Home মহিলাঙ্গন ইসলামের ইতিহাসে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নারী

ইসলামের ইতিহাসে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নারী

-ফাইল ছবি।

হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ার সব নারীর মধ্যে চারজন নারীর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তারা হলেন হযরত মরিয়ম (আ.), হযরত আসিয়া (আ.), হযরত খাদিজা (রাযি.) ও হযরত ফাতেমা (রাযি.)। এ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসে আরও অসংখ্য নারী ছিলেন যারা জ্ঞানে, গুণে, সততা আর প্রজ্ঞায় এখনো সব নারীর জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রেষ্ঠ মুসলিম নারীদের নিয়েই আজকের আয়োজন।

হযরত খাদিজা (রাযি.)

আরবের কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হযরত খাদিজা (রাযি.)। তারপরও অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন তিনি। ইসলাম আবির্ভাবের আগে তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তৎকালীন সমাজে সৎকর্ম ও দানশীলতার ক্ষেত্রে হযরত খাদিজার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। বিজ্ঞ ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির খাদিজা ছিলেন হিজাজের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী। আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝোঁক ছিল তার।

জানা যায়, তিনি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন এবং তিনি আরবের সচেতন ও শিক্ষিত প্রবীণদের কাছে শেষ নবীর নিদর্শন সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। কিন্তু নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটে খাদিজার। তিনি বুঝতে পারলেন, সমাজের অতুলনীয় ও পবিত্রতম পুরুষ হচ্ছেন মুহাম্মদ (সা.)। রাসুলের গুণাবলি তাকে আকৃষ্ট করে। এরপরই ৪০ বছর বয়সে তিনি ২৫ বছরের রাসুলকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবন। এই বিয়েকে তৎকালীন সমাজ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সম্পদহীন মুহম্মদ (সা.)-কে বিয়ে করায় অনেকেই তাকে তাচ্ছিল্য করতেন।

কুরাইশ বংশের এক দল অহংকারী ও নিন্দুক মহিলা তাকে গরিব মুহাম্মদের প্রসঙ্গ টেনে কটাক্ষ করত। তিনি উত্তর দিতেন, ‘তার মতো আর কেউ কি আছে? তার মতো সচ্চরিত্রবান ও মর্যাদাবান দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে কি তোমরা চেনো?’ ওইসব মহিলার বিদ্বেষমাত্রা এত বেশি ছিল যে, খাদিজার সন্তান প্রসবের সময় বিন্দু পরিমাণ সহযোগিতাও কেউ করেনি।

ইসলাম গ্রহণের পর সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার সকল সম্পদ রাসুলকে উপহার দিয়েছিলেন। শোয়াবে আবু তালিব নামক উপত্যকায় মুসলমানরা যখন বিচ্ছিন্ন ও অবরোধের শিকার হয়েছিল, তখন তার আর্থিক সহযোগিতা মুসলমানদের টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল। কোনো কারণে রাসুল (সাঃ)-এর মন খারাপ থাকলে তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতেন এবং সকল কাজে পরামর্শ দিতেন।

মুসলমানদের ওপর অবরোধ আরোপের পর খাদিজা (রাযি.) অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। এত সম্পদের মালিক হয়েও তিনি দীর্ঘদিন শুষ্ক এক উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেছেন। ইসলামের জন্য তার অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ওই উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করার কারণে খাদিজার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর ফলেই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। ইসলামের এই মহীয়সী নারী ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ রমজান ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

বিবি মরিয়ম (আ.)

বিবি মরিয়ম বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরেই নাছেরা শহরের বাসিন্দা ছিলেন। পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন সুশীলা এবং ধর্মানুরাগী। তার পিতার নাম ছিল ইমরান এবং নবী জাকারিয়া (আ.)এর শ্যালিকা বিবি হান্না ছিলেন তার জননী।

একদিন মরিয়ম নামাজ পড়ছিলেন, হঠাৎ ফেরেশতা জিব্রাইল অবতীর্ণ হয়ে বললেন, ‘তুমি আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তা। আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন।’

