Home ওপিনিয়ন ভারত কাশ্মীর নিয়ে আমার লেখা বইকে কেন এত ভয় পাচ্ছে?

ভারত কাশ্মীর নিয়ে আমার লেখা বইকে কেন এত ভয় পাচ্ছে?

আল জাজিরায় প্রকাশিত এই নিবন্ধে কাশ্মীর টাইমস-এর ম্যানেজিং এডিটর অনুরাধা ভাসিন তার বই নিষিদ্ধ হওয়া এবং এর পেছনের কারণ নিয়ে আলোকপাত করেছেন।

বইটির লেখক এমন একটি ব্যবস্থার নিন্দা করেছেন, যা নীরব বা পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এবং এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের (J&K) সমস্যাগুলো মানুষের কাছে সংবেদনশীলতা হারাচ্ছে।

।। অনুরাধা ভাসিন ।।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

এই ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকী সামনে আসতেই অঞ্চলটিতে আবারও গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সম্ভবত আরও প্রশাসনিক পরিবর্তন আসতে চলেছে। শ্রীনগরের আকাশে অস্বাভাবিক জেট বিমান চলাচলের খবর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করে। এই ঘটনা ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের আগে সৃষ্ট একই ধরনের গুজব ও বিমান চলাচলের ভয়াবহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

ষষ্ঠ বার্ষিকীর দিনে যে বোমাটি ফাটে, তা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক ২৫টি বই নিষিদ্ধ করার একটি সরকারি আদেশ। এসব বইয়ের বিরুদ্ধে “মিথ্যা বয়ান” ও “বিচ্ছিন্নতাবাদ” প্রচারের অভিযোগ আনা হয়, যা কোনো প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে হার্পারকলিন্স থেকে প্রকাশিত আমার বই ‘এ ডিসম্যান্টলড স্টেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ কাশ্মীর আফটার আর্টিকেল ৩৭০’ সেই ২৫টি বইয়ের মধ্যে একটি। বইটি ২০১৯ সালের পর জম্মু ও কাশ্মীরের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার এক বিরল দলিল। ভূমি পর্যায়ের গবেষণা, অসংখ্য সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা এই বইটি জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কে ভারত সরকারের “স্বাভাবিকতা”র দাবিকে চূর্ণ করে দেয়।

সরকার ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছিল যে, এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়ন আসবে। কিন্তু এর আড়ালে পুরো রাজ্যে নজিরবিহীন শারীরিক ও সাইবার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, এবং হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে তিন জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীসহ ভারতপন্থি রাজনীতিবিদও ছিলেন। কাঁটাতার ও সামরিক ব্যারিকেড দিয়ে পুরো অঞ্চল, বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকাকে, একটি কারফিউ এলাকাতে পরিণত করা হয় এবং ইন্টারনেট থেকে শুরু করে টেলিফোন পর্যন্ত সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

শ্রীনগরে একটি বইয়ের দোকানে একজন ব্যক্তি একটি বই দেখছেন, ৭ আগস্ট, ২০২৫। জম্মু ও কাশ্মীর সরকার ২৫টি বই, সেগুলোর কপি ও অন্যান্য নথি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। এই বইগুলো লিখেছেন অরুন্ধতী রায়, অনুরাধা ভাসিন, হাফসা কান্জওয়াল এবং সুমন্ত্র বোসের মতো প্রখ্যাত লেখকরা [ফারুক খান/ইপিএ]।

ছয় মাস পর যখন কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা হয় এবং ইন্টারনেট আংশিকভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়, তখন ভারতীয় রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন আরও বেড়ে যায়। সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান ও ধরপাকড় শুরু হয়। পাবলিক সেফটি অ্যাক্টের মতো কঠোর আইনের আওতায় নির্বিচারে আটক করা হয়, যা সরকারকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই দুই বছর পর্যন্ত কাউকে আটক রাখার ক্ষমতা দেয়।

এই বাস্তবতাগুলো খুব কমই সংবাদে আসতো। সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে সাংবাদিকতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে স্থানীয় পত্রিকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব পত্রিকা সরকারের অনুগত হতে রাজি হয়নি, তাদের আর্থিক চাপ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর যারা সরকারের কথা মেনে চলে, তাদের মোটা অঙ্কের সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়, যার ফলে তারা টিকে থাকলেও তাদের সাংবাদিকতা বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

ভয়ে ভীত বা বশীভূত হয়ে যাওয়া এই পত্রিকাগুলো আর সেই অঞ্চলের ঘটনা, উন্নয়ন বা কোনো দুর্ঘটনার নিয়মিত বিবরণ প্রকাশ করত না। সাধারণ মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং সাংবাদিকরা প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেন। কিছু পত্রিকার সমৃদ্ধ আর্কাইভ, যেখানে এই অঞ্চলের জটিল দৈনন্দিন ইতিহাস ছিল, সেগুলো হয় অপ্রাপ্য হয়ে যায় অথবা মুছে ফেলা হয়।

আরও পড়তে পারেন-

গত ছয় বছরে সরকার যেকোনো ধরনের সমালোচনার প্রতি ছিল অত্যন্ত অসহনশীল। ভিন্নমতের যেকোনো কথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে – তা কেবল ভীতি প্রদর্শন ও জিজ্ঞাসাবাদ থেকে শুরু করে ডিভাইস জব্দ, আয়কর ও অর্থ পাচারের মামলা এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ পর্যন্ত গড়ায়, যার সাথে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি আটকও যুক্ত ছিল। যেখানে স্থানীয় সাংবাদিকতাকে সরকারের জনসংযোগ বিভাগের একটি এক্সটেনশনে পরিণত করা হয়েছিল, সেখানে সমাজের সব ভিন্নমতকেও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে দমন করা হয়, যার ফলে তথ্যের বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়।

