।। মাওলানা মুনির আহমদ ।।
বর্তমান বিশ্ব একের পর এক যুদ্ধ, সংঘাত এবং মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি, সুদান ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ—সবখানেই হাজারো নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে: জাতিসংঘ আসলে কী করছে? যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা কি আজ আর কার্যকর আছে? ড. মো. ফখরুল ইসলামের লেখার মূল বক্তব্য অনুসরণ করে বলা যায়, জাতিসংঘ যেন বড় শক্তিগুলোর হাতের পুতুল, যা কেবল বিবৃতি আর প্রস্তাব দিয়েই দায়িত্ব সারছে, কিন্তু বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
ভেটোর অভিশাপ: জাতিসংঘের অক্ষমতার মূল কারণ
জাতিসংঘের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো এর নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবস্থা। মাত্র পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন—এই বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে। এই ক্ষমতা তাদের যেকোনো প্রস্তাবকে একাই বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ দেয়। ফলে, যখনই কোনো একটি বৃহৎ শক্তি বা তার মিত্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে, তখনই ভেটো প্রয়োগ করে সেই পদক্ষেপকে আটকে দেওয়া হয়।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার নারী ও শিশু নিহত হলেও জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব কার্যকরভাবে গৃহীত হয়নি। প্রতিবারই ভেটোর কারণে তা আটকে গেছে। একইভাবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও আমরা দেখেছি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সংস্থাটির নিষ্ক্রিয়তাকেই প্রমাণ করে। জাতিসংঘ কেবল নিন্দা জানায়, বিবৃতি দেয়, কিন্তু কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে না। এটি একটি আন্তর্জাতিক ‘বাবুরাম সাপুড়ে’র গল্পের মতো হয়ে গেছে—খেল দেখাচ্ছে, কিন্তু কোনো বিষধর সাপকে মারতে পারছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকা ও দ্বিমুখী নীতি
জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাশাপাশি বিশ্বশান্তির পথে আরেকটি বড় বাধা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকা এবং তাদের দ্বিমুখী নীতি। নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের রক্ষক ও শান্তির দূত হিসেবে প্রচার করলেও, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র বারবার তাদের নিজেদের স্বার্থের পক্ষে যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে মার্কিন হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অথচ, মার্কিন ভেটোর ভয়ে জাতিসংঘ সেই আগ্রাসন রুখতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরতার সময়ও যুক্তরাষ্ট্র নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে বা নীরব থাকে, যার ফলে জাতিসংঘের অবস্থানও প্রভাবিত হয়। এই দ্বিমুখী নীতির কারণে যুদ্ধ শুধু দীর্ঘস্থায়ীই হয় না, বরং ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সংহতির ধারণাটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘মাতব্বরী’ বন্ধ না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না।
আরব বিশ্বের উদাসীনতা ও ভণ্ডামি
জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকার পাশাপাশি আরব বিশ্বের নেতাদের চরম উদাসীনতাও ফিলিস্তিন সংকটের মতো বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তুলেছে। গাজায় যখন হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নারী, শিশু ও পুরুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন আরব নেতারা যেন এক নীরব দর্শক। তারা কেবল বিবৃতি দিয়ে দায় এড়িয়ে চলছেন, যা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি করে।
এই নেতারা একদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেন। এই ভণ্ডামি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে গুরুত্বহীন করে তুলছে এবং ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। ড. মো. ফখরুল ইসলামের লেখায় যেমন উঠে এসেছে, আরব নেতাদের এই উদাসীনতা তাদের নিজেদের গদি বা স্বার্থে আঘাত না হানার কারণেই। তাদের এই ভণ্ডামিই ফিলিস্তিন সংকটকে দিন দিন আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলছে।
সমাধানের পথ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে প্রশ্ন, এই সংকটের কোনো সমাধান কি নেই? এই সমস্যার সমাধান নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সদিচ্ছা, ন্যায়বিচারভিত্তিক কূটনীতি এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের আন্তরিক পদক্ষেপের ওপর।
প্রথমত, জাতিসংঘকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর সংস্থায় রূপান্তরের জন্য কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। ভেটো ক্ষমতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং মানবাধিকার ও যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাবগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
দ্বিতীয়ত, আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি করতে হবে। তাদের শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি না দিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন—ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলার উদ্যোগ নেওয়া।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্বজনমত গঠন করে যুদ্ধবিরোধী চাপ তৈরি করা জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে বিভাজন থাকলে শক্তিশালী কণ্ঠে নিজেদের অধিকারের দাবি তোলা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করা গেলে ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্রগুলো আগ্রাসনের আগে দশবার ভাববে।
জাতিসংঘের নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তা এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এই সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কিন্তু আজ তা শক্তিধর দেশের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত এক নিরুপায় দর্শকে পরিণত হয়েছে। এখন সময় এসেছে জাতিসংঘকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করে একে নিরপেক্ষ, কার্যকর এবং মানবতার পক্ষে সোচ্চার করে তোলার। অন্যথায়, এই প্রতিষ্ঠান ইতিহাসে ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
লেখক: শিক্ষক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, সম্পাদক- উম্মাহ।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