Home ইতিহাস ও জীবনী মিনারের ইতিহাস: আল্লাহর আশ্রয়ে নিয়ে আসে যে ইসলামী স্থাপত্য

মিনারের ইতিহাস: আল্লাহর আশ্রয়ে নিয়ে আসে যে ইসলামী স্থাপত্য

মিনার – ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন বললেই যে স্থাপত্যের কথা একজন ঈমানদার মুমিনের চোখে ভেসে ওঠে।

মিনারের ইতিহাস বললে মনে পড়ে, অতীতে একজন মুয়াজ্জিন এই মিনার থেকেই সমস্ত ঈমানদার মুসলমানদের উদ্দেশে আযানের ধ্বনি দিতেন। এখন অবশ্য মাইক সেই কাজটা করে, কিন্তু সেই মাইকটিও বাঁধা থাকে মসজিদের মিনারের গায়েই।

ঐতিহাসিকরা গবেষণা করে দেখেছেন, বিভিন্ন যুগের মসজিদের সঙ্গে মিনারের স্থাপত্যেরও নানাবিধ পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণত মসজিদের গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই হয়েছে সেই পরিবর্তন।

ইসলামী স্থাপত্য মিনারের ইতিহাস ও তার উৎস

মিনারের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমেই আমাদের মিনার শব্দটির উৎস জানতে হবে। আরবি শব্দ ‘মানারাহ’ থেকে এসেছে মিনার শব্দটি, মানারাহর অর্থ সঙ্কেত। মূলত সমুদ্রে পথ দেখানো বাতিঘরের সঙ্কেতের উদ্দেশেই এই মানারাহ শব্দটি ব্যবহার হত।

আরও পড়তে পারেন-

তাত্ত্বিকভাবে দেখলে সমুদ্রে পথ দেখানো বাতিঘর আর মসজিদের মিনারের কাজের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, দুটিই হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পথ দেখায়। মসজিদের মিনার আদতে পথ দেখিয়ে মানুষকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসে।

ঐতিহাসিকরা বলেন, ইসলামের একদম শুরুর দিকে অবশ্য মসজিদের মিনারের চল ছিল না। হাদিসের থেকে জানা যায়, মদিনার মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে প্রিয় নবীর বাড়ির ছাদ থেকে প্রার্থনার জন্য আযান দিত।

কিন্তু তাতে সমস্ত মুসলমানের কাছে আযানের ধ্বনি পৌঁছনোয় অসুবিধা দেখা দিল। তখন বিলাল নামক এক মুমিনকে মুয়াজ্জিন হিসেবে ধার্য্য করা হল।

বিলাল প্রিয় নবীর অনুমতি নিয়ে মসজিদের নিকটবর্তী সবেচেয় উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে আযান দিতে শুরু করলেন। এদিকে তখন বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্য মুসলমানদের দখলে এসে গিয়েছে।

একইভাবে কনস্ট্যান্টিনোপল শহরের মুয়াজ্জিন রোমান স্থাপত্যের উঁচু টাওয়ার থেকে আযান দেওয়া শুরু করলেন। দেখা গেল, এর ফলে, দূর দূরান্তের মুসলমানদের কাছেও আযান পৌঁছচ্ছে।

পরবর্তীতে উম্মাইয়া বংশের রাজত্বের সময় মদিনা, দামাস্কাস ও মিশরের প্রথম রাজধানী ফুস্তাতে কিছু মসজিদ তৈরি হয় যাতে মিনারের মত কিছু স্থাপত্য গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সহি ইসলামী স্থাপত্যের লেশমাত্র ছিল না ঐ মিনারগুলির মধ্যে, বরং কেল্লার বুরুজের সঙ্গে মিল ছিল বেশি।

নবম শতকে মিনারের ইতিহাস ও স্থাপন 

ধরে নেওয়া হয়, ৭৫০ অব্দের পর আব্বাসীয় রাজবংশের শাসনকালে সহি মিনারের স্থাপন হয়েছিল। ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রু পিটারসন জানিয়েছেন, আব্বাসীয় খলিফারা নিজেদের ধর্মীয় অনন্যতা বজায় রাখার জন্যই মিনারের পত্তন করেন।

এই কারণে, নবম শতকের প্রথমদিকের অন্তত ছয়টি মসজিদে একটি করে মিনার দেখা যায়। বিশেষ করে, মিহরাবের বিপরীত দিকের দেওয়ালগুলোতেই দেখা যেত এই মিনার।

মসজিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হল এই মিহরাব। যা মূলত ইসলাম ধর্মের কিব্বলা বা উপাসনার দিক, অর্থাৎ মক্কা শহরের দিক লক্ষ্য করে তৈরি হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, যে যে অঞ্চলগুলি আব্বাসীয় খিলাফতের অন্তর্গত ছিল, সেই অংশের মসজিদের মিনারের দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু, ঐ একই সময়ে, মিশরের কিছু কিছু অংশে ফাতিমিদ রাজবংশের শাসন জারি ছিল।

তাঁদের অঞ্চলের মসজিদ ছিল প্রাচীনপন্থী। অর্থাৎ বলা যায়, আব্বাসীয় খিলাফতের সময় থেকেই মসজিদের অন্যতম অংশ হয়ে উঠল মিনার।

প্রাচীনতম মসজিদ ও মিনারের উদাহরণ

বিশ্বের প্রাচীনতম মিনারসহ মসজিদের দর্শন কিন্তু পাওয়া যায় সিরিয়ায়। দামাস্কাসের উম্মাইয়া মসজিদে রয়েছে প্রাচীনতম মিনার। এই মসজিদ প্রথম আল ওয়ালিদের সময় তৈরি, যিনি উম্মাইয়া খিলাফতের ষষ্ঠ খলিফা ছিলেন।

কিন্তু ৮৫০ অব্দে আব্বাসীয় খিলাফতের সময় মিনারটি যুক্ত করা হয়। এই মিনারটিকে বলা হয় মাদানাত আল আরুস, বা আরুসের মিনার। সমগ্র মসজিদের মত এই মিনারটিও পাথরে তৈরি।

পরবর্তীতে উম্মাইয়া মসজিদে ১২১৭ অব্দে স্থাপিত হয় ঈশার মিনার, যা উচ্চতায় ২৫৩ ফুট।

ইসলামী মিনারের গঠন

স্থাপত্যবিদদের মতে, মসজিদ সংলগ্ন মিনারগুলির গঠন বেশ আকর্ষনীয় ও বিজ্ঞানসম্মত। একটি মিনারে তিনটি অংশ থাকে, চতুর্ভুজ আকারের ভিত, অষ্টকোণী মধ্য অংশ ও সবচেয়ে উপরে একটি গম্বুজ।

গম্বুজে পৌঁছনোর জন্য মিনারের মধ্যে থাকে সরু সিঁড়ি। প্রাচীনকালের মিনারে চতুর্ভুজ ভিতের উচ্চতা বেশি ছিল, কিন্তু ক্রমশ অষ্টকোণী মধ্য অংশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইরাকের সবচেয়ে বিখ্যাত মিনার দেখা যায় সামারার মসজিদে। নবম শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের সময় তৈরি এই মসজিদ অবশ্য ইরাকে মঙ্গোল আক্রমণে অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছু অংশ ও মিনারটি এখনও অটুট রয়েছে।

এই বিখ্যাত মিনারটি মালওয়াইয়া নামে পরিচিত। মালওয়াইয়া শব্দের অর্থ শামুকখোল। মিনারের ভিত ৩৫৫ বর্গফুট, উচ্চতা ১৮০ ফুট।

মিনারটির উপরে উঠতে গেলে পাঁচ পাক সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয়। কথিত আছে, আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল নাকি গাধার পিঠে চেপে এই মিনারের মাথায় উঠতেন।

বর্তমানে মুয়াজ্জিন মাইকের মাধ্যমে আযানের ডাক দিলেও একটি মসজিদের সৌন্দর্য খর্ব হয় যদি মসজিদটিতে মিনার না থাকে। তাই এখন বেশিরভাগ ইসলামী স্থাপত্যেই মিনার দেখা যায়।

বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে মিনার চোখে পড়বেই। ভারতে মিনারের রমরমার জন্য অবশ্য মোগলদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, তাঁরাই প্রথম মিনার স্থাপত্যকে মসজিদের বাইরে নিয়ে এসে কেল্লা ও দুর্গেও ব্যবহার করতে শুরু করে।

আসলে, মিনার যেন আল্লাহর পথে এগিয়ে যাওয়ার একটা রাস্তা। বাতিঘরের মত দিকভ্রষ্ট মানুষকে নিয়ে আসে আল্লাহর আশ্রয়ে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।