Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়: প্রাসঙ্গিকতা, উদ্দেশ্য এবং দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কা

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়: প্রাসঙ্গিকতা, উদ্দেশ্য এবং দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কা

।। মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রস্তাব কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সংঘাতের মতো জটিল ইস্যু। এই উদ্যোগকে ঘিরে বিভিন্ন মহল থেকে যে উদ্বেগ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, তা মোটেই অমূলক নয়। বরং এর প্রতিটি দিক নিয়েই বিস্তারিত এবং যৌক্তিক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি সত্যিই অস্থিতিশীল?

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় সাধারণত সেসব দেশে স্থাপিত হয়, যেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি চরমভাবে বিপর্যস্ত, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে অথবা যুদ্ধাবস্থা চলছে। যেমন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকা কয়েকটি দেশে তাদের কার্যালয় আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি সে রকম?

স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক বেশি সংহত ও নিরাপদ। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে, যা আগের ১৫ বছরে ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশে একটি মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন ওঠে। যদি সত্যিই মানবাধিকার লঙ্ঘন তাদের উদ্বেগের কারণ হতো, তাহলে গত ১৫ বছরে যখন বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন এবং নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছিল, তখন তারা কেন নীরব ছিল? ওই সময় কার্যালয় স্থাপনের কথা একবারও উচ্চারিত হয়নি। এই নীরবতা থেকে স্পষ্ট হয় যে, তাদের বর্তমান আগ্রহের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

দ্বিমুখী নীতি: বৈশ্বিক ব্যর্থতা ও বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ

জাতিসংঘ এবং তার মানবাধিকার কমিশনের দ্বিমুখী নীতি বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র কয়েকটি দেশে তাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় আছে। মানবাধিকার লংঘনের যেসব ভয়াবহ ঘটনা বিশ্বে ঘটে চলেছে, সেদিকে তাদের মনোযোগের অভাব সুস্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, বর্ণবাদী সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটলেও সেখানে কোনো কার্যালয় নেই। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতন এবং গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু সেখানেও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন কোনো স্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করেনি।

অপরদিকে, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা সংকটসহ বিশ্বের বহু জটিল সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আফগানিস্তান ও ইরাকে পশ্চিমা আগ্রাসন— কোনো ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ তার মূল লক্ষ্য, অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সফল হতে পারেনি। এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, জাতিসংঘ প্রায়শই শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এমন একটি প্রশ্নবিদ্ধ আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম যখন বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হতে চায়, তখন এর পেছনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ওপর আঘাতের শঙ্কা

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীসহ দেশের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকারের নামে ইসলামী শরিয়াহ, পারিবারিক আইন, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায়। ইসলামী নির্দেশনা অনুযায়ী বিবাহ, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, এবং সম্পত্তির অধিকারের মতো বিষয়গুলোতে যেসব সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে, সেগুলোকে এসব সংস্থা তাদের ‘মানবাধিকার’ ধারণার পরিপন্থী মনে করে।

আরও পড়তে পারেন-

সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ হলো, এসব সংস্থা সমকামিতা, অবাধ যৌনাচার এবং লাগামহীন জীবনধারাকে মানবাধিকার হিসেবে সমর্থন করে। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে যেখানে ইসলামী নীতি ও মূল্যবোধ সমাজের ভিত্তি, সেখানে এ ধরনের কার্যক্রম জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। দেশের মানুষ আশঙ্কা করছে, যদি এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপিত হয়, তবে তা দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিতর্কিত মনোনয়ন এবং সরকারের অবস্থান

এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক হিসেবে রিচার্ড এস হাওয়ার্ডের বিতর্কিত মনোনয়ন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তিনি একজন সমকামী এবং তার সঙ্গীকে নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চান। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে, যেখানে সমকামিতাকে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, সেখানে একজন সমকামী কূটনীতিককে নিয়োগ দেওয়া ৯২% মুসলমানের প্রতি চরম অবজ্ঞা এবং অবমূল্যায়ন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কীভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা বোধগম্য নয়। দেশের সরকারের উচিত হবে না এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মেনে নেওয়া।

পরিশেষে বলা যায়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের এই পাঁয়তারা কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোকে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। একইসাথে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই দেশের জনগণের অনুভূতি এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনোভাবেই দেশের মাটি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো পদক্ষেপকে সমর্থন করা সমীচীন হবে না এবং দেশের জনগণ এটা মেনে নিতে পারে না। সংশ্লিষ্টদের বোধোদয় হোক; এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমীয়া ঢাকা, খতীব- বায়তুন নূর জামে মসজিদ, উত্তরা, ঢাকা এবং সহসভাপতি- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নায়েবে আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।