Home শিক্ষা ও সাহিত্য হযরত আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রাহ.)এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নসীহত

হযরত আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রাহ.)এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নসীহত

।। মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী ।।

বিশ্ব বরেণ্য দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক শাইখুল হাদীস ও শীর্ষ ইসলামী ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রাহ.)এর গুরুত্বপূর্ণ নসীহত থেকে দু’টি বিষয়ের উপর নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব। এক. ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এবং দুই. উস্তাদগণের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, ছাত্রদের কাজ তিনটি। যথা-

১। দরসে বসার পূর্বে-মুতালায়া করা। মুতালায়ার নিয়ম হচ্ছে- উস্তাদ যতটুকু সবক দিবেন- অনুমান করে ততটুকু পুরমান ইবারত কমপক্ষে তিনবার দেখে যাওয়া। এমনটি নয় যে, কামা-হক্কুহু বুঝতে হবে। তবে যদি এই তিন বার ইবারত পড়ার দ্বারা বুঝে আসে তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। অন্যথায়, এতটুকুর উপই ছেড়ে দিবে। এমানটি যেন না হয় যে, সামনের সবক একেবারে দেখা হয়নি। মুতালায়া করার পর দরসে বসে কোন মাসআলা উস্তাদের মুখ থেকে তেমনটি শুনে যেমনটি মুতালায়া করে বুঝেছে। তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে।

২। দরসে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সবক বুঝার চেষ্টা করবে। যদি ক্লাসে সবক বুঝে না আসে তাহলে ক্লাস শেষে মুতালায়ার মাধ্যমে বুঝার চেষ্টা করবে। তবুও যদি বুঝে না আসে তাহলে ঐ কিতাব যিনি পড়ান তার কাছে যাবে, তার পরেও যদি বুঝে না আসে তাহলে বিজ্ঞ কোন উস্তাদের স্বরণাপন্ন হবে। যে কোন মূল্যে কিতাব বুঝে নিবেই। এমনটি যেন না হয় যে, সবক বুঝলে  কোন আনন্দ নাই না বুঝলে ও কোন পেরেশানী নাই। যে ছাত্র ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকে, কোন প্রশ্নও করে না, কোন কিছু বুঝতেও চায় না, সে পড়ছে না, বরং পড়াচ্ছে।

৩। প্রতি দিনের সবক প্রতিদিন মুখস্ত করা। যে ছাত্র এক দিনের সবক মুখস্ত করল না, পরদিন তার দুই দিনের সবক জমা হয়ে গেল। আর যে দুই দিনের সবক মুখস্ত করল না, পরদিন তার তিন দিনের সবক জমা হয়ে গেল। এমন করে সবক মুখস্ত না করতে না  করতে এক বোঝা সবক হয়ে গেল, যা সে মুখস্ত করেনি। এরপর সবকের এই বিশাল বোঝা সে কীভাবে আয়ত্ব করবে?

ইলম আসে মুখস্ত করার দ্বারা। যে তালেবুল ইলেম সবক মুখস্ত করে না তার কখনো ইলম আসবে না। যেই ছাত্র সবক মুখস্ত করে না তার একটি দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে হযরত বলেন, আমি কাওকে বললাম কোন হিন্দুকে পানি পান করাতে। সে পাত্র ভরে পানি নিয়ে গেল। হিন্দু যেহেতু মুসলমানের পাত্রে মুখ লাগায় না, তাই পাত্রের সাথে হাতের তালু লাগিয়ে পানি পান করতে চাইল। এমতাবস্থায় সেই হিন্দুর মুখে কি পানি প্রবেশ করবে? কখনো প্রবেশ করবে না। ঠিক তেমনি, যেই ছাত্র সবক মুখস্ত করে না, তার কখনো ইলম হাসিল হবে না।