বিবি মরিয়ম এই অপ্রত্যাশিত সম্বোধনে ভীত হলেন। জিব্রাইল বললেন, ‘আমি আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাইল। তুমি ভীত হয়ো না; পবিত্র সন্তান লাভ করবে তুমি, এই সুসংবাদ তোমাকে দিতে এসেছি।’

মরিয়ম বললেন, ‘তা কেমন করে, আমি যে কুমারী।’

ফেরেশতা বললেন, ‘আল্লাহর কুদরতেই হবে এটি। তার কাছে এটি কঠিন কাজ নয়।’ এই বলে জিব্রাইল মিলিয়ে গেলেন।

যথাসময়ে বিবি মরিয়ম গর্ভধারণ করলেন। কিন্তু কুমারী নারীর এভাবে গর্ভবতী হওয়ার ফলে সবাই তাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বের করে দিলেন। এমনকি তাকে স্বগ্রামও ছেড়ে যেতে হলো। বিপদাপন্ন মরিয়ম কোনো আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে একটি শহরের দ্বারপ্রান্তে আস্তাবলের একটি পতিত জমিনে এক খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন এবং সঙ্গী-সহায়হীন অবস্থায় একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। এই পুত্র সন্তানই ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। আট দিন বয়সে সদ্যোজাত ঈসার ত্বক ছেদন করা হয়। মরিয়ম শুচি-স্নাতা হওয়ার পর সন্তান নিয়ে আবারও বাইতুল মুকাদ্দাসে ফিরে গেলেন।

আরও পড়তে পারেন-

এদিকে, মরিয়ম স্বপ্ন দেখলেন, সম্রাট হিরুইস এই সন্তানের শত্রু, সে তাকে হত্যা করতে চায়। সে যেন শিশুকে নিয়ে মিসরে চলে যায়। মরিয়ম তার সন্তান নিয়ে মিসরে রওনা হয়ে যান। হিরুইস যত দিন জীবিত ছিল, ততদিন সন্তান নিয়ে তিনি মিসরেই অবস্থান করেন। হিরুইসের মৃত্যুর পর তিনি নিজ দেশ নাছেরায় ফিরে আসেন।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈসার মধ্যে প্রখর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ম মেধাশক্তির পরিচয় ফুটে উঠল। আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ যে তার ওপর রয়েছে, দিন দিন তা প্রকাশ পেতে শুরু করল। ক্রমান্বয়ে হযরত ঈসা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ করতে লাগলেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ‘ওহি’ লাভ করেন এবং নবীরূপে ধর্মপ্রচার করতে শুরু করেন।

বিবি আসিয়া (আ.)

অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার জ¦লন্ত প্রমাণ বিবি আসিয়া (আ.)। দুনিয়ার আরাম-আয়েশকে পদাঘাত করে আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রধান্য দিয়েছেন তিনি।

আসিয়া (আ.)-এর কোলে লালিতপালিত হন আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুসা (আ.)। শিশু মুসাকে যখন তার মা ফেরাউনের ভয়ে সিন্দুকে ভরে নীল নদে নিক্ষেপ করেন, তা ভাসতে ভাসতে সেই ফেরাউনের ঘাটে গিয়েই ঘুরপাক খেতে থাকে। পাপিষ্ঠ ফেরাউন সিন্দুকটি উঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার অপবিত্র হাতে তা উঠছিল না। কিন্তু বিবি আসিয়া যখন আল্লাহর নামে তা ওঠানোর জন্য হাত দেন, সঙ্গে সঙ্গে তা উঠে আসে। সিন্দুক খুলে একটি পুত্রসন্তান দেখে ফেরাউনের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কারণ ফেরাউন গণকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল, ইসরাইল বংশে এক শিশুপুত্র জন্ম নেবে, যার হাতে তার রাজত্ব ধ্বংস হবে। কিন্তু তার স্ত্রী আসিয়া (আ.) শিশুটিকে লালন পালনের আগ্রহ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না।’ স্ত্রীর দাবির সামনে ফেরাউন নমনীয় হয়।

আল্লাহ তায়ালা হযরত আসিয়া (আ.)-এর অন্তরে শিশু মুসা (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। তিনি তাকে নিজ ছেলের মতো ভালোবাসতে থাকেন।

