Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশে দেশে নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের শোষণ, নির্দয়, নিষ্ঠুরতা: রাষ্ট্র কি এজন্য?

দেশে দেশে নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের শোষণ, নির্দয়, নিষ্ঠুরতা: রাষ্ট্র কি এজন্য?

।। জামালউদ্দিন বারী ।।

একটি সমাজের রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান শর্তই হচ্ছে সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সমাজে বসবাসরত সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। একদিকে উন্নয়নের আকাশচুম্বি প্রত্যাশা, জাতিকে অভাবনীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখানো, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলবাজি, ধর্মীয় ও ভাষাগত জাতিসত্তার মধ্যে বৈরিতা ও কলহের বীজ বপন করে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র কোনো প্রত্যাশাই পুরণ করতে পারে না। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রেই তা কখনো সম্ভব হয়নি। আর্য জাতিসত্তার দাবী তুলে জার্মানীর এডলফ হিটলার পুরো বিশ্বকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ছক একেছিলেন।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হিটলারের একনায়ক হয়ে ওঠার গল্প এবং বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে চুড়ান্ত পতনের ইতিহাস নতুন করে বিশদ বর্নণার প্রয়োজন নেই। তবে হিটলারের সেই নির্বাচন, জাতিগত অহমিকা এবং যুদ্ধোন্মাদনার চরম পরিণতি থেকে অনেকেই শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যে ইহুদিদেরকে হিটলার তার কল্পিত নীলরক্তের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে নির্মূল করতে চেয়ে ইহুদি গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ফিলিস্তিনের আরবদের ভ’মি জবরদখল করে অবৈধ রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই জায়নিস্ট নেতারা হিটলারের সুরেই কথা বলে আসছে। তারা পুরো আরব উপদ্বীপকে কথিত প্রমিজ্ড ল্যান্ড বা গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন পুরণে আরবদের উপর অনবরত দখলবাজি ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

ঔপনিবেশিক শোষন ও নিয়ন্ত্রলব্যবস্থার উপর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মানবতা ও গণতন্ত্রের মন্ত্রে দিক্ষিত আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা বিশ্বে রাষ্ট্রব্যবস্থার এক নতুন মাইলফলক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল।রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে নুন্যতম ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলে স্বাধীনতার শত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো জাতি স্থিতিলীলতা লাভ করতে পারে না। তার বাস্তব উদাহরণও আমেরিকা। সিভিল ওয়ারের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন আমেরিকা হেমেলিনের বাঁশিওয়ালার মত যে মন্ত্র বিশ্বের মানুষের কাছে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল তা ছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই ডিকটাম, ‘ডেমোক্রেসি অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল, শ্যাল নট পেরিশ ফ্রম দ্য আর্থ’।

আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা বিশ্বের কাছে চির স্মরনীয় হয়ে আছে মূলত এই একটি বাক্যবন্ধের কারণে। জনগণের ভেতর থেকে জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থার নামই গণতন্ত্র, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই গণতন্ত্র কখনোই বিশ্ব থেকে মুছে যাবে না। এটাই ছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রত্যাশা। একবিংশ শতকে এসে আমেরিকায় গণতন্ত্রের খোলসটি নামমাত্র টিকে থাকলেও আজকের আমেরিকার শাসকদের মধ্যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এডলফ হিটলারের কণ্ঠেরই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এখন তা আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত ও চীনের শাসকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্বর ও স্বরলিপিতে অনুরণিত হয়ে চলেছে। লাখ লাখ মানুষকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার হিটলারীয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে আমেরিকায় বর্ণবাদ, চীনে কমিউনিজমের একনায়কত্ববাদ এবং ভারতে হিন্দুত্ববাদের উন্মাদনায় সারাবিশ্বে চরম মানবিক সংকট, যুদ্ধোন্মাদনা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হয়েছে।

