Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন আজকের রাজত্ব কার?

আজকের রাজত্ব কার?

ছবি- উম্মাহ গ্রফিক্স।

।। মাওলানা সানাউল্লাহ মাহমূদী ।।

পবিত্র মাহে রমজানের তারাবীহ আদায় শেষে এখন সাহরী’র অপেক্ষা। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও যেন কেউ নেই। অব্যক্ত এক ব্যথা অনুভব করছি। কলিজাটা থেকে থেকে দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। হাহাকার করছে বুকটা। ফ্ল্যাটের চতুর্থ তলার দক্ষিণের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি খুব কাছের চারতলা বিশিষ্ট মসজিদের দিকে। নাহ, সেখানে তিন তলা পর্যন্ত অন্ধকার। আজ কতদিন মসজিদের বাতিগুলো জ্বলে না। মসজিদের গলিতে কোন কোলাহল নেই। আজকে কত আনন্দ ও উৎসব মুখর থাকত। বিগত বছর গুলোতে রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি, মসজিদের মিনারের মাইকে চাঁদ দেখার খবর বার বার উচ্চারিত হত। রমজানকে আবেগাপ্লুত হয়ে খোশ আমদেদ জানাতো সকলে। সরবে বার বার তারাবীহ’র সময় ঘোষণা করা হত। বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর, শিশুরা সকলে পাঞ্জাবি পরে হাতে তাছবীহ, আতরের সুগন্ধিতে এক জান্নাতি আবহ। চতুর্দিকে আধ্যাত্মিকতার সুবাতাসে শীতল হয়ে যেত অন্তর…।

কোথায় হারিয়ে গেল? কেন হারিয়ে গেল? আর কি ফিরে আসবে না আগের সেই দিন? চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে, বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে আসছে। বিগত জীবনের রমজান মাসের আনন্দঘন স্মৃতিগুলো হৃদয়ের রূপালি পর্দায় ফিরে ফিরে বারবার ভেসে ওঠে। গলার স্বর ভারী হয়ে আসছে। বোবা কান্না করে অস্ফূট স্বরে বুক ফেটে বের হল শুধু আহ্! আজ আমার কাছে অন্তরের অভিব্যক্তি প্রকাশের কোন ভাষা নেই। কণ্ঠের কোন শব্দ নেই। শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করা অন্তর থেকে অস্ফূট এক আর্তনাদ বার বার বেরিয়ে আসতে চায়। ব্যথায় কাতর হয়ে গাল বেয়ে বেয়ে যখন চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল অনবরত অন্ধকার রুমের একাকী নির্জনে, একমাত্র প্রিয় বন্ধুকে দু’হাত তুলে কষ্টের কথাটা বললাম… হে পরম বন্ধু! ভুল করেছি বলে ভুলে যেওনা… আমরা তোমায় ভুলে গিয়েছি বলে তুমি ভূলে যেওনা……।

আরও পড়তে পারেন-

মাহে রমযানের ফযীলত এবং বিধি-বিধান ও পূর্ণাঙ্গ মাসআলা

কখন জমিনে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে এবং মু’মিনদের করণীয়

মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

নারীর অর্থ উপার্জন প্রসঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

‘করোনাভাইরাস শক্তিশালীদের মাথা নত করতে বাধ্য করেছে’

আমার এ লেখার শিরোনাম “আজকের রাজত্ব কার”? পবিত্র কুরআনের ভাষায়- لمن الملك اليوم۔۔۔۔ লেখাটা শেষ করতে পারিনি এবং ইতিমধ্যে রমজান এসে গেল। মাহে রমজান কে স্বাগত জানাতে মনের আবেগকে দমিয়ে রাখা কষ্টকর ছিল। সুতরাং লেখার গতি কিছুটা থমকে ছিল। কেন এমন হল, আজকের পৃথিবী? প্রচুর লেখা পড়েছি, এখনও পড়ছি। বিশেষ করে আরব বিশ্বের বড় বড় পন্ডিত, স্কলারদের লেখা এবং বাম ডান পন্ডিতদের বিভিন্ন প্রবন্ধ করোনা নিয়ে। বাংলাদেশের পন্ডিতগণের আলোচনা মাঝে  মাঝে ফলো করি। তবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তাদের পান্ডিত্বপূর্ণ আলোচনা আয়ত্বে রাখা বেশ কষ্ট সাধ্য। এত ইলমী, ফিক্বহী, মানতেক, ফালসাফার বিশ্লেষণ সত্যিই অবাক করার মত। তবে আমার মত এত দূর্বল তালেব এলেমের জন্য এত গভীরতায় অবগাহন করা সম্ভব নয় বিধায় বৈশ্বিক অবস্থার উপর সাদামাটা দু’ একটি কথা লিখতে দূঃসাহস করছি।

প্রবল প্রতাপশালীরা আজ কোথায়? প্রচন্ড শক্তির অহংকারীরা আজ মিইয়ে পড়েছে কেন? যাদের ক্ষমতার দাপটে কাপঁতো গোটা বিশ্ব, কোথায় আজকে তাদের ক্ষমতার বাহাদূরী? لمن الملك اليوم তথা আজকের পৃথিবীর রাজত্ব কার?