হযরত আসিয়া (আ.) ছিলেন মিসরের অধিবাসী মুজাহিমের মেয়ে। তার বাবা তাকে মিসরের ফেরাউন (বাদশাহ) দ্বিতীয় রামসেসের সঙ্গে বিয়ে দেন। ফেরাউন ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী ও কুখ্যাত। নিজেকে তিনি খোদা বলে দাবি করতেন। কিন্তু আসিয়া (আ.) ফেরাউনের ভ্রান্ত দাবি, বিশ্বাস ও স্বৈরাচার নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ফেরাউন তার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। আসিয়ার ওপর নেমে আসে জুলুম-নির্যাতন। ফেরাউনের নির্দেশে তাকে জিঞ্জিরে বেঁধে রাখা হয়, বিরাট পাথরের নিচে তাকে চাপা দিয়ে রাখা হয়। পাথরের আঘাতে তার পবিত্র দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। এমনকি তার চোখও উপড়ে ফেলা হয়। কিন্তু এসব অমানবিক নির্যাতনেও আসিয়ার বিশ্বাসকে চুল পরিমাণ টলানো সম্ভব হয়নি।

হযরত ফাতেমা (রাযি.)

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার প্রথম স্ত্রী খাদিজার মেয়ে ছিলেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ। সারা বিশ্বের মুসলমানরা তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। মক্কায় কোরাইশদের দ্বারা মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নির্যাতন ও দুর্দশার সময়ে সব সময়ই ফাতেমা তার পাশে ছিলেন। ফাতেমা মহানবী (সা.)-এর মেয়ে হয়েও স্নেহময়ী মায়ের মতো মহানবীকে ভালোবাসতেন বলেই তার উপাধি হয়েছিল ‘উম্মে আবিহা’। এর অর্থ ‘তার পিতার মা’। মহান আল্লাহর নির্দেশে হিজরতের সময় হযরত ফাতেমাও নবী পরিবারের অন্যদের সঙ্গে হিজরত করেন। তিনি ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদিনের চতুর্থ খলিফা ইসলামের বীর সৈনিক হযরত আলী (রাযি.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী এবং ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শহীদ হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের মা।

ফাতেমা (রাযি.)-এর মা খাদিজা (রাযি.) মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে যান। মহীয়সী মায়ের মতো তিনিও সকল ধন-সম্পদ ইসলাম প্রচারের জন্য তার বাবার হাতে তুলে দেন। বদান্যতা, মহানুভবতা ও দরিদ্রদের প্রতি তার মমতা এতই বেশি ছিল যে, কোনো অসহায় বা ভিক্ষুক কখনোই কিছু না পেয়ে তার ঘরের দরজা থেকে খালি হাতে ফিরে যায়নি।

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর চরিত্রের প্রতিটি গুণই তার জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী, আমানতদারী, লাজুক, নম্র ও সরলমনা। শৈশব থেকেই হযরত ফাতেমা ছিলেন নির্ভীক, তেজস্বিনী ও বক্তা। তিনি সর্বদা তার বাবা হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতেন এবং মা বিবি খাজিদা (রাযি.)-এর আদেশ ও উপদেশাবলি বাস্তব জীবনে পালন করতেন। তার জন্ম সম্পর্কে নানা মতভেদ রয়েছে। তিনি ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে, প্রথম কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পাঁচ বছর পর কাবাঘর সংস্কারের সময় জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। হযরত ফাতেমার মর্যাদা  সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ার সব নারীর ওপর চারজন নারীর মর্যাদা রয়েছে। তারা হলেন হযরত মরিয়ম (আ.), হযরত আসিয়া (আ.), হযরত খাদিজা (রাযি.) ও হযরত ফাতিমা (রাযি.)। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে হযরত ফাতেমার (রাযি.) মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত আয়েশা (রাযি.)