হযরত বলেন, আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদা জনৈক ব্যাক্তি এসে শাহ আব্দুল আজীজ (রাহ.)কে বলল, হুজুর! দিল্লীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। হুজুর বললেন, “সাহেবে খেদমত ঢিলা হ্যায়”। বলা হল, কে সেই খেদমতগার? তিনি বললেন- “জামে মসজিদ মে খরবুজ বেচনেওয়ালা সাহেবে খেদমত”। পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেই লোকটি তার নিকট গেল এবং খরবুজ ক্রয়ের ভান করে একটি খরবুজ কেটে বলল, ভাল না। এভাবে সবগুলো খরবুজ কেটে কেটে দেখল, আর বলল ভাল না। তারপর খরবুজ ক্রয় না করে চলে এলো।

আরও পড়তে পারেন-

* ‘আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা পেতে হলে সঠিক আক্বিদা-বিশ্বাসে ফিরে আসা জরুরী’

* বিশ্বব্যাপী একই দিনে ঈদ উদযাপন চিন্তা মনগড়া ও শরয়ী সিদ্ধান্ত বিরোধী

* পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানীর ফাযায়েল ও মাসায়েল

* ইসলামের পথে আমার জীবনকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি: অভিনেত্রী এ্যানি খান

* মওলানা বরকতুল্লাহ আমাদের ইতিহাসের কে হন?

এরপর কিছুদিন অতিবাহিত হলে আবার সেই লোকটি শাহ সাহেবের কাছে গিয়ে বলল হযরত এখন দিল্লীর অবস্থা খুব ভাল। তিনি বললেন, “সাহেবে খিদমত খুব টাইট হ্যায়” প্রশ্ন করা হল কে সেই সাহেবে খিদমত? তিনি বললেন, “জামে মসজিদ মে জু পানি পিলা তা হায় ওহ সাহেবে খিদমত হ্যায়” পরীক্ষা করার জন্য সাহেবে খেদমত-এর নিকট গেল এবং বলল পানি পান করাও এই বলে সে হাতের চিল্যুর মাঝে ফাকা রেখে পানি পান করতে চাইল, সাহেবে খিদমত একবার পানি দিলেন আর সব পানি পড়ে গেল, লোকটি আবার বলল পান করাও সাহেবে খিদমত পানি পান করাতে চাইলে সে আগের পদ্ধতি গ্রহণ করল। এবার সাহেবে খিদমত চটে গিয়ে বললেন, আমাকে খুরবুজ ওয়ালা পেয়েছ, যাও ভাগ; এই বলে তাড়িয়ে দিল।

হযরত উস্তাদগণের উদ্দেশ্যে বলেন, উস্তাদের কাজ তিনটি। যথা-

১। মুতালায়া করে ক্লাসে যাওয়া মুতালায়ার নিয়ম: যাকে যেই কিতাব দেয়া হবে তিনি সেই কিতাবের মুতালাল্লেকাতের উপর একতেফা করবেন না বরং সেই কিতাবের সম্পূর্ণ ফন মুতালায়া করবেন।

ফন মুতালায়ার নিয়ম: ফন মুতালায়ার ক্ষেত্রে এমনটি করা উচিত নয় যে, এক একটা কিতাব ধরলেন আর একই সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেললেন। বরং কর্তব্য হল যেই দিন যেই সবক পড়াবেন সেই সবকটির সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট বড় সকল কিতাবে দেখে নেওয়া।

উদাহরণ স্বরূপ- কেউ যদি হেদায়া কিতাব পড়ান তাহলে তিনি ফিক্বহের যত কিতাব আছে মুতালায়া করে নিবেন। উপরে ফতুওয়ায়ে আলমগিরী নিচে তালীমুল ইসলাম। কারণ হতে পারে তা’লীমুল ইসলামের একটি মাসাআলা যা তার জানা ছিল না।