পবিত্র কুরআনের এ আয়াত এবং অসংখ্য হাদীসের বর্ণনায় হাশরের দিনে যখন সবাই উন্মুক্ত এক ময়দানে সমবেত হবেন, যেখানে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, ঝর্ণা, বৃক্ষরাজী, বাগ-বাগীচা, অট্টালিকা, ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা কিছুই থাকবে না, সবাই ভয়ার্ত আতঙ্কিত। ভয়ার্ত সেই বিভিষীকাময় হাশরের ময়দানে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর মহান আরশে উপবিষ্ট হয়ে হুংকার দিয়ে প্রশ্ন করবেন- “আজকের দিনের রাজত্ব কার”? বনি আদম সহ সৃষ্টি জগৎ কতটা অসহায় হবে সেদিন! কোন উত্তর দেয়ার সাহস হবে কি কারো? মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সমস্বরে একটাই উত্তর আসবে- لله الواحد القهار তথা- প্রবল পরাক্রান্ত এক আল্লাহর। সেদিন তো আমাদের সামনে আসবেই। এটা মুমিনের পূর্ণ একীন। গাফিলতির অন্ধকারে বেপরোয়া জীবন যাপনে সে কঠিন দিনের কথা বিস্মৃত হয়ে শক্তির বাহাদূরীতে উদভ্রান্তের মত লাফা লাফি করে শক্তির মহড়া দেখাচ্ছে। অথচ কোরআনুল কারীমে পূর্ববর্তী শক্তি শালী জাতির ধ্বংসের ইতিহাস আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

করোনা ভাইরাসের মত আল্লাহ পাকের ক্ষুদ্র এক শক্তি, যা অদৃশ্য। মাইক্রোস্কোপের গ্লাসে লক্ষ গুণ বড় করে দেখতে চাইলে ছোট্ট চালের দানার মত দেখা যায়, এমন ধারণা বৈজ্ঞানিকদের। মহান আল্লাহর এক অতি ক্ষুদ্র সৈন্য সকল শক্তির দম্ভকে ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছে, সকল দর্প চূর্ণ বিচুর্ণ করে দিয়েছে। সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের উচ্চতায় অধিষ্ঠিত দাবিদারদেরকে আহম্মকে পরিণত করে দিয়েছে। সারা বিশ্ববাসীর রক্ত চুষে তৈরী করা মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা, রণতরী, যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সব আবিষ্কার, বন্য পশুকে মারার জন্য নয় বরং অতি অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা যায় এবং বিশ্বকে পদতলে রাখা যায়, এই শয়তানী গবেষণার মোড়লরা দিগবিদ্বিগ ছুটছে নিজেকে বাঁচার আকুতি নিয়ে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ان نشأ ننزل عليهم من السماء آية فظلت اعناقهم لها خصعين অর্থাৎ- আমি যদি ইচ্ছা করি, তবে আকাশ থেকে তাদের কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করতে পারি। অতঃপর তারা এর সামনে নত হয়ে যাবে। (সূরা শো’রা)।

আজ তাদের গর্দান নত গেছে অদৃশ্য এক খোদায়ী ক্ষুদ্র শক্তির মহড়ায়। বিশ্বের শক্তিধর দেশ আমেরিকার সেনাবাহিনীর প্রধান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পেন্টাগনের জেনারেলরা কোয়ারেন্টাইনে বন্দি, লাসভেগাসের বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুয়ার ক্লাবের শহর আজকে লকডাউনে। আর জৌলসভরা হোটেলগুলোতে ভোগের মত্ততায় নৃত্য করে না কেউ। আমেসটারডামের অলি গলি পৃথিবীর পতিতাদের বৃহৎ মার্কেট যেখান থেকে বার্ষিক আয় হতো দশ মিলিয়ার ডলার, সেই নগ্ন ক্লাবের আয়ও সম্পূর্ণ বন্ধ। পৃথিবীর এয়ারপোর্টগুলো বন্ধ, সকল উড়োজাহাজগুলো মৃত লাশের মতো পড়ে আছে।

আরও পড়তে পারেন- ‘গুনাহর ক্ষতি এবং বেঁচে থাকার উপায়’

