইলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় বারও বলেন, ‘তোমার মায়ের প্রতি।’ সাহাবী চতুর্থ বার এরপর কার প্রতি এ কথা বললে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমার বাবার প্রতি।’
হাদীসে বর্ণিত এ ঘটনায় মায়ের সম্মান, মর্যাদা এবং সন্তানের নিকট থেকে উত্তম সদাচরণ লাভের যে অনন্য নির্দেশনা পাওয়া গিয়েছে, এর চেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা নারী জাতিকে আর কে কখন দিয়েছে বা দিতে পারে? তিন বার মায়ের গুরুত্ব বর্ণনার পর চতুর্থ বার বাবার কথা বলেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পৃথিবীর মুসলিম মায়েরা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা এর দেওয়া এই পরম সম্মান ও মর্যাদার গৌরবজনক অনুভূতি নিজেদের অন্তরে লালন করেন। নিজেদের পদতলে সন্তানের বেহেশত এই হাদীসটি তাদের পরিবার গঠন, সন্তান লালন ও মা হিসাবে সম্মানিত সফল ও গৌরবান্বিত বোধ করার বিশাল এক প্রেরণা, যা তথাকথিত নারীবাদী গোষ্ঠী কল্পনাও করতে পারে না।
কোরআন মাজীদে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করবেনা এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করবে। তাদের দুজন বা যেকোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে তাদের কোনো কথা বা আচরণে বিরক্ত হতে পারবে না, বিরক্তিসূচক শব্দও মুখ থেকে বের করবে না। তাদের প্রতি উচ্চকণ্ঠ হবে না। পিতা-মাতার প্রতি অতিশয় নম্র ও ভদ্র ভাষা ও শব্দে কথা বলবে। তাদের প্রতি দয়া-মায়া-মমতার ডানা বিনম্র চিত্তে বিছিয়ে দিবে এবং প্রার্থনায় বলবে, হে মালিক, আব্বা-আম্মার প্রতি আপনি দয়া ও রহম করুন, যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন করেছেন।’ আল কোরআন -সূরা বনী ইসরাঈল, : ২৩-২৪। কোরআনের অপর জায়গায় এসেছে, আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষকে আমি তাদের পিতা-মাতার প্রতি উৎকৃষ্ট আচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মানুষকে তার মা পেটে ধারণ করেছে কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে। আর তার বুকের দুধ পান করানোর মেয়াদ ছিল দুই বছর।’-সূরা লুকমান : ১৪। অপর আয়াতে বলেছেন, দতার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে অনেক কষ্ট সহ্য করে এবং তাকে ভূমিষ্টও করেছে কঠিনতন যন্ত্রণা সহ্য করে।’ সূরা আহক্বাফ : ১৫।
দুনিয়াতে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা ও শিরক না করার পাশাপাশি মানুষের প্রতি আল্লাহর অন্যতম প্রধান হুকুম হচ্ছে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ। কবিরা গোনাহ বা মহাপাপের তালিকায়ও আল্লাহর সাথে শরিক করার পর অন্যতম প্রধান মহাপাপ হচ্ছে পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
একশ্রেণির নারীবাদী নারীর প্রতি সম্মান এবং নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখাকে খারাপ অর্থে ব্যবহার করে। যখন কোনো ঈমানদার ব্যক্তি পরনারীর সাথে হাত মেলায় না বা ঈমানদার নারী অবাধে সব পুরুষের সাথে হাত মেলায় না, তখন একে তারা নারীর প্রতি অসম্মান কিংবা নারীর মনের সংকীর্ণতা বলে ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু এটি যে নারীর জন্য বেশি মর্যাদাকর এ কথা তাদের কে বোঝাবে?
