Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিপজ্জনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

বিপজ্জনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

।। আফতাব চৌধুরী ।।

নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই আমাদের দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই আত্মহত্যার উর্ধ্বমুখীহার রীতিমতো উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে পৌছেছে। এ ক্ষেত্রে কিশোর কিশোরীদের সংখ্যাও বাড়ছে বিপজ্জনক হারে।

গ্রাম কিংবা শহরে সর্বত্র এটা আকছার ঘটছে। হঠাৎ কোনো পরিচিত কিংবা প্রিয়জনের আত্মহত্যার খবরে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। শুরু হয় নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেন এই হৃদয়বিধায়ক ঘটনাটি ঘটল? কোনও কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় আত্মহননকারী সুইসাইড নোট রেখে যায়। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কিংবা রোগের জ্বালা সইতে না পেরে চলে যাচ্ছি।

এ ধরনের নানা কথা লেখা থাকে। কেউ চলে যায় পারিবারিক কলহের কারণে, কেউ আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে, কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে, কেউ ভখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে, কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে, কেউ স্বামী ও শ্বশুড় বাড়ির গঞ্জণা সহ্য করতে না পেরে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলের বউয়ের গঞ্জণা সহ্য করতে না পেরে শাশুড়ী আত্মহত্যা করছেন। কোনো কোনো গৃহবধূ আত্মহননের পথ বেছে নেয় নানা মানসিক অস্থিরতার কা ণে। আবার সবাই যে সুইসাইড নোট রেখে যায় তাও নয়। আত্মহত্যার কারণ জানা যায় না, অনুমান করা হয় অনেক কিছু।

আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা তেমন স্থান পায় না খবরের কাগজেও। তবে বিশিষ্ট কেউ যদি আত্মহত্যা করে তবে মৃত্যুর ঘটনা ঘিরে নানা রহস্য দানা বাঁধে, দেখা দেয় চাঞ্চল্য। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার এক সঙ্গে আত্মহত্যার খবর। আবার কখনো গোটা পরিবার এক সঙ্গে শেষ হয়ে যাওয়ার খবরেও আমরা চমকে উঠি। এমন ঘটনা ঘটছে সর্বত্রই। স্ত্রী, সন্তানদের শেষ করে কেউ হয়ত নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। হৃদয় বিদারক এমন ঘটনা ঘটছে আমাদের চারপাশে। এক সঙ্গে আত্মহত্যা করতে গিয়ে কেউ হয়ত বেঁচে যায়, তবে তার মানসিক অবস্থা কি তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না।

কেন এই আত্মহনন? যে জীবনের জন্য এত চেষ্টা, বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস, তা নিজের হাতে নিজে শেষ করে দেয় কেন? আত্মহত্যার কারণ নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে নানা কথা বলে গেছেন। শুধু সাধারণ মানুষ নন, অসাধারণ মানুষও আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে এমন অনেক কাহিনী জানা যায়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যুকে অনেকে শ্রেয় বলে বেঁচে নিয়েছেন। এমন কাহিনী বিস্তর রয়েছে। রক্তে রঞ্জিত সমর ইতিহাসের অনেক পৃষ্ঠায় রয়েছে এ রকম অশ্রুসজল কাহিনী।

ত্রিপুরার ইতিহাসে দেখা যায় , দুর্ভাগ্য পীড়িত রাজা অমর মানিক্য আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ত্রিপুরার অপর এক রাজা মুকুন্দ মানিক্য মোগলদের হাতে বন্দী হয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন। রাজাদের কথা থাক। আমরা হিটলারের আত্মহত্যার খবরও জানি। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল স্ত্রী এভা ব্রাউনকে নিয়ে আত্মহত্যা করেন হিটলার এবং ব্রাউন।

অনেক সময় সংঘবদ্ধভাবে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে। চীন এবং জাপানে এ রকম অনেক নজির রয়েছে। একবার দক্ষিণ চীনের জিযাংসি অঞ্চলে কৃষক পরিবারের ৫০ জন মেয়ে পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেÑপরের জন্মে অভিজাত শহরের মেয়ে হওয়ার আশায়। দেশ কাল ভেদে আত্মহত্যার কারণও নানা রকম হতে পারে। কোথাও হয়তো দারিদ্রের কারণে, কোথাও প্রাচুর্যের কারণেও হতে পারে।