২। মুতালায়ার মুতালায়া করবেন। অর্থাৎ মুতালার পর খুব ভেবে চিন্তে তার একটি সারসংক্ষেপ নিজে সাজাবেন। এই গওর ও ফিকিরের ব্যাপারে আমাদের  শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী সাহেব (দা.বা.) বলেন, হযরত ইব্রাহীম বলয়াভী (রাহ.) মুতালায় করতেন ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে। ম্যাচের কাঠি আর কতক্ষণ জ্বলে! একটি কাটি জ্বালিয়ে একটু মুতালায়া করতেন কাঠি নিভে গেলেই চোখ বন্ধ করে ঐ মুতালায়ার উপর গওর ও ফিকির করতেন। সাঈদ আহমদ পালনপুরী (দা.বা.) বলেন, যেই উস্তাদ মুতালায়ার পর চিন্তা ফিকির করে নিজ আঙ্গিকে তার সারসংক্ষেপ সাজান না, তার দৃষ্টান্ত হল ঐ শিয়ালের ন্যায়, যে শিয়াল কোন ভুট্টা বাগানে প্রবেশ করল। বাগানে প্রবেশ করে এক একটা ভুট্টা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বগলতলে রাখতে লাগল, আর সামনের দুই পা প্রসারিত করে এগোতে লাগল। এমন করতে করতে বাগানের এক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল আর বগল তলে হাত দিয়ে দেখল একটা ভুট্টাও নাই।

৩। মুতালায়ার পর নিজের আঙ্গিকে একটি পান্ডুলিপি তৈরী করা। যাতে অতিসংক্ষেপে কিতাবের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি ইঙ্গিত থাকবে। পরবর্তী বছর যদি ঐ কিতাবই দেওয়া হয়, তাহলে উস্তাদ যেন সেই পান্ডুলিপি আবলকন করে বিষয় বস্তুকে অতি সংক্ষেপে সাজিয়ে ছাত্রদের সামনে পেশ করতে পারেন।

হযরত বলেন, আমি দেওবন্দ মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়ে যখন অন্য এক মাদরাসার শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে রওয়ানা দিলাম তখন আমার উস্তাদ ইব্রাহীম বলয়ারী (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎকরার জন্য বাড়িতে গিয়ে যখন দরজার কড়া নাড়ালাম উস্তাদ দরজা খুলে বাহিরে এলেন, আমি বললাম হযরত বিদায় বেলায় আমাকে নছিহত করে দিন।

হযরত ইব্রাহীম বলয়াবী (রাহ.) অত্যন্ত ক্ষিণ আওয়াজে কথা বলতেন। তিনি অত্যন্ত আস্তে বললেন- মৌলভী সাহেব! * ফন দেখে মুতালায়া কর, তাহলে ইলেম আসবে। * সুন্নাতের পাবন্দ হও, তাহলে জনগণের কাছে তোমার ইজ্জত বাড়বে।

* ছাত্রদেরকে আপন সন্তানের মত মুহাব্বত কর তাহলে তারা তোমাকে ভালোবাসবে।

তিনি আরও বলেন, আমি আমার উস্তাদ (ইব্রাহীম বলয়ারী) এর মাথায় তৈল মালিশ করছিলাম। তখন আমি চাইতাম কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতে। হুজুর বললেন, মৌলভী সাহেব, মাথায় তেল কেন দেওয়া হয়? যাতে ঘুম আসে। এখন কথা বললে তো আর ঘুম আসবে না। তাছাড়া হুজুর মাথায় তেল মালিশ করার সময় কোন কথা বলতেন না। আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে তৎক্ষণাত বললাম, হুজুর ভুল হয়েছে, আর কখনো এমনটি হবে না। কিন্তু একটা হুজুরের অভ্যাস বহির্ভুত কাজ হয়ে গেল। আমি মাথায় তেল মালিশ করছিলাম, হুজুর বললেন মৌলভী সাহেব, ছাত্র তিন প্রকার।

১। ঐ সকল ছাত্র, যারা মাদরাসার আসছে ইলমে দ্বীন অর্জন করার লক্ষে, এই প্রকার ছাত্র খুবই কম।

২। ঐ সকল ছাত্র, যাদের ইলমে দ্বীন হাসিল উদ্দেশ্যে নয়। বরং পারিবারিক চাপের কারণে মাদ্রাসায় আসছে অথবা বাবার/দাদার আশা পূরণ করার জন্য মাদরাসায় আসছে। বাবার আশা আমার ছেলে আলেম হবে, হাফেজ হবে, এই প্রকার ছাত্রই মাদরাসায় বেশি।

