Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রমণ ব্যাধি: ইসলাম কি বলে

ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রমণ ব্যাধি: ইসলাম কি বলে

।। মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী ।।

একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তার আকিদা বা বিশ্বাস দৃঢ় থাকা। কারণ, আক্বিদার বিশুদ্ধতার উপরই নির্ভর করবে তার ঈমানের ভিত্তি। ত্রুটিযুক্ত আকিদার কারণে একজন মুমিন ঈমানহারাও হয়ে পড়তে পারেন।

ইদানীং মিডিয়া তে করোনা ভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রমণ ব্যাধি, এর প্রচার এমনভাবে হচ্ছে যে, মানুষ এ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের মনুষ্যত্ববোধও হারিয়ে ফেলছেন। কিছু দিন পূর্বে দৈনিক প্রথম আলোর এক রিপোর্টে এসেছে, সন্তানেরা তাদের মাকে সখিপুরের গজারি বনে রেখে গেছে করোনাভাইরাস এর ভয়ে। সুনামগঞ্জে মাসজিদের খাটিয়া দেয়া হয়নি করোনা রোগির লাশ দাফনের জন্য। দিন দিন আমাদের ঈমানে জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। উঠে যাচ্ছে আল্লাহর প্রতি আস্থা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা। ফলশ্রুতিতে আমাদের আকিদা নষ্ট হয়ে ঈমানহারা হওয়ার আশংকা জেগে উঠছে। তাই ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রমণ ব্যাধি নিয়ে আমাদের আক্বিদা ঠিক করতে হবে সবার আগে।

বিজ্ঞানে দৃষ্টিতে ছোঁয়াচে রোগঃ

আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরণের অণুজীব বাস করে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি শরীরের জন্য বেশ উপকারী, কোনোটি উপকারী না হলেও ক্ষতিকারক নয়, কোনোটি আবার বিশেষ কোনো অবস্থায় বা কোনো বিশেষ কারণে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে এবং মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত রোগগুলোকেই সংক্রামক রোগ বলা হয়। অনুপ্রবেশকৃত এ ধরনের সংক্রামককে যখন শরীরের রোগ-প্রতিরোধক তন্ত্র বিতাড়ন করার চেষ্টা করতে থাকে, তখনই এর প্রতিক্রিয়ায় জ্বর, মাথা ব্যথা, র‌্যাশ বা অসুস্থতার বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। সংক্রামক রোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয় মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করতে পারে। (সূত্র- দৈনিক কালের কণ্ঠ)।

আরও পড়তে পারেন-

‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ

কোভিড-১৯ মহামারী এবং ইসলামের শিক্ষা: ফরহাদ মজহার

আদর্শবানরূপে নিজেকে গড়তে চাইলে চার গুণাবলী অর্জন করতে হবে

‘হিজাব’ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করে: মার্কিন গবেষক!

বিশ্বকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস

ছোঁয়াচে রোগের ব্যাপারে ইসলামী আক্বিদাঃ

ক. এ বিশ্ব জগতে যা কিছু হয় সবই আল্লাহ তাআলার ফয়সালাতে হয়ে থাকে। এর পিছনে যেসব জিনিষকে বাহ্যিক কার্যকারণ হিসেবে দেখা যায়, এগুলো যদিও বাস্তব, তবে এসবের কার্য ও ক্রিয়া করার ক্ষমতা আল্লাহপ্রদত্ত। (সূরা -আনআম, আয়াত- ৫৯)।

খ. আল্লাহ তাআলা ক্রিয়া করার ক্ষমতা না দিলে এগুলো ক্রিয়া করতে পারবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত- ১০২, সহীহুল বুখারী, হাদীস নং- ৫৭০৭)।

গ. রোগের মধ্যে ক্রিয়া করার নিজস্ব ক্ষমতা নেই। তাই আল্লাহ চাইলে রোগাক্রান্ত হবে, নতুবা হবে না। (সূরা ইউনুস, আয়াত- ১০৭, সহীহুল বুখারী, হাদীস নং- ৫৭০৭)।

ঘ. সুস্থতা-অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। সুস্থতার যেমন বিভিন্ন কারণ রয়েছে তদ্রূপ অসুস্থতারও বিভিন্ন কারণ আছে। এ সব কারণ বাস্তব সম্মত। (সুরা হাদিদ, আয়াত- ২২)।

ঙ. রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ এটিও যে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া। এটি একটি বাস্তব বিষয়। শরীয়ত একে অস্বীকার করেনি। তবে অন্যান্য আসবাবের ব্যাপারে যে কথা, এখানেও একই কথা-কার্য ও ক্রিয়া করার ক্ষমতা আল্লাহপ্রদত্ত। (বুখারী, ২১৬১, ২১৭৭)।

চ. ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা ইসলাম পরিপন্থী কাজ নয়। (সহীহু মুসলিম, হাদীস নং- ৫৯০৫)।

ছ. বিজ্ঞান ইসলামের এই বক্তব্যের সমর্থক। (সূত্র- দৈনিক কালের কন্ঠ ১৫ মর্চ ২০২০)।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে ছোঁয়াচে রোগঃ

