Home মহিলাঙ্গন মৃত্যুদন্ডের আইনের পরও ধর্ষণ কেন বাড়ছে?

মৃত্যুদন্ডের আইনের পরও ধর্ষণ কেন বাড়ছে?

।। মুনশী আবদুল মাননান ।।

মৃত্যুদন্ডের আইনের পর ধর্ষণ বেড়েছে তিন গুণ, এমন খবরে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে তাদেরই বেশি হতাশ হওয়ার কথা, যাদের দৃঢ় ধারণা ছিল, মৃত্যুদন্ডের মতো কঠোর সাজা নির্ধারিত হলে ধর্ষণ নিরুদ্ধ হবে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করতে হবে, সম্প্রতি এমন একটা আন্দোলনও দেখা দিয়েছিল। সরকার এ আন্দোলন বাড়তে না দিয়ে চটজলদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে মৃত্যুদন্ডের বিধান করেছে।

গত ১৩ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে যে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, ১৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদ সেই অধ্যাদেশই আইন হিসাবে পাস করেছে। ধর্ষণ বাড়ার কারণে যারা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন বা হতে চেয়েছিলেন এবং আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা সবাই বিস্মিত ও হতবাক হয়েছেন। এটা ভাবাই তো সঙ্গত, কঠোর সাজার বিধানের পর ধর্ষণ বন্ধ না হলেও কমবে। বাড়বে কেন? তাও আবার তিনগুণ? আলোচ্য খবরে জানানো হয়েছে, ১৪ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১ মাস ১০ দিনে ১৯১টি ঘটনায় নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন। একই সময়ে অর্ধশতাধিক নারী ও শিশু যৌন পীড়নের শিকার হয়েছে।

ধর্ষণের একটা সয়লাব শুরু হয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধা- কেউই ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নারীমাত্রই অনিরাপদ, অরক্ষিত। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে- কোথাও তাদের নিরাপত্তা ও নিশ্চিত সুরক্ষা নেই। ধর্ষণ নতুন উপসর্গ নয়। আগেও ছিল। তবে এত ব্যাপক ছিল না। এত বেপরোয়া ছিল না। করোনার আগে ধর্ষণের একটা ঢেউ লক্ষ করা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মধ্যে ওই ঢেউ আরো প্রবল ও বেগবান হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র চলতি বছরের ৯ মাসের একটি হিসাব দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত ৯ মাসে ৯৭৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা আছে ২০৮টি।

সংস্থার মতে, আইন কঠোর হওয়ার পরও ধর্ষণ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৬টি। অক্টোবরে বেড়ে হয়েছে ৩৭৪টি। আগস্টে ছিল ১৪৮টি। ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। ডিএমপির তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে মামলা হয়েছে ৬০টি, অক্টোবরে যার সংখ্যা হয়েছে ৮৫টি। মামলার এমন চিত্র গোটা দেশেই লক্ষযোগ্য। উল্লেখ করা দরকার, ধর্ষণের সংখ্যা আর মামলার সংখ্যা কখনো এক বরাবর হয় না। ধর্ষণের শিকার অনেকেই এবং তাদের পরিবার-পরিজনও মামলাকে বাড়তি ঝামেলা কিংবা বিড়ম্বনাকর মনে করে এদিকে পা বাড়ায় না। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ভিকটিম বা তার পরিবার অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পতিত হয়। সামাজিক ব্যাপার তো আছেই। সেই সঙ্গে আছে ধর্ষক বা তার পরিবারের হুমকি।

দেখা গেছে, অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক বা তার পরিবার ভিকটিম বা তার পরিবারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অর্থশালী ও প্রভাবশালী। হয়তো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এমতাবস্থায়, মামলা করার সাহস দেখানো অনেকের পক্ষেই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাছাড়া দ্রুত বিচার পাওয়া যাবে, তেমন নিশ্চয়তাও নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন সম্পর্কিত মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছেছে। প্রতিবছর গড়ে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শাস্তি পাচ্ছে প্রতি হাজারে ৪ দশমিক ৫ জন। অর্থাৎ সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ জন। এভাবে ৯৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন-

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিলম্বিত বিচার, ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা, অপরাধ করেও বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন না হওয়ার সুযোগ, সরকারি দলের লোক হলে ‘সাত খুন মাফ’, এমন অবস্থাসহ নানা কারণে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বিচারের প্রক্রিয়া ও প্রক্রিয়াগত জটিলতাও এই আস্থাহীনতার সংস্কৃতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অন্যান্য আইনের মামলার মতই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচারও বিলম্বিত হয়। উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা আছে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার। কিন্তু এ নির্দেশনা তেমন একটা পালিত হয় না। উচ্চ আদালত থেকেই স্থগিতাদেশ দেয়ার ফলে অনেক মামলার বিচার প্রক্রিয়া থেমে যায়। স্থগিতাদেশের কারণে ধর্ষণ মামলা ২১ বছর পর্যন্ত আটকে আছে, এরূপ নজিরও রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভুক্তভোগীরা তাহলে বিচার পাবে কবে? বলাবাহুল্য, এর কোনো জবাব নেই।