একজন নওমুসলিম ইউরোপের ফ্রি মিক্সিং কালচারে মুসলিম নারীদের সবার সাথে হাত মেলানো বা মুসলিম পুরুষের সব নারীর সাথে হাতে মেলানোকে ইসলামে নিষিদ্ধ করার বিধানকে খুব তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘বৃটেনে অবাধ মেলামেশা ব্যাপক হলেও কোনো নাগরিক রানীর সাথে হাত মেলাতে পারে না। পরিবারের সদস্য বা পৃথিবীর দুয়েক জন ব্যক্তিই কেবল বৃটেনের রানীর সাথে হাত মেলানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন। বাইরের সুযোগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও আবার সরাসরি রানীর হাতে নয়; গ্লাভস পরা হাতে স্পর্শ করার অনুমতি পেয়ে থাকেন। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবি যে, ইসলাম ধর্ম তার অনুসারী প্রতিটি নারীকে এমন মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে, যে সম্মান বৃটিশরা কেবল তাদের রানীকে দিতে পেরেছে। দুনিয়াতে সর্বোচ্চ সম্মানিত ও মর্যাদাবান কিছু নারী, বিশাল সাম্রাজ্যের রাণী হওয়ার সুবাদে নিজের জন্য যে ধরনের প্রটোকল, যে বিরল সুরক্ষা, সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষণ করতে পেরেছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের কোটি কোটি নারীকে একটি বিধানের দ্বারা সেই সম্মানে ভূষিত করে গেছেন। আমার ইসলাম গ্রহণের অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি।’ আল্লাহু আকবার। সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি সুহানাল্লাহিল আজিম।
বাংলাদেশে সম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন অনেক দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে অনেক প্রস্তাবনাও রয়েছে, যার ইতিবাচক সবকিছুই প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই ইসলামী বিধানে দেওয়া আছে। কোনো কোনো প্রস্তাব এমন আছে, যা মানব সভ্যতা, পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা বিরোধী। এসব বিষয়ে দ্বিমত করার অধিকার যে কারও থাকা উচিত। বিশেষ করে, কিছু প্রস্তাব এমন করা হয়েছে, যা সরাসরি এদেশের শতকার ৯২ ভাগ মানুষের বিশ্বাস ও চেতনািেবরাধী। এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ, নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং কমিশনের প্রস্তাব বাতিলের দাবি তোলা কোনো দোষের কথা নয়। কমিশনে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ রাখার কথা বলা দোষের কিছু নয়। এমন একচোখা কমিশন ভেঙে দেওয়ার দাবিও অযৌক্তিক বা বাড়াবাড়ি নয়। কমিশন যদি জনগণের অধিকারে বিশ্বাসী হতো তাহলে তারা ৯২ ভাগ মানুষের ধর্মীয় বিধান অস্বীকার করে এসব প্রস্তাবনা আনতে পারত না। সরাসরি কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী এমন প্রস্তাবও এসেছে, যা কোনো স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ কিংবা ধর্মদ্রোহী জালেম শাসকও বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করেনি। মুক্ত চিন্তা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির প্রবক্তা একদল নারী এ দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে নজিরবিহীন অনধিকার চর্চা ও ক্ষমার অযোগ্য সীমালঙ্ঘন করেছে। কমিশনের প্রস্তাবে সুস্পষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে, ‘নারীদের অধিকার ও মর্যাদার পথে বাধা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের বিধান।’ এখানে প্রশ্ন ওঠে যে, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ১৫ কোটি মানুষের ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে তাদেরকে অধিকার দেওয়ার দায়িত্ব এই কমিশনকে কে দিয়েছে? তারা উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীকে পুরুষের সমান অংশ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এতে করে তারা কি বিবাহপ্রথা, সন্তানদের আশ্রয়স্থল পরিবার, সম্পদের সুষম বণ্টনে চলা সমাজ এবং নারী-পুরুষের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানে তৈরি ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা ভেঙে তছনছ করে দিতে চান?
