জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থীদের নিয়ে ‘জমিয়ত প্রার্থীদের নির্বাচনী ভাবনা’ ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের আয়োজনে থাকছেন গাজীপুর-২ আসনের খেজুরগাছ প্রতীকের প্রার্থী মুফতি নাছির উদ্দিন খান।
গাজীপুর-২ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল সংসদীয় আসন। প্রায় ৭,৭৯,৭২৬ জন ভোটারের এই আসনটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক অঞ্চল এবং শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতির কারণে এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময়ই কৌশলগত দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
মুফতি নাছির উদ্দিন খান ১৯৯৭ সাল অর্থাৎ ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী ও মাওলানা মহিউদ্দিন খানকে তিনি তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেন। ছাত্র জমিয়তের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালনের পর তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় জমিয়তের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স সমমান), আলিয়া থেকে কামিল এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। এই বহুমাত্রিক শিক্ষাগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজ ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে চান।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মুফতি নাছির উদ্দিন খান-এর ভাবনা কী? তারই উত্তর খুঁজেছেন উম্মাহ’র নিজস্ব প্রতিনিধি, মুহাম্মদ নূর হোসাইন।
উম্মাহ: ছাত্র রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাতীয় রাজনীতিতে কীভাবে কাজে লাগাতে চান?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে আমি প্রার্থী হয়েছিলাম। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর গাজীপুর-২ আসনে ‘খেজুর গাছ’ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। তবে চারদলীয় জোটের শরিক হিসেবে শেষ পর্যন্ত ধানের শীষের প্রার্থীকে সমর্থন দেই এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে যে, ভবিষ্যতে এই আসন জমিয়তের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। অতীতে আমরা অধ্যাপক এম. এ মান্নান সাহেব ও জনাব হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করেছি। বর্তমানে যারা এই আসনে প্রার্থী হতে চাইছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় আমরা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও প্রবীণ।
উম্মাহ: আপনি নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের কোন সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকার দেবেন?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: গাজীপুর-২ একটি শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চল। আমি নির্বাচিত হলে শ্রমজীবী মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে ফুটপাত সংস্কার, গাজীপুর মেডিকেল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ সেবাদান উপযোগী করা এবং অন্যায়-দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে।
উম্মাহ: গাজীপুর-২ থেকে আপনার জয়লাভের সম্ভাবনা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে আমাদের বিজয় শতভাগ নিশ্চিত।
উম্মাহ: ইসলামী রাজনীতিকে জনপ্রিয় করতে কী ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: এদেশের মানুষ বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এখন তারা দিন দিন ইসলামী অনুশাসনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমি একজন ইসলামী চিন্তাধারার মানুষ হিসেবে ইসলামের সৌন্দর্য ও কল্যাণমূলক দিকগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। রমজান ও ঈদ উপলক্ষে পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করেছি। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে আমাদের বিলবোর্ড এখনো দৃশ্যমান। দলীয় প্রতীক ও প্রার্থীর পরিচিতি বাড়াতে মোটর শোভাযাত্রা করেছি এবং গণসংযোগ জোরদার করেছি। মসজিদ, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামী দল ও প্রতীকের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
উম্মাহ: বর্তমান প্রজন্মের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: গাজীপুর একটি অর্থনৈতিক অক্সিজেন অঞ্চল। এখানে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা ইতোমধ্যে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো বহু কর্মসংস্থানের সুযোগ খালি আছে। উৎপাদন কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেলে নতুন করে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। আমি বিশ্বাস করি, উদ্যোগী তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া আমার অন্যতম অঙ্গীকার।
উম্মাহ: নারীদের নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বিষয়ে কী উদ্যোগ নিতে চান?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, এবং শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর মাঝেও তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তাই নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ, আবাসন, স্যানিটেশন সুবিধা এবং মাতৃত্বকালীন পরিচর্যা নিশ্চিত করা জরুরি। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে নারীরা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে অংশ নিতে পারবে। আমরা এ লক্ষ্যে কাজ করব। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে নারীদের জন্য আলাদা ইউনিট, প্রবেশ ও প্রস্থানের ব্যবস্থা এবং তাদের সম্মান, চরিত্র ও জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
উম্মাহ: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে আপনার পরিকল্পনা কী?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: ইসলাম পরমতসহিষ্ণু ধর্ম। এ ধর্ম মানুষকে শিখায় সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের প্রতি সদাচরণ করতে এবং তাদের মর্যাদা দিতে। আমার নির্বাচনী এলাকার সকল সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্যে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দল সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে উদযাপন করতে পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করব।
উম্মাহ: আসন্ন নির্বাচনকে আপনি কীভাবে দেখছেন—সহযোগিতাপূর্ণ না প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: আসন্ন নির্বাচন যেমন আশার সঞ্চার করে, তেমনি কিছু শঙ্কার কথাও মানুষ বলছে। নির্বাচন যথাসময়ে হবে কিনা এবং ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত হবে কিনা—এসব প্রশ্ন থাকলেও আমরা আশাবাদী যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটকে উৎসবমুখর করতে আমরা দলীয় নেতাকর্মীদের যথাযথ নির্দেশনা দিচ্ছি। ভোটারদেরও আহ্বান জানাব, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে আপনারা সক্রিয় ও সচেতন থাকুন।
উম্মাহ: আপনার আসনে অন্যান্য প্রার্থীদের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: অন্যান্য প্রার্থীদের প্রতি আমি বলতে চাই, আমরা সবাই ভাই ভাই। নির্বাচন হলো ক্ষমতা পরিবর্তন ও জনসেবা করার একটি সুযোগ, যা নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমেই আসে। তবে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি যেমন জনসেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করবেন, তেমনি যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হতে পারবেন না, তারাও যেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজসেবায় অবদান রাখেন, এটাই আমাদের কাম্য। আমি মনে করি, যোগ্য প্রার্থীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে থাকবেন এবং মানুষ তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতেই ভোট দিয়ে বেছে নেবেন। গাজীপুর-২ আসনে আমরা পুরোনো। এই এলাকার প্রতিটি রাস্তাঘাট ও জনপদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় রয়েছে। সব মিলিয়ে এই আসনে মানুষ তাকওয়া, খোদাভীতি এবং বাহ্যিক যোগ্যতার ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
উম্মাহ: আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন হবে?
মুফতি নাছির উদ্দিন খান: ন্যায় ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমার স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত থাকবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নাগরিক সব অধিকারই জনগণের প্রাপ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ কারো উপর অন্যায়ভাবে জুলুম করবে না। সবাই মিলেমিশে গড়ে তুলবে একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক রাষ্ট্র। নিঃসন্দেহে ইসলাম একটি বৈষম্যমুক্ত ধর্ম, আর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরাও সেই আদর্শকে ধারণ করে একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করছি। আমাদের বিশ্বাস, আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি বৈষম্যমুক্ত কল্যাণরাষ্ট্র।
পরিশেষে, উম্মাহ২৪ ডটকমের সম্মানিত সম্পাদক, কর্মকর্তা, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আমার প্রাণপ্রিয় গাজীপুর-২ আসনের জনগণের কল্যাণ ও সফলতা কামনা করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার মতামত পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
উম্মাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