আয়েশা বিনতে আবু বকর (রাযি.) ছিলেন নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী। নবীজির খুব প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আয়েশা। মুসলিম সম্প্রদায় তাকে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকেন। ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে, তাকে ‘উম্মুল মুমিনিন’ বা ‘বিশ্বাসীদের মাতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়া ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসেও তার অবদান অনস্বীকার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে হযরত আয়েশা (রাযি.) ছিলেন নজিরবিহীন। কোরআন-হাদিসের জ্ঞান এবং ইসলামি শরিয়তের মাসলা-মাসায়েলের ব্যাপারে তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। প্রাচীন আরবের অবস্থা এবং প্রাচীন আরবি কাব্য সম্পর্কে তার অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে ছয় বছর বয়সে মতান্তরে নয় বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। নবীজির স্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট বয়সের। মৃত্যুর সময় মুহাম্মদ (সা.) তার ঘরেই ছিলেন এবং তার এই প্রিয়তমা স্ত্রীর বাহুযুগলে মাথা রেখেই মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর জনগণ আবু বকর (রাযি.)-কে খলিফা নির্বাচন করেন। তখন আয়েশা (রাযি.) নবী (সা.)-এর স্ত্রী এবং খলিফার মেয়ে হিসেবে সমধিক সম্মান পেতেন। আবু বকর (রাযি.) তার মৃত্যুর আগে ওমর (রাযি.)-কে খলিফা নিযুক্ত করে যান। খলিফা ওমর (রাযি.)-এর শাসনামলেও তিনি দাপটের সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহে মতামত প্রদান করার স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে বসরার যুদ্ধ বা উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত যুদ্ধে তিনি পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন। ইতিহাসে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যিনি সামনে থাকা অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) কাছে ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রাযি.) ছিলেন তার বাবা। আয়েশা (রাযি.) ৬১৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে মতান্তরে ৬১৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে জন্মগ্রহণ করেন। রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৮ হিজরি সনের ১৭ রমজান (১৬ জুলাই, ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। তাকে দাফন করা হয় জান্নাতুল বাকিতে। তার মাতার নাম উম্মে রুমান।

রাবেয়া বসরী (রাহ.)

ইরাকের বসরা নগরীতে এক দরিদ্র পল্লীতে জন্ম হয়েছিল হযরত রাবেয়া বসরীর (রাহ.)। দরিদ্র হলেও তার পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্মানিত। বাবার নাম ইসমাঈল ও মায়ের নাম মায়ফুল। প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী ছিলেন তিনি। সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। তার জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে বলা হয় ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই মহীয়সী নারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

কথিত আছে, তার বাবা এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন, যে রাতে রাবেয়া বসরী (রাহ.) জন্মগ্রহণ করেন, তখন ঘরে বাতি জ্বালাবার তেল এবং প্রসূতি ও সন্তানের পেটে মালিশ করার তেল পর্যন্ত ছিল না। রাবেয়ার আগে তার বাবার আরও তিনটি মেয়ে হয়েছিল। তিনি চতুর্থ নম্বর বলে তার নাম রাবেয়া রাখা হয়। আরবি ভাষায় রাবেয়া শব্দের অর্থ চতুর্থা। রাবেয়া বসরী (রাহ.) মা-বাবার কাছ থেকে কোরআন, হাদিস ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি কখনো কারও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। সব সময় তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন। তিনি একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করে সেখানে নীরবে দিন-রাত ইবাদতে রত থাকতেন। আল্লাহর একজন প্রকৃত ওলি হওয়ার জন্য যা যা গুণাবলি থাকা প্রয়োজন সকল গুণের অধিকারিণী ছিলেন হযরত রাবেয়া বসরী (রাহ.)। সে সময় স্বনামধন্য অনেক সুফি রাবেয়া বসরীর (রাহ.) কাছে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসতেন। রাবেয়া বসরী দাসত্বের জীবনও অতিবাহিত করেছেন। বিরামহীন ভাবে সারা দিন কাজ করে আল্লার ইবাদতে মশগুল হয়ে যেতেন। রাবেয়া বসরীর উদ্দেশ্যই ছিল আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভ করা। রাবেয়া বসরীর ইবাদত-বন্দেগি দেখে তার মনিব তাকে দাসত্ব জীবন থেকে মুক্ত করেন।