তাদের এই অসম্ভব ও দৃষ্টান্তহীন চিন্তার ফলে বহু মানুষকে এমন কথাও বলতে শোনা যাচ্ছে যে, বিয়ের সময় পুরুষ মহিলাকে কেন দেনমহর দেবে? কেন নারীকে সারাজীবন খোরপোষ দেবে? কেন তার বাসস্থান, চিকিৎসা, সাজ-সজ্জা, বিনোদন, সামাজিকতা, বেড়ানো, খেলানোর ব্যয় বহন করবে? কেন সন্তান-সন্ততির যাবতীয় দায়-দায়িত্ব, পড়াশোনা, বিয়ে-শাদি, প্রতিষ্ঠা, সঞ্চয় ও উত্তরাধিকার সম্পত্তি রেখে যাওয়ার ভার বহন করবে? যদি নারী-পুরুষের অধিকার সবক্ষেত্রে সমান হয় তাহলে দেন মোহরের পাশাপাশি সন্তানাদিসহ নারীর গোটা জিন্দেগির জীবনযাপনের ব্যয় ভারও সমানভাবে উভয়ের ওপর বর্তাক। এসব ইসলাম বিরোধী, প্রকৃতি বিরোধী ও মানব স্বভাববিরোধী বাজেকথা বলাবলির জন্য মূলত দায়ী ও অপরাধী হচ্ছে এই অবিবেক একদেশদর্শী কমিশন, যারা টক শোতে এসে বলেন, আমরা এসব প্রস্তাবনা ও প্রতিবেদন তৈরির সময় ধর্মের কথা ভাবিইনি। সম্পূর্ণ ইহজাগতিক চিন্তা থেকে সব মানুষের জন্য এ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছি। ইচ্ছা করলে কেউ মুসলিম রীতিও অনুসরণ করতে পারবে। আর যাদের ইচ্ছা তারা কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী এই বিধান গ্রহণ করতে পারবে।
চিন্তাশীল বিচক্ষণ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে, এদেরকে শুধু মুর্খ বললেও কম বলা হবে। যারা ৯২ ভাগ মুসলমান, যাদের মোট সংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, তাদের জন্য আইন তৈরি করার সময় শুধু ইহজাগতিকতা বা ধর্মহীনতাকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। যাদের বিশ্বাস, চিন্তা, শিক্ষা বা কর্মে পরজগতের কোনো ধারণাই নেই তারা কী করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ৯২% আর অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী বাকি ৮% মানুষের জন্য আইন ও বিধান রচনার প্রস্তাব তৈরি করেন, তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়গুলোর একটি।
মুসলমানদের প্রতি ইসলাম মানা বা না মানার অপশন রেখে আইন তৈরি করে ক্ষমতার জোরে তা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এরা যে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। এর নাম কি পাগলামি না ঔদ্ধত্য, সেটিও ভাবার বিষয়। এই দুঃসাহস, অনধিকার চর্চা ও অন্যায়কে চিহ্নিত করে কোনো নাগরিক যদি নিজের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা বলে তবে তার বিরুদ্ধে মামলা, হামলা বা এরও অধিক কিছু করা নারীবাদী গ্রুপের পক্ষে সম্ভব। কারণ, এরা ইসলামের শত্রুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন। আলেমসমাজ বা ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি ধর্মীয় পরিভাষায় তাদেরকে নাস্তিক, মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহী বলেন তাহলেও এরা অপমান বোধ করে এবং শত্রুতায় নেমে পড়েন। নিজেদের অপরাধ স্বীকার না করে সত্য কথা বলা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সংঘবদ্ধভাবে মিডিয়া ট্রায়াল ও মিথ্যা প্রোপাগা-ার যুদ্ধ শুরু করেন।
