Home ইতিহাস ও জীবনী প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর

প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর

মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়া। আর আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর হল প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ধুলিস্যাৎ হওয়া পর্যন্ত, এই বাতিঘর বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে, এবং বিভিন্ন দেশ থেকে বহু পর্যটক এসে এই বাতিঘর দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তার পাশাপাশি এই বাতিঘরের ইতিহাসও এর খ্যাতির অন্যতম কারণ।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রথম টলেমি সোটার এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাসের রাজত্বকালে, প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাতিঘর নির্মীত হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়া শহর লাগোয়া ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে। মূলত নাবিকদের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছিল।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এই বাতিঘর প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং তিনটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের জেরে এই বাতিঘরটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তবে জানা যায়, ভেঙে পড়ার পরেও এর আয়নায় রশ্মি প্রতিফলিত হত, যা নাবিকদের দিকনির্ণয় করতে সাহায্য করত।

আরও পড়তে পারেন-

আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর নির্মাণ 

পঞ্চদশ শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে এই বাতিঘরের স্থানেই সিটাডেল অফ কায়েটবে নির্মাণ করা হয়। এই সিটাডেল নির্মাণের কাজে এই বাতিঘরের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করা হয়। ফলে বর্তমানে এই বাতিঘরের কোনও অস্তিত্ব নেই।

হালিকার্নেসাসের মুসোলিয়াম এবং প্রাচীন যুগের অন্যতম বিস্ময় গিজার পিরামিডের প্রায় সমসাময়িক আলেকজান্দ্রিয়ার এই বাতিঘর তার ধ্বংসের আগে পর্যন্ত (প্রায় ১৬০০ বছর) প্রাচীন যুগের অনন্য শিল্পকীর্তির নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হত।

এই বাতিঘরের প্রকৃত উচ্চতা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তার ফলে, বিভিন্ন মত অনুসারে এই বাতিঘরের উচ্চতা নাটকীয় ভাবে ভিন্ন – কারও মতে তা ১০০ মিটার, আবার কারও মতে তা ২০০ মিটার উঁচু ছিল। এই কারণে ধরে নেওয়া হয় যে, এই বাতিঘরের উচ্চতা ১০০ থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে ছিল। মনে করা হয়, সমগ্র বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল চুনাপাথর দ্বারা।

আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর-এর বর্ণনা 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জুডিথ ম্যাকেঞ্জির কথায়, “এই বাতিঘরের আরবী বর্ণনাগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে, যদিও এটি একাধিক বার মেরামত করা হয়েছে। বিশেষ করে, ভূমিকম্পের জেরে এটি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে এর অনেকাংশ পুনর্গঠন করতে হয়েছে। তবে এর উচ্চতা বিভিন্ন লেখনিতে মাত্র ১৫ শতাংশ হেরফের হয়েছে। আরবী লেখকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এর টাওয়ার মূলত তিনটি স্তরে নির্মীত হয়েছিল, যেমন একদন নীচের অংশটি ছিল চৌকো, মাঝের অংশটি অষ্টভূজাকৃতি এবং একদম উপরের অংশটি গোলাকার ছিল বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। এই গোলাকার অংশের উপরে ছিল সমুদ্রের দেবতা, পোসেইডনের একটি মূর্তি। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পরিমাপ গণনা করা হয়েছে মুসলিম জগতের বিভিন্ন পর্যটকের চোখে দেখা বর্ণনার উপরে ভিত্তি করে।

সেই সময়ের যে কোনও পর্যটকের চোখেই এই স্থাপত্যটি ছিল একটি সুবিশাল ইমারত। এমনই একজন পর্যটক এই বাতিঘর দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন, “উচ্চতায় যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে …”

এই বাতিঘর বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলির জনগণের কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের বস্তু ছিল এবং এটি দেখতে অনেকেই এখানে আসতেন এবং এর প্রশংসা করে বহু লেখা তাঁরা লিখে গিয়েছেন। এর মূল আকর্ষণ অবশ্যই ছিল এর বিশাল আকার, কিন্তু তার পাশাপাশি এর আয়নাগুলি ব্যবহারের মাধ্যমে যে প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছিল, তা-ও সেই আমলের লোকজনের কাছে অকল্পনীয় ছিল।

Bajteholejantehobe: ইসলামী সভ্যতা থেকে উৎসে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর

শিল্পকলায় আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর

ইসলাম-পূর্ববর্তী আমলের লেখা খুবই দুষ্প্রাপ্য, তবে মুসলিম জগতের লেখকরা বিভিন্ন কাহিনি এবং আখ্যানে এর বিশদ বিবরণ ও স্থাপত্যশৈলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা নথিভুক্ত করেছেন।

মুসলিম জগতের অন্যতম বিখ্যাত পর্যটক তথা ভৌগলিক ইবনে জুবাইর, দ্বাদশ শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিস্ময় দেখার জন্য এখানে এসেছিলেন। এই ভ্রমণ তাঁকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর দেখে তিনি মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন, এই তথ্য তাঁর লেখনি থেকেই জানা যায়।

এছাড়াও বহু পর্যটক এই প্রাচীন বাতিঘরের ছবি এঁকে গিয়েছেন, এবং আবু হামিদ আল-ঘারনাতির মতো পর্যটকের পাণ্ডুলিপিতে তাঁদের নিজে হাতে আঁকা বাতিঘরের ছবি, প্রাথমিক বাতিঘরটি কেমন দেখতে ছিল, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।

ইসলামি জগতের আরও বহু লেখকের লেখনি থেকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়, যেমন- আল-আদ্রিসি, আল-বালাওয়ি, আল-মাসুদি, মুহাম্মদ ইবনে আইয়াস, আল-বাকরি, নাসির-ই খুসরও, মুকাদ্দাসি এবং আরও অনেকে।

এছাড়াও চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে লিখিত আরবী পাণ্ডুলিপি যা কিতাব আল-বুলহান (বিস্ময়ের বই) নামে পরিচিত, তারও একটি পাতায় আলেকজান্দ্রিয়ার এই বাতিঘরের ছবি রয়েছে। তবে এই পাণ্ডুলিপির রচয়িতা সম্পর্কে বিশদে কিছু জানা যায় না।

আধুনিক আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পতাকা এবং সীলে এখনও এই বাতিঘরের চিহ্ন মুদ্রিত রয়েছে যা আলেকজান্দ্রিয়া গভর্নোরেটে ব্যবহার করা হয়। এই একই চিহ্ন আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সীলেও ব্যবহার করা হয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।