কুরআন ও হাদীস অনুসন্ধান করলে এ বিষয়ে দুই ধরনের হাদীস পাওয়া যায়।
১. ছোঁয়াচে রোগের ইসলামে কোন অংশ নেই।
২. বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ।

প্রথমত যে সকল হাদীসে ইসলামে ছোঁয়াচে রোগের কোন অংশ নেই- বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা মূলত: উদ্দেশ্য হলো বান্দার ঈমান পরিশুদ্ধ করা, আকিদা ও বিশ্বাসকে দৃঢ় করা।
যেমন- হাদীস শরীফে হযরত আবূ হুরাইরা (রাযি.) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–

لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ  অর্থাৎ- কোন রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই, কোন কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই এবং কোন পেঁচার ডাকে ও সফর মাসে কোন অশুভতা নেই।” (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৭০৭)।

এ হাদীস দ্বারা জানা যাচ্ছে- “সংক্রামক রোগ” বা “ছোঁয়াচে রোগ” বলতে কিছু নেই। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন রোগের এ ক্ষমতা নেই যে, কাউকে সংক্রণ বা আক্রান্ত করবে।

এই হাদীস দ্বারা মূলত: জাহিলী যুগের সেই বিশ্বাসকে খন্ডন করা হয়েছে যা সেই যুগের লোকজন বিশ্বাস করতো। রোগীর সংস্পর্শে রোগ তার নিজস্ব ক্রিয়াতে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। অথচ এরূপে কোন রোগ কারো মধ্যে সংক্রমণের ক্ষমতাকে বিশ্বাস করা শিরক ও কুফরী বিশ্বাস। সেই কুফরী বিশ্বাসকে এ হাদীসে বাতিল করা হয়েছে। এ হাদীসের এরূপ ব্যাখ্যা করে “আস-সুনানুল কাবীর” কিতাবে ইমামুল হাদীস আল্লামা আবু বকর বাইহাকী (রহ.) উক্ত হাদীসের অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়ে বলেন-

باب‏:‏ لاَ عَدْوَى عَلَى الْوَجْهِ الَّذِى كَانُوا فِى الْجَاهِلِيَّةِ يَعْتَقِدُونَهُ مِنْ إِضَافَةِ الْفِعْلِ إِلَى غَيْرِ اللَّهِ تَعَالَى

অর্থাৎ- “অধ্যায়: কোন রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই; এটা অগ্রাহ্যকরণ সেই সূরতের ভিত্তিতে, যা জাহিলী যুগে মানুষ বিশ্বাস করতো তথা রোগ হওয়ার সম্বন্ধকে গাইরুল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করা। এ ভিত্তিতেই রোগের কোনরূপ সংক্রমণের ক্ষমতাকে নাকচ করা হয়েছে”। (দ্রষ্টব্য- আস-সুনানুল কাবীর, ১৫৮ পৃষ্ঠা)।

অপর এক হাদীসে রোগের নিজের সংক্রমণ ক্ষমতা নেই; এটা বুঝতে সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে এক প্লেটে আহার গ্রহণের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
জামি‘উত তিরমিযীর এক হাদীসে এসেছে-

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذَ بِيَدِ مَجْذُومٍ فَأَدْخَلَهُ مَعَهُ فِي الْقَصْعَةِ ثُمَّ قَالَ كُلْ بِسْمِ اللَّهِ ثِقَةً بِاللَّهِ وَتَوَكُّلًا عَلَيْهِ

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন কুষ্ঠরোগীর হাত ধরলেন, অতঃপর তার হাতকে তার সাথে (খাবার খাওয়ানোর জন্য) নিজের প্লেটে টেনে নিলেন। তারপর বললেন- “আল্লাহর নামে খাও। আল্লাহর উপরে অবিচল নির্ভর এবং তাঁর উপরে অনড় ভরসা রাখ”। (জামি‘উত তিরমিযী, হাদীস নং- ১৮১৭, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং- ৩৯২৫)।

তেমনিভাবে অপর হাদীসে এ ধরনের কুষ্ঠরোগীর নির্দ্বিধায় সুস্থ মানুষের সাথে ঘরে খাওয়া-থাকার বর্ণনা রয়েছে।

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ لَنَا مَوْلَى مَجْذُومٌ فَكَانَ يَأْكُلُ فِي صِحَافِي وَيَشْرَبُ فِي أَقْدَاحِي وَيَنَامُ عَلَى فِرَاشِي

হযরত আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- “আমাদের একজন আযাদকৃত গোলাম ছিলো যে কুষ্ঠরোগী ছিলো। সে আমার প্লেটে খাবার খেয়েছেন, আমার গ্লাসে পানি পান করেছেন এবং আমাদের বিছানায় শুয়েছিলেন”। (দ্রষ্টব্য- তুহফাতুল আহওয়াযী শারহু জামি তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, ৪৩৮ পৃষ্ঠা)।

উপরোক্ত হাদিস দ্বারা উদ্যেশ্য হলো যে, কোন রোগের নিজস্ব সংক্রমণ ক্ষমতা নেই। যা কিছু হয় আল্লাহর হুকুমেই হয়। [চলবে]

– মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী, শিক্ষা পরিচালক ও মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: আরএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

‘ইতিকাফ’ আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের ইবাদত