একটি প্রস্তাবে তারা নারীদের সেক্স বাণিজ্যকে নতুন একটি নাম দিয়ে বলতে চান, তাদেরকে যৌনকর্মী বলা হবে এবং এসব কর্মীকে শ্রমিকের স্বীকৃতি দিতে হবে। হেফাজতে ইসলামের এক প্রতিবাদ সভায় দুয়েকজন বক্তা এসব প্রস্তাব পাশে আগ্রহী যৌনকর্মীকে কিছুটা পুরনো নামে উল্লেখ করায় তারা বেশ আহত হয়েছেন। তাদেরকে ‘সেক্স ওয়ার্কার’ না বলে বক্তারা কেন ‘বেশ্যা’ বললেন, এজন্য তাদের প্রতি কেউ কেউ উকিল নোটিশ প্রেরণ করেছেন। তাদের কেউ কেউ আবার বেশ্যা শব্দটি নিজের ওপরও টেনে নিয়েছেন। যদিও হেফাজতের বক্তারা ঢালাওভাবে সবাইকে বেশ্যা বলেননি। তারা কেবল যৌনকর্মী ও যৌনকর্মকে শ্রমের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে মাঠে নামা নারীদের উদ্দেশ্যেই এ কথা বলেছিলেন। এসব নিয়ে যারা আলেমসমাজ ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে গালমন্দ করছেন তাদের জানা নেই যে, বাংলাভাষায় বেশ্যা শব্দটি ‘ব্যবসা’ থেকে এসেছে। কলকাতায় দেহ পসারিনী বা দেহ ব্যবসায়ী নারীদের ব্যবসায়ী বলা হতো। এরপর চলিত বাংলায় বেবুশ্যে, এরপর আরও সংক্ষেপে বেশ্যা বলা হতে থাকে। আগেই হারাম ব্যবসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত একটি পেশাকে নতুন করে শ্রমিকের স্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হচ্ছে। অনেকে আবার তাদেরকে সেক্স ওয়ার্কার না বলে সেক্স মার্চেন্ট বলাই অধিক সমীচীন মনে করেন। পাশ্চাত্যে যেমন সেক্স ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়। হেফাজতের বক্তারা তো বেশ্যা শব্দটি ব্যবহার করে খুব একটা অপরাধ করেছেন বলে মনে করার কারণ নেই। যদিও হেফাজত তাদের উকিল নোটিশের জবাবে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে বিবৃতি দিয়েছে। এটি সম্ভবত আইনগত ঝামেলা এড়ানোর জন্যই। কারণ, এদেরকে যারা মাঠে নামিয়েছে তারা অনেক শক্তিশালী এবং বিদেশি শক্তির শিখ-ি।
মুসলিম নারীরা বেশ্যা, পতিতা, দেহ ব্যবসায়ী, দেহ পসারিনী, দেহজীবীÑ এসব শব্দ যেমন পছন্দ করে না, যৌনকর্মী বা যৌন শ্রমিক নামকরণও তেমনই পছন্দ করে না। এ ধরনের পেশা মুসলিম নারী-পুরুষ মাত্রই অবৈধ বলে গণ্য করেন। ইসলাম এই পেশা সমর্থন করে না। ইসলাম এদের পুনর্বাসনের পক্ষে। সমাজ সংসারে ফিরিয়ে আনার পক্ষে। নারী কমিশন এদের কী নাম দেবে বা ক্ষমতাসীনরা একে ব্যবসা, শ্রম বা শিল্প কোন ক্যাটাগরিতে বৈধতা দেবেন সেটা তাদের বিষয়। কেননা নারী কমিশনের সদস্যরা লিখেই দিয়েছেন, তারা ইহজাগতিকতার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এখানে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, পরজগতে বিশ্বাসী ৯২ ভাগ মুসলমানের জন্য এই সংস্কার প্রস্তাব তারা করলেন কী বুঝে? এমন ধর্মবোধবিহীন সংস্কার প্রস্তাব যারা করলেন, তাদের বুদ্ধি, বিবেক, শিক্ষা, যোগ্যতা কেবল নয়, মানসিক সুস্থতা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে।
