Home পরিবার ও সমাজ যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন, ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা: কী বলছেন আলেম ও সমাজ বিজ্ঞানীরা

যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন, ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা: কী বলছেন আলেম ও সমাজ বিজ্ঞানীরা

আবুল কালাম: পারিবারিক ভাঙনে যৌথ পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। যার কারণে শেষ বয়সে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের নির্ভশীলতা বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া প্রবীণদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী পরিবার থেকে আসা। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত। ফলে সম্মানের ভয়ে শেষ ভরসা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আধুনিকতার কারণে দিন দিন বদলে যাচ্ছে মানুষ। নগরায়ন ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশসহ বিভিন্ন কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা কমে আসছে। এসব কারণে শহর তো দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামেও ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে। সন্তানরা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রীর একক পরিবার গড়ে তুলছেন। ফলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন।

রাজধানীর আগারগাঁয়ে অবস্থিত প্রবীণদের আবাস্থল ‘প্রবীণ হিতৈষী সঙ্ঘ’। সংস্থাটির বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ড. মহসিন কবির লিমন জানান, দেশে বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা প্রায় ১৩টি। তার মতে, প্রবীণদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়ে তারা নিশ্চত হতে পেরেছেন। তার মধ্যে হলো- যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে যাওয়ার কারণেই পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। ফলে শেষ বয়সে নিজের গড়া আলিশান বাড়িতেও তারা আপনজনের কাছে পর হয়ে যান। একটা সময় সব ছেড়ে নির্ভরশীলতার জায়গা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নেন তারা।

তিনি জানান, বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তাদের প্রায় শতভাগ উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তশালী পরিবারের। এদের কারো সন্তান বিদেশে। তাকে দেখার কেউ নেই বলে এখানে আশ্রয় নেন। আবার এমনও আছেন, যারা সন্তানের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সব ছেড়ে নিরাপদ আবাসন হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকে সঙ্গী করেন।

আরও পড়তে পারেন-

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা স্বজনবিহীন জীবন কাটান তারা। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে পারিবারিক স্মৃতি স্মরণ করে চোখের পানিতে সান্ত্বনা খুঁজেন। আবার এমন ঘটনাও ঘটে যে, একজন মারা গেলে জানানোর পর সন্তানরা লাশও নিতে আসে না।

প্রবীণ হিতৈষী সঙ্ঘের আরেক কর্মকর্তা জানান, এখানে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, একটা বয়সে মানুষ নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চান। কিন্তু সেই সুযোগটা যখন পরিবারে পান না তখন বিকল্প চিন্তা করেন। প্রবীণ নিবাসে থাকা অগ্রজরা সে রকম চিন্তা থেকেই এখানে এসেছেন।

এ বিষয়ে শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলছেন, জাতীয় শিক্ষা থেকে ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা তুলে দেওয়া, পুঁজিবাদি ভোগবাদের অতি প্রচারণা, বাধাহীন ভিনদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, পারিবারিক অনুশাসন বিরোধী প্রচারণা এবং বিশেষ করে ভোর বেলায় শিশুদের কেজি স্কুল শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে ফোরকানিয়া মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার কুফলের কারণেই ক্রমান্বয়ে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।।

আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক আরো বলেন, গত দুই দশক আগেও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ভোর বেলায় শিশুদেরকে পবিত্র কুরআন ও ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষার্জনের জন্য অভিভাবকরা মক্তবে পাঠাতেন। মক্তবে কুরআন ও মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদেরকে ইসলামের আলোকে পিতা-মাতার সেবা, আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা ও পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝানো হতো। অন্যথা পরকালীন কঠিন আজাবের ভয়ের কথা শোনানো হতো। শিশু মনে এসব সৎ ও সুন্দর পাঠ গেঁথে যেতো। যেটা বড় হলেও তাদের অন্তর থেকে মুছে যেতো না। ধনী-গরীব প্রায় সকল পরিবারের শিশুরাই মিলেমিশে মক্তবে পড়তো। এতে শিশু মনে সহনশীলতা ও সাম্যের চর্চাও হতো। কিন্তু পুঁজিবাদি ষড়যন্ত্রের ফলে বিগত ৮০-এর দশক থেকে কেজি স্কুল শিক্ষা চালু করে ক্রমান্বয়ে মক্তব শিক্ষাকে ধ্বংস করা হয়। যার কুফল হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধি ও পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া আমরা দেখতে শুরু করেছি। আগামীতে এটা আরো ভয়াবহ আকারণ ধারণ করার আশঙ্কা আছে।

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলছেন, প্রবীণরা স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সাথেই থাকতে চান। কিন্তু যৌথ পরিবারে ভাঙন এখন স্বাভাবিক বিষয়।

তারমতে, বর্তমান সময়ে আধুনিক নগরায়ন ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ নানান কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। কারণ, সময়ের সাথে সাথে সামাজিক অবস্থা এবং পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট সেবা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রবীণ অরক্ষিত হয়ে পড়ছেন। যার কারণে নিরাপদ স্থান হিসেবেই তারা বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিচ্ছেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।