৩। ঐ সকল, ছাত্র যাদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অভিভাবক এই ভেবে মাদরাসায় দিয়ে যায় যে, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে খেয়ে কোন মতে বড় হোক, তারপর নিজের বুঝ নিজেই বুঝবে। এই প্রকার ছাত্রও খুব কম। হুজুর কথা শেষ করতেই আমি বললাম, হযরত! উস্তাদও তিন প্রকার। হযরত একটু নিরব থেকে বললেন, বর্ণনা দাও। আমি বললাম-

১। ঐ উস্তাদ, যিনি মুতালায়া করে নিজস্ব চিন্তা ফিকিরের মাধ্যমে সারসংক্ষেপ বের করত: ছাল-বাকল ফেলে দিয়ে মূল বিষয়টি ছাত্রের সামনে পেশ করেন। ছাত্র অতি সহজেই সবক বুঝে নেয়।

২। ঐ উস্তাদ, যিনি মুতালায়া করে ছাল-বাকল সহ ছাত্রের কাছে ঢেলে দেন। আর ছাত্র পেরেশানীতে পড়ে যায় এইভেবে যে, কোনটা গ্রহণ করবে আর কোনটা তরক করবে? ফলাফল এই দাড়ায় যে, ছাত্ররা সবক বুঝতে পারে না।

৩। ঐ উস্তাদ, যিনি মোটেও মুতালায় করেন না, ক্লাসে এসে হাশিয়া দেখায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছাত্র এবারত পড়ে আর উস্তাদ এদিক ওদিক হাশিয়া দেখায় ব্যস্ত। ছাত্র এবারত পড়া শেষে ছেড়ে দেন এক হাওয়াই তাকরীর, কিতাবের সাথে সম্পর্ক থাকুক, চাই না থাকুক।

হযরত বললেন, এবার বল কোন উস্তাদ আমি? বললাম- হযরত এটা জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ, আপনিও তো একজন উস্তাদ।

দ্বিতীয় প্রকার উস্তাদের ক্ষেত্রে পালনপুরী (রাহ.) একটি উদাহরণ পেশ করেন। দেখ, ঘী কত উপকারী। কিন্তু যদি কেউ একাই এক বতল ঘী খেয়ে ফেলে, তাহলে তার অবস্থা কেমন হবে! বদনা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তার অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়াবে।

অনুরূপ আরেকটা উদাহরণ পেশ করেন। এক লোক এক বোতল মধু ক্রয় করে অল্পক্ষণের মধ্যেই সবটুকু মধু খেয়ে শেষ করে ফেলে, এই মধুর প্রতিক্রিয়ায় তার গোটা শরীরে ফোস্কা উঠে ভরে গেল। এই রোগ নিরাময়ের জন্য সে একজন হাকীম এর নিকট গেল। হাকীম ছিলেন একজন বড় আলেম। হাকীম তাকে ঔষধ দিলেন। সে ঔষধ নেওয়ার সময় বললেন, হাকীম সাহেব আমার একটি কথা ছিল। হাকীম বললেন, বল কি কথা?

সে বলল, আল্লাহ তায়ালা মধুকে মানুষের উপকারের জন্য বানিয়েছেন। তাহলে আমার এমন বেগতিক অবস্থা হল কেন? হাকীম সাহেব বললেন, আল্লাহ তা’য়ালা মধুকে উপকারী করেছেন মানুষের জন্য মহিষের জন্য নয়। হযরত শেষ কথায় বললেন যে, মানুষের ইলেম অর্জন হয় পড়ার দ্বারা পাড়ানোর দ্বারা নয়। যেই ছাত্র ক্লাসে সবক বুঝতে চাইল না বরং চুপ চাপ বসে রইল, সে যেন পড়ে না, বরং পড়াইল। আর যেই উস্তাদ মুতালায়া করে নিজস্ব আঙ্গিকে সারসংক্ষেপ বের করল না, সে যেন পড়ল, পড়াল না। এভাবে বছরের পর বছর পড়িয়ে যাবেন, কিন্তু ইলেম তার হাসিল হবে না।

মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী, ফারেগে দারুল উলূম দেওবন্দ এবং শিক্ষা সচিব- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।