তারা অবলীলায় বলেন, প্রস্তাবনা ও প্রতিবেদন তৈরির সময় আমরা ধর্মের বিষয়টি মাথায়ই রাখিনি। যদি তাদের কেউ এমন প্রশ্ন করতো যে, তাহলে কি আপনারা এলিয়েনদের জন্য এই নীতি তৈরি করেছেন? নাকি কোনো ধর্মহীন নাস্তিক জাতির জন্য? বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধর্মের নারীর জন্য একটি সিভিল আইন করার সুপারিশ আপনারা কীভাবে করতে পারলেন? তারা কি আপনাদেরকে বলেছে যে, আমাদের নিজ নিজ ধর্ম আমাদেরকে স্বাধীনতা, সম্মান ও অধিকার দেয়নি। আপনারা একদল লোক কমিশনে বসে আমাদেরকে উদ্ধার করুন। যারা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাদের সামনে পৃথিবীর কোন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের রাষ্ট্র, সমাজ বা সংস্কৃতির মডেলটি ছিল সেটিও তারা খোলাসা করছেন না। ১৯০ বছর বৃটিশরা এই দেশ শাসন করার সময় যে পারিবরিক আইন পরিবর্তন করলো না, এরপর দেশীয় লোকের শাসনের ৭০ বছরে যে আইনে কেউ হাত দিল না, নোবেল জয়ী ড. ইউনুস সাহেবের ৫/৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে তারা কিছু এনজিও ব্যবসায়ী নারীবাদী নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে স্থান পেয়ে এমন একটি কাজ করে বসলেন।
কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, আমরা তো এমন আইন বাধ্যতামূলক করতে বলিনি, কেউ ইচ্ছা করলে মুসলিম আইনও মানতে পারবে। মুসলমানদের জন্য তথাকথিত ইহজাগতিক ও কোরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন তৈরি করে মুসলিম পারিবারিক আইনকে ঐচ্ছিক পর্যায়ে ঠেলে দেওয়ার অধিকার তাদেরকে দিয়েছে, এটাকি তারা বলবেন? অথচ মুসলমানের জন্য আবশ্যিক ক্ষেত্রে ইসলামের আইন না মেনে অন্য কোনো বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। এতে তারা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মত্যাগী বা মুরতাদ হয়ে যায়। ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। যে কেউ সন্দেহ করতে পারে যে, কমিশনের কোনো কোনো নারী উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলমানদের বিরাট একটি অংশকে ইসলাম থেকে নাম কাটিয়ে অমুসলিম হয়ে যাওয়ার প্রতি প্ররোচিত করছেন। প্রচ্ছন্নভাবে তারা বিয়েকে নিরুৎসাহিত করছেন। দেনমোহর, ভরণ-পোষণ, সন্তান লালন ও পরিবার গঠন থেকে নারী পুরুষকে বিরত রেখে পশ্চিমা উচ্ছন্ন সমাজ-সংস্কৃতি গ্রহণে উৎসাহিত করছেন। উত্তরাধিকারের সুষম বণ্টন রীতি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ভাই-বোনের মধ্যে মামলা, হামলা, যুদ্ধ বাঁধাতে চাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও তরুণীদের বৈধ শ্রম অথবা ব্যবসা হিসাবে যৌনকর্মকে গ্রহণের জন্য উজ্জীবিত করছেন। তারা বিয়ের পবিত্র বন্ধনের পরিবর্তে এলজিবিটিকে মার্কেটিং করছেন। সমকামী সমাজ ও যৌন নৈরাজ্য সৃষ্টির পায়তারা করছেন। নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক পরিচয় বিলুপ্ত করে তাদের মধ্যে ট্রান্স জেন্ডার মতবাদ তথা রূপান্তরের প্রহেলিকা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব তারা করছেন কি করছেন না তা তারাই জানেন। তবে, সাধারণ নাগরিকদের এমন মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব এবং বহুভাষা ইতিহাস রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্ববিদ।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