আজকে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির। ট্রাম্প ব্যাংকে সুদের হার হ্রাস করে শূন্যতে নিয়ে আসছে। অর্থাৎ সুদ ব্যবস্থা বাতিল! স্টক মার্কেট, শেয়ার বাজারে ধ্বস গত তিন থেকে চার সপ্তাহে ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক হারিয়ে গিয়েছে। রাশিয়া, কম্যুনিস্ট চীন তাদের তথ্য গোপন করছে। ধ্বংসের স্রোতে বাঁচার আকুতি সবার। আরব বিশ্বের কথা নাইবা বললাম, বিশ্ব মোড়লদের গোলামীতে যাদের জীবন যাপন তাদের অবস্থা মোড়লদের কোরোনার আহাজারীতে কেউ চিন্তাও করছে না। তবে আমাদের করুণা হয় তাদের প্রতি।

লেখার যবনিকা টানতে চাই, ইতালি যখন লিবিয়া দখল করেছিল ওমর মোখতারকে প্রকাশ্যে ফাসিঁতে ঝুলিয়ে হত্যা’সহ পাঁচ লক্ষাধিক মুসলমানকে খুন করেছিল। ফ্রান্স আলজেরীয়াতে পনের লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করেছিল। বৃটিশ, আমেরিকা যৌথভাবে ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করেছে। কম্যুনিস্ট চীন চার কোটি মুসলমানকে হত্যা করেছে তুর্কমেনিস্তানে। বিশ লক্ষ মুসলমানকে চীন হত্যা করেছে উইঘোরে।

وقالوا من اشد منا قوة أولم يروا أن الله الذي خلقهم هو اشد منهم قوة وكانو بآيات الله يجحدون অর্থাৎ- যারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল, আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর কে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্তুত: তারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করত।

ইসরাইল, রাশিয়া, ভারত মুসলিম নিধনে অদম্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আবেগ তাড়িত হয়ে বলছি না, যা ইতিহাস যা আজকের বাস্তবতা, এমন চারটি ঘটনা বলে শেষ করছি-

এক. সিরিয়ান সেই কাল হাফ-প্যান্ট ও গায়ে লাল শার্ট পরা শিশু আয়লান, মনে আছে কি? শরণার্থী হয়ে পৃথিবীতে বাচঁতে চেয়েছিল, মায়ের কোল থেকে ছিটকে সাগরের ঢেউ তাকে কিনারে তুলে দিয়েছে। বিশ্ব মানবতা এই শিশুর জন্য কাদেঁনি।

দুই. কাশ্মীরের ঐ কিশোর মেয়েটি দীর্ঘ দু’মাস পরিবারের সবাই গৃহবন্দি, ক্ষুধার কষ্টে বিবিসির সাংবাদিককে বলেছিল, যেদিন তোমরা গৃহবন্দি হবে সেদিন বুঝবে আমাদের কি কষ্ট। কিন্তু তাদের কষ্টটা কেউ বুঝতে চায়নি।

তিন. সিরিয়ার যুদ্ধে গুলিতে এক নিষ্পাপ শিশুর কথা কি মনে পড়ে, যে শেষ নিঃশ্বাসের আগে বলেছিল, আমি আল্লাহকে সব বলে দিব?

চার. সিরিয়ায় মিসাইলের গোলার আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া একটি ঘর থেকে আহতদের উদ্ধার করা হচ্ছিল, আর সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত। তখন এক কিশোরী আকুতি জানাল, আংকেল, প্লিজ! ক্যামেরা সরিয়ে নিন, আমার শরীরে এক টুকরো কাপড়ও নেই।

পাচঁ. সিরিয়ান ক্ষুধার্ত সেই শিশুটির কথা মনে পড়ে কি? ক্ষুধার যন্ত্রণায় আল্লাহ ডেকে ডেকে বলেছিল, হে আল্লাহ আমাকে মৃত্যু দাও, এখানে কেউ রুটি দেয় না। আমাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাও, সেখানে রুটি খেয়ে ক্ষুধার কষ্ট থেকে মূক্তি পাব।

চীন, ইটালী, ফ্রান্স, স্পেন, বৃটেন, আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া! তোমাদের হাতে নিহত মুসলমানদের রক্ত দগদগ করছে। শহিদী আত্মাগুলো আজকে জান্নাতে সবুজ পাখি হয়ে উড়ে উড়ে বলছে, ওহে বিশ্ববাসী! সতর্ক হও, আল্লাহকে ভয় কর। এই মাহে রমজানকে যথাযথ কদর কর। হয়তো নাজাত পেতেও পার।

আমাদের দেশের ভাগ্যাকাশে কি অপেক্ষা করছে জানি না। তবে দিনে দিনে পাপের বোঝা অনেক ভারী হচ্ছে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।

– মাওলানা সানাউল্লাহ মাহমূদী, প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন, মুহাদ্দিস ও সহকারী মহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: আরএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com