Home সম্পাদকীয় আমাদের মানসিকতাকে উপনিবেশমুক্ত করা জরুরি!

আমাদের মানসিকতাকে উপনিবেশমুক্ত করা জরুরি!

।। ইকরাম সেহগাল ।।

করোনা মহামারী ও এর সৃষ্ট নতুন সামাজিক আন্দোলন, বর্ণবাদ বাদ দিয়ে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে এনেছে। তা হলো ‘উপনিবেশবাদ’ এবং উপনিবেশবাদের ইতিহাসকে কিভাবে বিবেচনা করব।

মহামারীজনিত নিঃসঙ্গতা হতাশা বাড়িয়ে দেয়ার ফলে অনেক স্থানেই বিরোধ পরিণত হচ্ছে সংহিসতায়। কলম্বিয়ায় সমবেত বিক্ষোভকারীরা সাউথ ক্যারোলিনার রাজ্য আইনসভা ভবন থেকে কনফেডারেট পতাকা অপসারণের দাবি জানিয়েছে। অন্য চার রাজ্য- টেক্সাস, মিসিসিপি, ভার্জিনিয়া ও টেনেসিতে ওই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পতাকাটি গৃহযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর লড়াইয়ের জোরালো প্রতীক ও ক্রীতদাসত্ব ও বর্ণবাদের আইকন। কানাডায় অ্যাডওয়ার্ড কর্নওয়ালিস ও জন এ ম্যাকডোনাল্ডের মূর্তি যথাক্রমে হ্যালিফ্যাক্স ও ভিক্টোরিয়ার সেগুলোর অবস্থান থেকে অপসারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় রোডস মাস্ট ফল আন্দোলন কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সিসিল রোডসকে সম্মান জানিয়ে গড়া মূর্তি অপসারণ করেছে।

গত দশকজুড়ে মূর্তি ও মনুমেন্টগুলো রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টন নগরীতে উপনিবেশিক সামরিক কমান্ডার হ্যামিল্টনের মূর্তি টেনে নামানো হয়েছে। তার নামেই এই নগরীর নামকরণ করা হয়েছিল। ১৯ শতকে আদিবাসী মওরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন নৌকমান্ডার হ্যামিল্টন। ওয়াশিংটন ডিসিতে কলম্বাসের মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

২১ শতকেই মনুমেন্ট আন্দোলন শুরু হয়েছে এমন নয়। ইতিহাসজুড়েই রাজনৈতিক পালাবদলের সময় স্মারক স্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি আমলের স্মারক স্থাপনাগুলো উপড়ে ফেলা হয়। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসন অবসানের পর স্মারক স্থাপনায় অনেক বদল দেখা যায়। মূর্তি ও স্মারক অপসারণ অনেক সময় ইতিহাস মুছে ফেলা হিসেবে অভিহিত হয়। তবে ইতিহাস নিজেই একটি প্রক্রিয়া। এতে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন-

ওজন দরে গরু ক্রয় করে কুরবানী করা জায়েয হবে কি?

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দাম্পত্য জীবনে খাদিজা (রাযি.)এর ভূমিকা

কুরবানী এলেই তাদের পশুপ্রেম বেড়ে যায়!

ইসলামে কুরবানীর বিধান সুস্পষ্ট: এর বিকল্প অন্য কিছুতে হতে পারে না

বিদেশনীতিতে প্রবল ধাক্কা খেল ভারত

ভারত ও পাকিস্তানও উপনিবেশিক ধারার মধ্যে দিয়ে গেছে। দেশ দুটি উপনিবেশিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্তরসুরী হয়েছে। তবে তা কতটা সফল হয়েছে, তা আলাদা প্রশ্ন।

পাকিস্তানে ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে সামন্ত্রতান্ত্রিকব্যবস্থা যখন বিদায় নিয়েছে বা বিদায় নেয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, সেখানে পাকিস্তানে এটি আগের চেয়ে আরো ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সামন্ত্রতান্ত্রিকব্যবস্থা নির্মূল না করা পর্যন্ত অপরাধমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অবনমন ঘটতেই থাকবে, যদি এটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিরাজ করে।

উপনিবেশিক ইতিহাসের অসমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রিটিশদের ‘সভ্যকরণ মিশনের’ ওপর জোর দিয়ে রেলওয়ের প্রবর্তন, শিল্প প্রতিষ্ঠা, আধুনিক শিক্ষার কথা বলা হয়। পাকিস্তান এমন একটি উপনিবেশ-পরবর্তী দেশ, যেখানে উপনিবেশ-পরবর্তী ভাষ্য রয়ে গেছে, ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন্স ইত্যাদি এখনো রয়ে গেছে। এবং দেশে এখনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন কার্যত শুরু হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি ১৬০০ সালে জয়েন্ট-স্টক ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছিল। তাদের ইস্ট ইন্ডিয়া তথা ভারতবর্ষ থেকে চীন পর্যন্ত একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দেয়া হয়েছিল। ১৬১৩ সাল থেকে বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপন শুরু করে। একপর্যায়ে বিশ্ববাণিজ্যের অর্ধেক ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে সুতা, সিল্ক, নীল, লবণ, মসলা, চা ও আফিমের ব্যবসায় তাদের অবস্থানের কথা বলা যায়।