এই প্রজন্মের কোটি কোটি মানব শিশু আজ তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে। এভাবে প্রকারান্তরে নিজেদের হীনমন্যতা ও নিকৃষ্ট পাশবিক মনোবৃত্তির পরিচয়ই বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ও মহানুভব রাজনৈতিক নেতা ভারতে অতীতে যেমন অনেক ছিলেন বর্তমানেও আছেন। মহাত্মাগান্ধী ও জওহেরলাল নেহেরুরা যে উদার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কনসেপ্ট নিয়ে ঔপনিবেশোত্তর নতুন ভারতের শুভযাত্রা করেছিলেন। কাশ্মীরের জনগণের চোখে ধূলো দিয়ে রাজা হরিসিংয়ের ঔপনিবেশিক মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে জম্মু কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ছিল তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম বরখেলাফ। তবে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়ে তা ভারতের অংশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থার কারণে কোনোমতে তাদের মুখরক্ষা হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদির শিক্ষা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও গ্রহণযোগ্যতা কোথায়, যা তাঁকে সর্ব ভারতীয় নেতা হয়ে উঠার পক্ষে সহায়ক হতে পারে। উদার, মধ্যপন্থী ও গণতন্ত্রমনা ভারতীয়রা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাঁর সর্বভারতীয় নেতা হয়ে উঠার পেছনে গুজরাটে দাঙ্গা ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানের বিষয়টিই নাকি মুল ভূমিকা পালন করেছে। একবিশং শতকের শুরুতে ২০০২ সালে বিজেপি ও সংঘপরিবারের উস্কানিতে গুজরাটে সংঘটিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২ হাজারের বেশি মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল নিরীহ মুসলমান। ভারতের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং গুজরাট দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটির নাম দিয়েছিলেন, ‘এন্ড অফ ইন্ডিয়া’। ভারতে হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু মিলিটেন্সির উত্থানকে তিনি ভারতীয় ইউনিয়নের পতনের ঘন্টা হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গুজরাট দাঙ্গা ও গণহত্যার সময় গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ মোদি। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর পর তা নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রিয় সরকার।

স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছানোর পরও ২৪ ঘন্টা তাদেরকে নিস্ক্রিয় রাখা হয়েছিল এ সময়ে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়, মুসলমানদের হাজার হাজার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুণে জ্বালিয়ে দেয়ার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে সে সময়ে দাঙ্গা দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা বাহিনীর জেনারেল জমিরুদ্দিন শাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণকারি জেনারেল জমিরুদ্দিন শাহ’র লেখা ‘ দ্য সরকারি মুসলমান’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটি বিশেষ কমিশনের সদস্য হিসেবে সেই দাঙ্গার তদন্ত করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে খুশবন্ত সিং ‘এন্ড অফ ইন্ডিয়া’ লিখেছিলেন।

গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে আদালতে অনেকগুলো মামলা হলেও গুজরাট রাজ্য সরকার মামলায় অভিযুক্তদের বাঁচাতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছিল বলে গুজরাটের এক পুলিশ কর্মকর্তা সুপ্রীম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বিবিসি বাংলার সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাট ২০১১ সালে এই তথ্য দিয়েছিলেন। ২০০২ সালের গুজরাটে সংঘটিত দাঙ্গা ছিল সুপরিকল্পিত এই বক্তব্যের সমর্থনে বিবিসি বাংলা ৯টি বিষয়কে সামনে এনে বিচার বিশ্লেষণ করে এই সত্য প্রমানের চেষ্টা করেছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে গুজরাটে সংঘটিত দাঙ্গার পেছনে বিজেপি, আরএসএস, বিএইচপি, বজরংদলসহ হিন্দুত্বাবাদের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের একটি সমন্বিত তৎপরতা ছিল।

এই নৃশংস ঘটনায় নরেন্দ্র মোদি সারাবিশ্বে ঘৃণিত-সমালোচিত এবং কোথাও কোথাও নিষিদ্ধ হলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদিরা মোদিকে তাদের জন্য সবচে কাঙ্খিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দাঙ্গা ও গণহত্যা বেশ সহায়ক ভ’মিকা রেখেছে। তবে এক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বর্তমানে মার্কিনীদের বিশ্বস্ত সহযোগি হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। নরেন্দমোদি ভারতে যা’ করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বেতাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন নিশ্চিত করতে অনেকটা সে পথই বেছে নিয়েছিলেন। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের মানবাধিকার হরণের প্রশ্নে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বেশ স্পষ্ট বক্তব্য দিলেও রাজনৈতিক মনোভাবের দিক থেকে মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