ধর্ষণের তান্ডব বাড়ার কারণে একশ্রেণির পুরুষের মানসিকতা বিশেষভাবে দায়ী। তারা মনে করেন, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন তেমন কোনো অপরাধ নয়। নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের অসদাচরণ তাদের অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এ অপচিন্তা ও মানসিকতা তাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্ররোচিত করে। ধর্ষণ-নির্যাতন করে বিচার বা শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া তাদের অনুরূপ অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করে বৈকি। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করেছে এমন ৮৮ শতাংশ গ্রামীণ ও ৯০ শতাংশ শহরে উত্তরদাতা বলেছে, তাদের কোনো আইনী ফলভোগ করতে হয়নি। বাস্তব অবস্থা যদি এই হয়, তবে ধর্ষণ তো বাড়বেই। নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়বে। যাদের ধর্ষণ বা নির্যাতন করার পরও কোনো আইনী ফল ভোগ করতে হয়নি। তাদের দেখাদেখি একই রকম অপরাধ করার প্রবণতা অন্যদের মধ্যে দেখা দেয়া অসম্ভব নয়।

সমাজের প্রভাবশালীরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যখন বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন দেশে অপরাধ ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। এর নজির আমাদের দেশে যেমন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তেমনি লক্ষযোগ্য। আমাদের দেশে খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক কারবার, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার ইত্যাদি অপরাধ বাড়ার সঙ্গে ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনও বেড়েছে। এসব অপরাধের পেছনে প্রায় অনিবার্যভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, সরকারি দলের লোকজন এবং প্রশাসন ও পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তা কোনো না কোনোভাবে জড়িত অথবা সহায়ক। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেও এর ব্যক্তিক্রম লক্ষ করা যায় না। দেখা গেছে, সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের কেউ কেউ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অপরাধ করেছে কিংবা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অথচ, অনেকেই যথারীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আইনের দৃষ্টি যদি এ রকম পক্ষপাতদুষ্ট হয়। তবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন কমানো বা নিরোধ করা সম্ভবপর হতে পারে না।

সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদন্ডে করে আইন সংশোধন করায় অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছে। এই চরম অমানবিক ও ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। আরো কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বিশ্বব্যাপীই একটি গুরুতর সমস্যা বা প্রবণতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২০১৯ সালে ইউএন উইমেনের পক্ষে জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী ২৪ কোটি ৩০ লাখ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু শাস্তি মৃত্যুদন্ড করলেই যে ধর্ষণ কমবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের একমাস ১০ দিনের তথ্যই এর প্রমাণ দেয়। ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন যদি আসলেই প্রতিরোধ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে আইনের পক্ষপাতহীন ব্যবহার অর্থাৎ কেউ যেন শাস্তি থেকে রেহাই না পায়; সেটা নিশ্চত করতে হবে। এ ব্যাপারে আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। ভিকটিম ও তার পরিবারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। সাক্ষীরও দিতে হবে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা। এটা হলে বিচারের প্রতি অনাস্থা কমবে। সুবিচারের নিশ্চয়তার জন্যও এর আবশ্যকতা রয়েছে। আর বিচার দ্রুত হতে হবে।

এরপরও যে ধর্ষণ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা বলা যায় না। এ অপরাধ সফলভাবে দমনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানসিকতা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো খুবই জরুরি। নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা শুধু মুখে বললে চলবে না, অন্তরে ও মন-মানসিকতার মধ্যে প্রথিত করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার জন্য সমতা ও শ্রদ্ধার স্থান স্থায়ী করতে হবে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিক ও সমাজিক পর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে। পারিবারিকভাবে আগে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। তখন সামাজিক ক্ষেত্রে একটা মূল্যবোধ ও শাসন অনুসরণ করা হতো, যা এখন নেই বললেই চলে। এই সামাজিক মূল্যবোধ ও শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং পাঠ্যবিষয়ের মধ্যে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, সেটাও উঠে গেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় রুখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যসূচিতে মূল্যবোধের চর্চা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের মধ্যে দিয়ে কোনো মানুষ যদি বড় হয়ে ওঠে, তবে তার পক্ষে কোনো অন্যায় ও অনৈতিক কাজ বা অপরাধ করা সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম হতে পারে; তবে সেটা সাধারণ নজির হতে পারে না। কাজেই, মানুষের ভেতরে পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তন আনা গেলে শুধু ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নয়, অন্যান্য অপরাধও নিরুদ্ধ হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।