একবার মুনাজাতের সময় তিনি বলছিলেন ‘হে আল্লাহ। যদি জান্নাতের লোভে ইবাদত করি তাহলে আমি যেন কখনোই জান্নাতে না যাই আর যদি জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করি তাহলে যেন আমি জাহান্নামে যাই। কিন্তু আল্লাহ আমি যদি শুধু তোমাকে ভালোবেসে তোমার ইবাদত করি তাহলে আমি যেন কখনোই তোমার দর্শন থেকে এক মুহূর্ত বঞ্চিত না হই।’ এই মহীয়সী নারী ৮০১ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আরও যারা

যুবায়দা (রাযি.) : ১৮৬ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী বিবি যুবায়দা হজ পালনকালে মক্কায় হাজিদের পানির কষ্ট দেখতে পান। তখন তিনি পাহাড়ের জলপ্রপ্রাত থেকে মক্কা শহর পর্যন্ত খাল কাটার নির্দেশ দেন। তার একক প্রচেষ্টায় ও ব্যক্তিগত খরচে প্রায় সাড়ে ষোল কিলোমিটার লম্বা খাল খনন করা হয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে হাজি ও মুসাফিরদের পানির যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, মক্কা থেকে তায়েফমুখী এই খাল খননকার্যে বিবি যুবায়দা আনুমানিক ৫৯৫০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ খরচ করেছিলেন। ইতিহাসে এটি ‘উয়ুন যুবায়দা’ বা ‘বিরকাতে যুবায়দা’ হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং ১২০০ বছর পরও এখান থেকে সেচপ্রকল্প অব্যাহত আছে।

হাফসা (রাযি.) : পশুর চামড়া ও হাড়ের ওপর লিখিত কোরআনের প্রথম পান্ডুলিপি হযরত ওমরের (রাযি.) কন্যা হাফসার (রাযি.) কাছে সংরক্ষিত ছিল। ইসলামি খেলাফতের অধীন বিভিন্ন প্রদেশে কোরআনের ছয়টি অপ্রামাণ্য সংকলন প্রচলিত ছিল। হযরত হাফসার (রাযি.) কাছে কোরআনের প্রামাণ্য পান্ডুলিপি সংরক্ষিত থাকায় খলিফা উসমানের (রাযি.) পক্ষে অপ্রামাণ্য সংস্করণগুলো ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে হাফসার (রাযি.) যোগ্যতা ও নৈতিক অবস্থান কতটা নির্ভরযোগ্য ছিল তা অনুমান করা যায়। তিনি কিন্তু রাসুলের স্ত্রীও ছিলেন।

এছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে জানা যায়, হুদায়বিয়ার সংকটে হযরত মুহাম্মদ (সা.) উম্মে সালমার (রাযি.) পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন।

অষ্টম শতাব্দীর স্কলার ফাতেমা আল বাতায়াহিয়্যাহ দামেস্কে সহিহ বুখারির দরস দিতেন। তৎকালীন তিনি সবচেয়ে বড় মাপের স্কলারদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

দ্বাদশ শতকে আরেকজন স্কলার ছিলেন জয়নব বিনতে কামাল। তিনি চার শতাধিক হাদিসের কিতাব পড়াতেন।

ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ আল সমরকন্দির কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন একজন ফিকাহবিদ। কীভাবে ফতোয়া ইস্যু করতে হয়, সে বিষয়ে তিনি তার অধিকতর বিখ্যাত স্বামীকে পরামর্শ দিতেন।

যেসব নারী সাহাবি কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আরওয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, হযরত খানসা, সওদা বিনতে কোরায়য (হযরত উসমান (রাযি.)-এর খালা), হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দুধবোন শায়মা, আতেকা বিনতে যায়দ ও অন্যান্য।

হযরত খানসা (রাযি.)-এর কবিতা নবীজি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে শুনতেন, আর হাতে ইশারা করে বলতেন, হে খানসা, আরও কিছু শোনাও।

কারিমাহ আল মারওয়াযিয়্যাহ ছিলেন অনেক উচ্চস্তরের হাদিস বিশারদ। এছাড়াও ইমাম বুখারি প্রায় ৮০ জন নারী হাদিস বিশারদের কাছ থেকে হাদিস গ্রহণ করেছিলেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।