Home ইতিহাস ও জীবনী মসজিদুল আকসা সম্পর্কে কয়েকটি অজানা তথ্য

মসজিদুল আকসা সম্পর্কে কয়েকটি অজানা তথ্য

মুসলমানদের ধর্মীয় তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদ । -ফাইল ছবি।

সারাবিশ্বের মুসলমানদের কাছে পবিত্রতম স্থানসমূহের মধ্যে ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মসজিদুল আকসা অন্যতম। মূলত মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদীনার মসজিদে নববীর পরই মুসলমানদের নিকট এর অবস্থান। অন্যদিকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদুল আকসা হল প্রাচীনতম মসজিদ। পবিত্র এ মসজিদের নাম আমাদের নিকট পরিচিত হলেও এর অনেক তথ্যই এমন আছে যা আমাদের নিকট অজানা। তাই এই নিবন্ধে মসজিদুল আকসা সম্পর্কে এমন অজানা কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করা হলো।

১) মুসলমানদের প্রথম কিবলা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে পবিত্র কাবা ঘরের বদলে মসজিদুল আকসাকে কেবলা বানিয়ে মুসলমানদের সালাত আদায় করতে হত। মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার কিছুদিন পর পর্যন্তও এই নিয়ম বহাল থাকে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, হিজরতের পর ১৬-১৭ মাস পর্যন্ত মসজিদুল আকসাকে কেবলা বানিয়েই মুসলমানরা সালাত আদায় করেছে।

২য় হিজরী সনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা’আলা নাজিল করেনঃ

“নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আসমানের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ ফিরান এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন (এখন থেকে) সেদিকেই মুখ ফিরাবে।” (আল কুরআন-২:১৪৪)

এই আয়াত নাযিলের পর থেকেই কাবাকে কেবলা বানিয়ে সারাবিশ্বের মুসলমান সালাত আদায় করে থাকে।

আরও পড়তে পারেন-

২) কুরআনে মসজিদুল আকসা-র উল্লেখ

পৃথিবীতে যত মসজিদ আছে, সকল মসজিদের মধ্যে মাত্র দু’টি মসজিদের নাম পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে। এর একটি হল মক্কার মসজিদুল হারাম এবং অপরটি হল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা।

এই দুই মসজিদের নাম উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন,

“পবিত্র ও মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত; যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (আল কুরআন-১৭:১)

৩) মিরাজের যাত্রা

মিরাজের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদুল আকসার এই চত্ত্বর থেকেই ঊর্ধ্বারোহণ করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করেন। এই সফরে তাকে জিবরাইল (আঃ) মক্কা থেকে প্রথমে মসজিদুল আকসায় নিয়ে আসেন। এখানে পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলদের সাথে জামাআতবদ্ধ হয়ে দুই রাকাত সালাত আদায়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ঊর্ধ্বারোহণ করেন। যে স্থান থেকে তিনি মিরাজের জন্য ঊর্ধ্বারোহণ করেন, সেই স্থানটির উপরই পরে সোনালী গম্বুজের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, যা ‘কুব্বাতুস সাখারা’ নামে পরিচিত।

৪)অসংখ্য নবী-রাসূল ও সাহাবীদের কবর

এ স্থানে কত নবী-রাসূলের কবর আছে যদিও তা সঠিকভাবে জানা যায়নি; তবে অনেক নবী-রাসূলই এ স্থানে শুয়ে আছেন। এছাড়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক সাহাবীকেও এই মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

৫) মসজিদুল আকসা ধ্বংস ও পুনর্নির্মাণ

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর হাতে প্রথম নির্মিত এবং হযরত সুলাইমান (আঃ) এর হাতে পরিবর্ধিত আকারে নির্মিত ইবাদতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এ মসজিদটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট কারণে বহুবার ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে। প্রতিবারই তা নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে ব্যাবিলনীয় সম্রাট জেরুজালেম আক্রমণ করে মসজিদুল আকসাসহ পুরো শহর ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারস্যের সম্রাট সাইরাস ব্যাবিলন সাম্রাজ্য জয় করার পর নতুন করে মসজিদুল আকসা তৈরি করা হয়।

৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমের ইহুদি বাসিন্দারা রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে রোমানরা পুরো শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় মসজিদুল আকসা দ্বিতীয়বারের মতো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। রোমানরা শহর থেকে সব ইহুদিকে বের করে দেয় এবং মসজিদুল আকসা ধ্বংসস্তুপ হিসেবে পড়ে থাকে। এসময় শহরের সমস্ত ময়লা এনে মসজিদ কমপ্লেক্সে জমা করা হত।

৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে উমর(রাযিঃ) জেরুসালেম বিজয়ের পর মসজিদুল আকসার ধ্বংসস্তুপকে সরিয়ে নতুন করে মসজিদ নির্মান করেন।

পরবর্তীতে ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান বর্ধিত আকারে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। তিনিই প্রথম মসজিদুল আকসা চত্ত্বরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজ যাত্রায় ঊর্ধ্বারোহনের স্থানে কুব্বাতুস সাখারা স্থাপনাটি নির্মাণ করেন।

৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আব্বাসীয় খলীফা আবু জাফর আল-মানসুর মসজিদটি সংস্কার করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প ও অন্যান্য কারণে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিভিন্ন শাসক তার পুনর্নিমাণ করেছেন।

৬) গীর্জা, প্রাসাদ ও আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার

১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয় খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা যখন জেরুজালেম দখল করে নেয়, তখন তারা মসজিদুল আকসাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিতভাবে ব্যবহার করতে থাকে। এসময় কুব্বাতুস সাখারাকে গীর্জা ও আল-কিবলি মসজিদকে প্রাসাদ ও ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডারদের কাছ থেকে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জেরুজালেম জয় করে নেওয়ার পর তিনি মসজিদুল আকসাকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনেন।

৭)কুব্বাতুস সাখারার গম্বুজ

উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান যখন কুব্বাতুস সাখারা নির্মাণ করেন, তখন সমগ্র স্থাপনাটি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। এর গম্বুজটি তখন সীসা বা সিরামিক দিয়ে আবৃত রাখা হত।

উসমানী সুলতান সুলাইমান আল-কানুনীর সময় তিনিই প্রথম সমগ্র স্থাপনা বর্তমানের মতো টাইলস দিয়ে আবৃত করেন এবং এর গম্বুজ সোনার পাত দিয়ে মুড়ে দেন।

৮)ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ ও ওআইসি প্রতিষ্ঠা

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫-১০ জুনে আরব রাষ্ট্রসমূহ ও ইসরাইলের মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ওপর ইসরাইলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় মসজিদুল আকসাও জায়নবাদী ইসরাইলের দখলে চলে যায়।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে আগস্ট, অস্ট্রেলিয়ান উগ্র জায়নবাদী খ্রিস্টান নাগরিক ডেনিস মাইকেল রোহান আল-কিবলি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে সম্পূর্ণ মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মসজিদে সংরক্ষিত সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সংযোজিত মিম্বার ধ্বংস হয়ে যায়।

মসজিদুল আকসায় অগ্নিসংযোগের এ ঘটনায় সারাবিশ্বের মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬৯ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।