কিছুদিন আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন অভিবাসন আইনে হাজার হাজার অভিবাসিকে ডিপোর্ট করা এবং পিতা-মাতা থেকে সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করার অমানবিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অনেককে উচ্চকণ্ঠ দেখা গেছে। এখন আসামের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকদের মধ্যে হাজার হাজার শিশু রয়েছে। পিতা-মাতা এনআরসি তালিকাভুক্ত হলেও শিশু সন্তানরা বাদ পড়ার অসংখ্য উদাহরণের কথা জানা যায়। আসামে বাদ পড়াদের বেশিরভাগই হিন্দু হলেও শেষতক বিদ্যমান আইনে অথবা বিশেষ আইন করে হিন্দুৃদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকিতি দেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিশেষ ট্রাইবুনাল হয়ে হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া আসামের বাদপড়া মুসলমানরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গৃহিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ভারতের এসব হিন্দুৃত্ববাদি আধিপত্যবাদ থেকে সৃষ্ট সমস্যাকে ঘিরে এখন একদিকে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারত যুদ্ধের হুমকির মুখোমুখি অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে ‘অনন্য উচ্চতা’র বন্ধুত্বের কথা ভুলে গিয়ে এনআরসি তালিকার বাইরে রেখে বাদ পড়া আসামের নাগরিকদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া, বাংলাদেশ থেকে বিশাল ভূমি দাবী করাসহ নানাবিধ উস্কানিমূলক প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে।

অন্যদিকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বহীন করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের আরেক আঞ্চলিক বন্ধুরাষ্ট্র চীনের ভ’মিকা স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষে। আরাকানে চীনের বিশাল বিনিয়োগের স্বার্থ থাকায় রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে চীনের অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে।

অন্যদিকে জিনঝিয়াংয়ে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি চীনা প্রশাসনের ভ’মিকা অনেকটা রোহিঙ্গাদের মত। চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দি দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নির্মম গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি ন্যুনতম সম্মান না দেখিয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সাথে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর জাতিগত নির্মূলের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করে এসেছিলেন। মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে চীন-ভারতের সমান্তরাল অবস্থান সত্যিই বিষ্ময়কর। পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের সব শক্তিকে মুসলমানদের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেছে।

কারণ, মুসলমানদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উত্থানকে তারা নিজেদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। আর এই বৈশ্বিক জাতিগত বিদ্বেষের অংশিদার না হয়েও এর সরাসরি শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়ার সময় বাংলাদেশ কোনো কথা বলেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেকটা দায়সারা গোছের ভ’মিকা পালনের সময় রোহিঙ্গা সংকটকে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবী করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের দাবি নাকচ করেছে।

ঠিক একইভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্তকে ভারত সরকার নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবী করলেও পাকিস্তানের শক্ত অবস্থানের কারণে তা আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপ্রতুল ভ’মিকার পরও কাশ্মীরিদের পক্ষে পাকিস্তানের শক্ত অবস্থান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধ ও নেতৃত্ব সম্পর্কে বিশ্বের কাছে বিশেষ বার্তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট এবং আসামের এনআরসি সরাসরি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করলেও বাংলাদেশ সরকারের নিরবতা, আপসকামিতা আত্মঘাতি হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে।

ভারতের বিজেপি নেতারা যখন তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারিদের প্রসঙ্গ তুলে বার বার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, তখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ বিরোধি বক্তব্যের প্রতিবাদ করছেন না। উপরন্তু কেউ

কেউ এনআরসি তালিকা ভ্রাতের আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে না বলে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সুরে সুর মেলাচ্ছেন। অথচ ভারতের কৌশলগত মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের এনআরসি এবং মুসলমানদের মানবাধিকার প্রশ্নে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নিজে না কাঁদলে মা ও সন্তানকে দুধ দেন না।

বাংলাদেশ সরকার একদিকে প্রতিবেশি প্রতিপক্ষের সাথে তথাকথিত বন্ধুত্ব রক্ষা করতে চায়, আবার কোনো প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়াই জটিল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করে। চলমান বিশ্ববাস্তবতায় তা অসম্ভব। যুদ্ধ করতে না চাইলেও যুদ্ধের শক্তি এবং প্রস্তুতি থাকতে হবে। নতুবা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত বড় শক্তির সাথে আপস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

আধুনিক সভ্যতা ও ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস সামরিক শক্তিবলে রাষ্ট্র দখলের ইতিহাস। হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলোতে পরাশক্তির অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক বির্বতন শেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জাতিগত স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থায় পদার্পণ করতে শুরু করেছিল। ঠিক সে সময় ফিলিস্তিনী আরবদের ভ’মি দখল করে রাতারাতি গড়ে উঠা ইসরাইল রাষ্ট্র বিশ্বশান্তির উপর এক নতুৃন প্রাদুর্ভাব হয়ে দেখা দিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিবক শক্তির নীলনকশায় ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের গন্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে ষড়যন্ত্র, গোয়েন্দাবৃত্তি, যুদ্ধ ও হানাহানির আঞ্জাম দিয়ে আসছে।

এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বিষ্ফোরন্মুখ হিসেবে একদিকে ভারত-পাকিস্তান অন্যদিকে সিরিয়া-লেবানন ও ইসরাইল সীমান্তকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই দুই অঞ্চলেই যুদ্ধের নেপথ্যের অনুঘটক হিসেবে আবিভর্’ত হয়েছে জায়নবাদি ইসরাইল। জায়নবাদের সাথে হিন্দুত্ববাদের যুগলবন্ধনের খবর অবশেষে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ভারতের সাথে ইসরাইলের গোপন সঝোতার সম্পর্ক সব সময়ই ছিল এবং আছে। ভারতের অর্থনীতির অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল হওয়া এবং ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের মনোভাব বিবেচনায় ইসরাইল ভারত সম্পর্ক সমঝোতার ভিত্তিতেই অপ্রকাশ্য ছিল বলে মনে করা হয়।

হিন্দুত্ববাদি বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রিয় সফরে ইসরাইলে যান। সেখানে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন ইসরাইলের সাথে ভারতের দাম্পত্য স্বর্গে নির্ধারিত হয়েছিল। জায়নবাদি ইসরাইলের সাথে হিন্দুত্ববাদি ইসরাইলের সম্পর্ক যতই জোরদার হচ্ছে, ভারতের মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রীয় জুলুম-নিপীড়ন ততই বেড়ে চলেছে। কাশ্মীরের মর্যাদা কেড়ে নেয়া এবং গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনীদের মত কাশ্মীরকে একটি কারাগারে পরিনত করার সিদ্ধান্ত এবং কলাকৌশলও ইসরাইলের কাছ থেকেই ধার করা বলে মনে করা হচ্ছে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতি হত্যাকান্ডের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ইসরাইলী পাইলটদের অংশগ্রহণের তথ্য অসমর্থিত খবরে প্রকাশিত হয়েছে।

বালাকোট হামলার পর বৃটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক পাক-ভারত উত্তেজনায় ইসরাইল ইন্ধন দিচ্ছে বলে তার এক নিবন্ধে বলেছেন। পাক-ভারত উত্তেজনার পারদ এখনো উত্তুঙ্গ রয়েছে। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের উস্কানি গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করেছে। গত সপ্তাহে ইসরাইল মাত্র দুই দিনে মধ্যপ্রাচ্যের ৪টি দেশে আগ্রাসি হামলা চালিয়ে তা জোরের সাথে প্রচার করেছে। অনেকে ইসরাইলের এই যুদ্ধের উস্কানিকে আগামী নির্বাচনে নেতানিয়াহুর ভোটে জেতার কৌশল হিসেবে মনে করছেন।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা ঘটনা নিয়ে অতি রাজনীতি এবং বালাকোটে ভারতের বিমান হামলাকেও নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। তবে নির্বাচনের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর কাশ্মীরকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে কাশ্মীরিদের উপর সর্বাত্মক আগ্রাসন চালিয়ে কাশ্মীরি মুসলমান জাতিসত্তার পরিচয়কে স্তব্ধ করে দিতে চায় ভারত। একই সময়ে লাখ লাখ মুসলমান ও বাঙ্গালী হিন্দুকে আসামের নাগরিকপুঞ্জির বাইরে রেখে এদেরকে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত করার মধ্য উপমহাদেশে এক নতুন আঞ্চলিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। মিয়ানমারে নাগরিকত্বের অধিকারবঞ্চিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।

আরাকানের সাথে বাংলাদেশের ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক মিয়ানমারের চেয়ে অনেক বেশি নিবিড়। ফিলিস্তিনের উপর ফিলিস্তিনি আরবদের, কাশ্মীরের উপর কাশ্মীরিদের পূর্ণ অধিকার আছে। একই ভাবে আরাকান বা রাখাইনের উপর রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার আছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেয়ার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তৎপরতায় বাংলাদেশের সমর্থন থাকতে পারে না। বিশ্বের দেশে দেশে মুসলমান নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করে দেয়ার যে ঘৃন্য রাজনীতি চলছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে তা রুখে দাঁড়াতে হবে।

ই-মেইল: bari_zamalyahoo.com