Home ইতিহাস ও জীবনী ইমাম আবু হানিফা রহ. : এক বহুমুখী সংগ্রামী জীবন

ইমাম আবু হানিফা রহ. : এক বহুমুখী সংগ্রামী জীবন

হানাফী মাযহাব যাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত সেই ইমাম আবু হানিফা রহ.-কে চেনে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তবে অনেক মানুষই তাকে কেবল একজন ফকিহ হিসেবেই চেনে। কিন্তু বাস্তবে ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, বিতার্কিক এবং ক্ষমতাসীন জালিম বাদশার বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার এক ব্যক্তিত্ব।

ইমাম আবু হানিফা রহ. নামে পরিচিত নোমান বিন সাবিত ৮০ হিজরি মোতাবেক ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। বংশীয় ঐশ্বর্য ও আর্থিক প্রাচুর্যের মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেন। কারণ তার পিতা ও দাদা কাপড়ের বিশেষ করে রেশমী কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই সূত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ.-ও তার প্রাথমিক জীবনে ব্যবসার সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন।

ওলামায়ে কেরামের তুলনায় বাজারেই তার আসা যাওয়া বেশি ছিল। কিন্তু সমকালীন ওলামায়ে কেরাম তার মধ্যে প্রখর মেধা, আশ্চর্য বুদ্ধি, অসাধারণ ধীশক্তি এবং নানা রকম যোগ্যতার নিদর্শন দেখতে পেয়ে তাকে ওলামায়ে কেরামের কাছে আসা যাওয়া এবং তাদের কাছ থেকে দ্বীনী শিক্ষাগ্রহণের পরামর্শ প্রদান করেন।

আরও পড়তে পারেন-

এরপরেই সমকালীন ওলামায়ে কেরামের কাছে আসা যাওয়া, তাদের সান্নিধ্য গ্রহণ এবং তাদের থেকে শিক্ষা লাভ করার মাধ্যমে আবু হানিফা সেই সমস্ত যোগ্যতা ও গুণাবলী অর্জন করেন যা তাকে আজ বিশ্বব্যাপী ইমাম আবু হানিফা রহ. নামের পরিচিতি দিয়েছে।

পরবর্তীকালে দ্বীন ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করলেও ব্যবসা থেকে তিনি পুরোপুরি ফিরে আসেননি। বরং অন্যান্য কাজের পাশাপাশি কমবেশি ব্যবসাও তিনি চালিয়ে গিয়েছেন।

ইমাম আবু হানিফা রহ. ছিলেন খোদা প্রদত্ত তর্কশক্তির অধিকারী। তার জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায় শৈশব ও কৈশোর থেকেই তিনি নানা রকম বিতর্ক মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন।

একবার স্থানীয় শাসকের দরবারে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে তার সাথে কিছু নাস্তিকের বিতর্কের তারিখ নির্ধারিত হয়। নাস্তিকরা সময় মত পৌঁছলেও তিনি যথেষ্ট বিলম্ব করেন। ফলে তারা শাসককে বলতে শুরু করে, পরাজয় নিশ্চিত জেনে আবু হানিফা পলায়ন করেছেন।

কিন্তু দেরিতে হলেও ইমাম আবু হানিফা রহ. মজলিসে এসে হাজির হন। শাসক বিলম্বের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতে শুরু করেন— আমি এই মজলিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলে পথিমধ্যে একটা নদী পড়ল। কোন নৌকাও ছিল না যে নদী পার হব। এমতাবস্থায় আকাশে হঠাৎ একটা মেঘ এসে গর্জন শুরু করল।

মেঘ থেকে বজ্রপাত হল। বজ্র গিয়ে পড়ল নদীতীরের এক গাছে। বজ্রের আঘাতে গাছ সাইজ করা কাঠের ন্যায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এরপর সেই টুকরোগুলো জোড়া লেগে নিজে নিজে নৌকা হয়ে গেল।

কাঠের একটা টুকরো নিজেই চিকন হয়ে বৈঠা বনে গেল। অতপর আমি ঐ নৌকায় উঠতেই সেটা নিজে নিজে চলতে লাগল। পরে আমি এই পারে এসে নেমে এখানে চলে এলাম। এই কারণে মূলত আমার আসতে দেরি হয়েছে।

এই কাহিনী শুনে নাস্তিকেরা শাসকের উদ্দেশ্যে বলল, এ কোন পাগলের সাথে আমরা বিতর্ক করতে এসেছি! গাছ কিভাবে নিজে নিজে নৌকা হয়ে কাউকে নদী পার করতে পারে?

ইমাম আবু হানিফা রহ তখন বললেন, একটা সামান্য গাছ নিজে নিজে নৌকা হওয়া যদি অসম্ভব হয়, তাহলে এই সুবিশাল বিশ্ব চরাচর কোন স্রষ্টা ছাড়াই সৃষ্টি হয়ে এখন পর্যন্ত চলছে এমনটা কিভাবে সম্ভব? বস্তুত স্রষ্টাকে অস্বীকার করা জঘন্য পর্যায়ের মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। ফলশ্রুতিতে নাস্তিকেরা একেবারে লা-জবাব হয়ে মাথা নিচু করে মজলিশ ত্যাগ করে।

ইমাম আবু হানিফা রহ. বাতিলের সাথে নিজের আপোষহীনতার কারণে বারবার শাসকদের অত্যাচার ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। সত্তর বছরের জীবনে তিনি উমাইয়া খেলাফতের পতন এবং আব্বাসী খেলাফতের উত্থান দেখেছেন।

১২১ হিজরীতে উমাইয়া শাসনামলে হযরত হুসাইন রা.-এর দৌহিত্র যায়েদ ইবনে আলী যায়নুল আবেদীন ইবনে হুসাইন ইবনে আলী রা. তৎকালীন খলীফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তিনি যায়েদকে মৌন সমর্থনের পাশাপাশি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন।

এর ফলশ্রুতিতে কুফা নগরীর তৎকালীন শাসকের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তাকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সোজা মক্কা মোকাররমায় চলে যান এবং উমাইয়া খেলাফতের পতন হয়ে আব্বাসী খিলাফতের সূচনাকাল পর্যন্ত তিনি মক্কাতেই অবস্থান করেন।

আব্বাসী খিলাফতের সূচনাকালে তিনি আবারো কুফায় ফিরে আসেন। আব্বাসী খলিফা আবু জাফর মনসুর-এর সাথে শুরুর দিকে তার সম্পর্ক ভালো থাকলেও পরবর্তীতে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। খলিফা মনসুর তাকে বারবার কুফার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এবং সেই সময়ে যে সমস্ত বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণ করে খলিফার মর্জিমাফিক ফতোয়া দিত তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের সমালোচনা করতেন।

খলিফার প্রস্তাব গ্রহণ না করার কারণে তাকে কারাবদ্ধ করা হয় এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে কিছুটা মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

কারো মতে তিনি কারাগারে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আর কারো কারো মতে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। ১৫০ হিজরিতে ইমাম আবু হানিফা রহ. ইন্তেকাল করেন। তার জানাজায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল।

হানাফি মাযহাব অনুসরণের দাবি আমরা সবাই করি। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর সংগ্রামী জীবনের আদর্শ আমরা কয়জন জানি?

[তথ্যসূত্র— * ফাযায়েলে আবী হানীফা, ইবনে আবিল আওয়াম রচিত * শরহুত ত্বহাবিয়্যাহ ফিল আকীদাতিস সালাফিয়্যাহ, সদরুদ্দিন ইবনে আবিল আয রচিত * উইকিপিডিয়া]

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।