ওই সময় মোগল সাম্রাজ্য অস্তিত্বশীল ছিল। প্রয়োজন হলে তারা মোগল সম্রাটদের কাছ থেকে অনুমতি নিত। ১৮ শতকের শুরুতে বিশ্ব অর্থনীতিতে মোগল সাম্রাজ্যের হিস্যা ছিল ২৩ ভাগ। তা ছিল পুরো ইউরোপের মোট অর্থনীতির সমান। আর ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার সময় তা কমে হয় ৩ ভাগ। ব্রিটিশ শাসন ব্রিটেনের জন্য কল্যাণকর ছিল, ভারতবর্ষের জন্য নয়।

১৮ শতক থেকে বাণিজ্যিক কোম্পানিটি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে থাকে, মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সঙ্ঘাতে তারা জড়িয়ে পড়তে থাকে, ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। তারা তখন আর কেবল বাণিজ্যের মধ্যেই সীমিত ছিল না। এসব তথ্য খুবই ভালোভাবে বিন্যস্ত করা আছে উইলিয়াম ডালরিম্পলের দি অ্যানার্কি ও শশী থারুরের অ্যান এরা অব ডার্কনেস গ্রন্থে।

দুর্বল মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের দেয়া দিওয়ানির ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর উত্তোলন করার সুযোগ পায় এবং এর মাধ্যমে বাংলায় কার্যত শাসকে পরিণত হয়। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান হলে ব্রিটিশ আইন জারি হয়। এই আইন ছিল এই দেশে অপরিচিত। এটি এখানকার সামাজিক ঐতিহ্য ও স্থানীয় লোকজনের জীবনাচারকে প্রভাবিত করে।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হস্তক্ষেপ ছিল সম্ভবত ভারতবর্ষকে শিল্পায়ন মুক্ত করা। এটি করা হয়েছিল ব্রিটেনের পণ্য বিক্রির সুবিধার জন্য। কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে লিখেছিলেন যে বস্ত্রশিল্প ছিল এখানকার সমাজের ভিত্তি। এটিই ধ্বংস করে দেয়া হয়। একইসাথে ইংল্যান্ড এখানকার তুলা ইউরোপিয়ান বাজার থেকে সরিয়ে দিতে থাকে। তা করা হয় পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে। যে খাতে উপমহাদেশ ছিল বিশ্বে নেতৃত্বস্থানীয়, সেখানে তারা এখন আমদানিনির্ভর এলাকায় পরিণত হয়।

ব্রিটিশদের আরেকটি উদ্ভাবন ছিল ক্ষুধা ও মহামারী। এতেও কোটি কোটি ভারতীয়য়ের জীবন শেষ হয়। ১৯৪২ সালে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আমলে শেষ দুর্ভিক্ষ ছিল মানব সৃষ্ট। এই সময় গম অস্ট্রেলিয়া থেকে সরিয়ে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। 

ব্রিটিশরা ২০০ বছর শাসন ও লুণ্ঠন করেছিল। মাত্র হাজার বিশেক ব্রিটিশ সৈন্য ৩০ কোটি লোককে শাসন করেছিল। সব ব্যবসায়ী, পেশাগত লোক মিলিয়ে ভারতে মোট ব্রিটিশ ছিল বড় জোর তিন লাখ। এটাকে অনেকে বলে থাকেন যে ভারতীয়রা যে ব্রিটিশ শাসনকে অনুমোদন করেছিল, তার প্রমাণ এটিই। ভারতীয়দের সমর্থন ছাড়া ব্রিটিশরা টিকে থাকতে পারত না।

বস্তুত মূর্তির বিষয়টি এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। কারণ ট্রাম্প নিজে মূর্তিগুলোকে আমেরিকান ঐতিহ্য হিসেবে বহাল রাখতে চান বলে জানিয়েছেন। তার বক্তব্য জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। 

পাকিস্তানের প্রয়োজন তার অর্থনীতিকে উপনিবেশ মুক্ত করা। এর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও উপনিবেশ মুক্ত করতে হবে। আর এলিটদের সংস্কৃতি থেকেও মুক্তি পেতে হবে। এর মানে এই নয় যে বিদেশী বিনিয়োগ সীমিত করতে হবে। বরং প্রয়োজন দুর্নীতির উচ্ছেদ করা এবং আমাদের শাসনব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।