আমার বইটি সেই শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল। ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রথম দুই বছরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমি আমার বইয়ের ১২টি অধ্যায়ে যা ঘটেছিল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছি – সাধারণ মানুষের উপর ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাব, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্থান সংকুচিত হওয়া, ভিন্নমতের অপরাধীকরণ, শান্তি ও স্বাভাবিকতার দাবির বিপরীতে সন্ত্রাসবাদের ধারাবাহিকতা, এবং সরকারের নতুন নীতি ও পদক্ষেপগুলো কীভাবে মানুষের বাড়িঘর ও কৃষি জমি কেড়ে নিচ্ছিল, তার মাধ্যমে উন্নয়নের দাবির অন্তঃসারশূন্যতা।

এই বইটি ছিল সত্যের সন্ধানে লেখা এক প্রচেষ্টা—নগ্ন সত্য, যা ভারত রাষ্ট্রের সব দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। একটি আতঙ্কগ্রস্ত রাষ্ট্র, যার জম্মু ও কাশ্মীরে যোগাযোগের একমাত্র পদ্ধতি হলো সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, বাসিন্দাদের নির্দয়ভাবে দমন এবং ভিন্নমতের সব কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দেওয়া—তারা স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখা এসব তথ্য নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। বইটি সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল যে, তাদের নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতি, পুলিশ ও নজরদারির রাষ্ট্র তৈরি এবং ভুল উন্নয়ন মডেলগুলো টেকসই নয় এবং তা ব্যর্থ হবে।

গত ছয় বছর ধরে সরকার শান্তি, স্বাভাবিকতা, পর্যটন ও উন্নয়নের সাফল্য জাহির করে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিকের হত্যা এই বুদ্বুদকে ফেটে দিয়েছে। এটা সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল যে, তারা যেন কাশ্মীরে নিজেদের নীতি পর্যালোচনা করে এবং ভুল সংশোধন করে।

তবে এর বদলে সরকার আরও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। কাশ্মীরিদের দানবীয় রূপ দিয়ে নৃশংসভাবে আটক করা হয়েছে এবং আরও নির্মমভাবে বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল, যার মধ্যে প্রতিবাদ মিছিল এবং সহিংসতা প্রত্যাখ্যানের আহ্বানও ছিল—যা তিন দশকের বেশি সময়ের এই অঞ্চলের বিদ্রোহের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এমনকি তদন্তকারীরাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে স্থানীয় নয়, বিদেশি জঙ্গিরা জড়িত ছিল।

গত তিন মাসে সরকার প্রমাণ করেছে যে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ব্যাপক নজরদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের তাদের নীতি আরও জোরদার হবে। ২৫টি বইয়ের উপর এই নিষেধাজ্ঞা, যার মধ্যে অনেক বইতেই এই জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ অঞ্চলের সমৃদ্ধ, সুগবেষিত এবং স্তরযুক্ত ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও আইনি বিবরণ রয়েছে, তা এই ধরনের দমন-পীড়নেরই একটি সম্প্রসারিত রূপ। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে, সরকার বিকল্প বয়ান এবং অন্য ধরনের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।

রাষ্ট্রের যেকোনো সমালোচনা এবং আনুষ্ঠানিক সংস্করণের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বয়ানগুলোকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” তকমা দিয়ে সরকার এখন এই বইগুলো জব্দ ও ধ্বংস করতে পারবে। কেবল লিখিত শব্দকেই অপরাধীকরণ করা হচ্ছে না—বই পড়ার কাজটিকেও অন্যায়ভাবে জাতির নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করা হবে। যদিও এটি ধারণা ও স্মৃতিকে দমিয়ে রাখতে পারবে না, তবে মানুষ কী লেখে ও কী পড়ে, তার উপর নজরদারি সম্ভবত আরও বাড়ানো হবে।

যদিও এই নিষেধাজ্ঞা নির্বোধ, চমকপ্রদ ও অযৌক্তিক, তবুও এটি একটি শীতল বার্তা দেয়, যা উপহাসের বিষয় যে, এটি শ্রীনগরে সরকার-সমর্থিত চিনার বই উৎসবের সাথেই মিলে গেছে: জ্ঞান ও তথ্যকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষ কী লিখবে এবং কী পড়বে, তা রাষ্ট্রই নির্ধারণ করবে। ‘চিন্তা পুলিশ’ আরও গভীরে প্রবেশ করবে।

গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে, “তারা (স্থানীয় রাজনীতিবিদরা) যুবকদের হাতে পাথর তুলে দিয়েছে,” আর তার সরকার তাদের হাতে “বই ও ল্যাপটপ” দিয়েছে।

এই ধরনের দাবির অন্তঃসারশূন্যতা তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন দৈনন্দিন বাস্তবতা হলো তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ল্যাপটপসহ ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হয়, এবং বইয়ের উপর একটি সর্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়—যা আমার কাজের মূল বার্তাটিকেই আরও শক্তিশালী করে: কাশ্মীর কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।

এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং ‘উম্মাহ’র সম্পাদকীয় অবস্থানের প্রতিফলন নয়।

অনুরাধা ভাসিন
অনুরাধা ভাসিন কাশ্মীর টাইমসের ম্যানেজিং এডিটর এবং ‘এ ডিসম্যান্টলড স্টেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ কাশ্মীর আফটার আর্টিকেল ৩৭০’ (হার্পার কলিন্স, ২০২২) বইটির লেখিকা।

আল জাজিরা থেকে ফিচারটি অনুবাদ করছেন- মুনির আহমদ

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।