আমেরিকাতে যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। জাপানের স্কুল গুলোতে র‌্যাগিং সহ্য করতে না পেরে অনেক শিশু আত্মহত্যা করে। এ রকম নানা জায়গায় নানা আত্মহত্যার কারণ থাকে। বিখ্যাত সমাজতত্ত¡বিদ এমিল তুর্ক হেইম আত্মহত্যার তিনটি কারণ দেখিয়েছেন। এগুলো হলো আত্মাভিমান বিষয়ক, পরস্বার্থ বিষয়ক এবং ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম সম্পর্কে তিনি বলেছেন , যখন মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ফারাক ঘটে, সাধ তৈরি হয় পরিবেশ এবং পরিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। কোনও ব্যক্তির সাধ অনুযায়ী সাধ্য নাও থাকতে পারে। এভাবে অনেকের মধ্যেই আসে হতাশা। অনেক ক্ষেত্রে এই হতাশারই অনিবার্য পরিণতি হল আত্মহত্যা। কেউ কেউ আবার আত্মহত্যাকে এক বিশেষ রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা নানা রকম ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। এমনও ঘটনা দেখা গেছে যে, কেউ হয়তো গলায় দড়ি নিয়ে আত্মহত্যা করতে যাওয়ার সময় সাপ দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছেন। তার আর আত্মহত্যা করা হয়নি। একটি মেয়ে আত্মহত্যার আগে সুইসাইড নোট লিখে যাবার সময় তার বাবাকে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে এবং সময় মতো ওষুধ খেতে বলেছে।

জাপানে আত্মহত্যার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যাণ মতে দেশটিতে প্রতি ঘন্টায় ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রতি ৪ মিনিটে ১ জন আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নেই। বাংলাদেশে মূলত আত্মহত্যা জনিত ঘটনার কারণ ৩টি। আর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে যুবক যুবতীদের সংখ্যাই বেশি। প্রথমত যুবক যুবতীরা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় কারণ পরীক্ষা বা চাকুরী ক্ষেত্রে ব্যর্থতা আর তৃতীয় কারণটি হল অভাব অনটন অর্থাৎ দারিদ্র্যতা। আবার অনেক সময় দেখা যায় যৌতুক বা অন্য কারণে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৮ সালে গোটা বিশ্বে ১৪ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, দুজন যুবক যুবতি এবং ছাত্র-ছাত্রী প্রতি পাঁচ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে একজন হলেন গৃহবধূ। পুরুষ এবং নারীর আত্মহত্যার পৃথক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি রিপোর্টে। তাতে বলা হয়েছে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নানা চাপের জন্য চরম পথ বেছে নেন বেশিরভাগ পুরুষ। অন্যদিকে ব্যক্তিগত এবং আবেগতাড়িত হয়েই অনেক সময় মহিলারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষক প্যাটেলের আশঙ্কা, পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে আর কিছু দিনের মধ্যেই তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুর এক নম্বর কারণ হয়ে উঠবে আত্মহত্যা। সমীক্ষকের মতে আত্মহত্যার প্রবণতা যুবতীদের মধ্যেই বেশি। দারিদ্র্য কিংবা শিক্ষার অভাব আত্মহত্যার মূল কারণ নয়। দেখা গেছে, গরীব, নিরক্ষর বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবানদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিতদের আত্মহত্যার ঘটনা ইদানিং বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে যে সামাজিক ব্যবস্থা দরকার তা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। বিভিন্ন রকম মানসিক অসুস্থতা, যা অনেক সময় আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়, তার চিকিৎসা ব্যবস্থাও বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কম।

আত্মহত্যার ঘটনা বাংলাদেশে ব্যাপক হারে বাড়ছে। যেখানে প্রায় দুই দশক আগে মাঝে মধ্যে ২/১ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যেত সেখানে এখন প্রায় প্রতিদিনই ২/১ জনের আত্মহত্যার খবর আমরা পেয়ে থাকি। বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। এ প্রবণতা রোধে উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট।